হেফাজতের তান্ডব আর আমার দেশের অপপ্রচার একসূত্রে গাঁথা

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি ও যুদ্ধাপরাধীর বিচার ঠেকানোই উদ্দেশ্য

স্টাফ রিপোর্টার, জনকণ্ঠ ॥ হেফাজতে ইসলামের তান্ডব আর দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার অপপ্রচার মূলত একসূত্রে গাঁথা। দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করতেই পরিকল্পিতভাবে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ নিয়ে অপপ্রচার চালাতেও পত্রিকাটি দ্বিধা করেনি। এরপর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ব্লগারদের ধর্মীয় মূলবোধ নিয়েও অপপ্রচার চালানোর দায় এড়াতে পারে না পত্রিকাটি। পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মাহমুদুর রহমানের এমন অপপ্রচারের দায় এড়ানোর ন্যূনতম সুযোগ নেই। এমন অপপ্রচারের জের ধরেই গত ৫ মে নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসির দাবিতে হেফাজতীরা রাজধানীতে বেপরোয়া ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা শত শত পবিত্র কোরান শরীফ পুড়িয়ে দিতেও দ্বিধা করেনি। আগুন ধরিয়ে দিয়েছে পবিত্র জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে হাজার হাজার মানুষকে পথে বসিয়েছে। পুরো বিষয়টিই পূর্বপরিকল্পিত।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘গবর্নমেন্ট গেছে পাগল হইয়া, তারা একটা রায় চায়।’ ‘ড. কামাল ক্রিমিনাল বোঝে না, গ্যাঞ্জাম করে, ওয়ালিউর চোর।’ ‘সাহারাকে সরিয়ে দেয়া গুড নিউজ’ ইত্যাদি শিরোনামে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।
এমন সংবাদ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজকে ব্যাহত করছে বলে অভিযোগ করে গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর সাহিদুর রহমান বাদী হয়ে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এক মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ২০। মামলার অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক নিজামুল হকের কথিত স্কাইপি কথোপকথন হ্যাকিং করে তা প্রকাশ বিচারকাজকে ব্যাহত করেছে।
গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট এসএম আশিকুর রহমান রাষ্ট্রদ্রোহ ও সাইবার অপরাধ আইনে দায়েরকৃত মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে মামলাটির তদন্ত করতে তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
এছাড়া কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতাদের মুক্তির দাবিতে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ নিয়ে সেখানকার আলেম-ওলামারা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করছে বলে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরে পবিত্র কাবা শরীফের গিলাফ পরিবর্তনের দৃশ্যকে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় বিকৃত ও ভুলভাবে উপস্থাপন করার বিষয়টি প্রকাশ পেয়ে যায়। এ নিয়ে সারাদেশে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়।
এমন পরিস্থিতিতেই চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন ফাঁসির আদেশ দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এমন রায়ে ফুঁসে ওঠে দেশের স্বাধীনতার পক্ষের সব শক্তি। তারই প্রেক্ষিতে ব্লগার ও অনলাইন এ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে রাজধানীর শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠে গণজাগরণ মঞ্চ। এরপর আমার দেশ পত্রিকাটি ব্লগারদের ধর্মীয় অনূভূতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরুর পরদিন ৬ ফেব্রুয়ারি ‘শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরটি লাল কালিতে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকাটিতে ব্যানার লিড করেন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
এমন প্রচারণায় দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ব্লগারদের ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে প্রপাগান্ডার চলার কারণে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্লগার ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনকে রাজধানীর পল্লবীর নিজ বাসার সামনে খুন হতে হয়।
এমন প্রচারণার জের ধরেই গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে জামায়াত-শিবির ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠনগুলো রাজধানীসহ সারাদেশে তা-ব চালায়। এর উস্কানিদাতা হিসেবে আমার দেশ পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে রাজধানীর শাহবাগ ও রমনা থানায় ৫টি মামলা হয়।
এরপর হেফাজতের গত ৬ এপ্রিলের লংমার্চ কর্মসূচী সফল করতে ১৮ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে ৮৫ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুব-উল আলম হানিফ। লংমার্চের বিষয়েও পত্রিকাটি নানা ধরনের প্রচারণা চালায়। এর জের ধরে লংমার্চ কর্মসূচীর ২ দিন পর ৯ এপ্রিল বুয়েটের ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দ্বীপের ওপর প্রকাশ্যে হামলা চালায় হেফাজতে ইসলামের সমর্থক বুয়েট ছাত্র মেজবাহ উদ্দিন।
গত ১১ মে স্কাইপি হ্যাকিংয়ের অভিযোগে দায়েরকৃত মামলায় মাহমুদুর রহমানকে কাওরানবাজারে আমার দেশ পত্রিকার কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারের রাতেই তেজগাঁও আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানায় তল্লাশি চালিয়ে কিছু আপত্তিকর জিনিসপত্র জব্দ করা হয়। পরদিন আমার দেশ পত্রিকা বেআইনীভাবে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক আবুল আসাদের মালিকাধীন রমনা থানাধীন ৪২৩ নম্বর আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ছাপানো কপি সম্পূর্ণ বিধিবহির্ভূতভাবে প্রচার ও বিতরণ করা হয়।
পরে ঢাকার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের মুদ্রণ বিভাগের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাসরিন সুলতানা ও রমনা মডেল থানা পুলিশ অভিযান চালিয়ে আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস থেকে অবৈধভাবে ছাপানো আমার দেশ পত্রিকার ৫ শতাধিক কপি জব্দ করে। এ ব্যাপারে ১৩ এপ্রিল রাতে রমনা মডেল থানার উপ-পরিদর্শক অলিভ মাহমুদ বাদী হয়ে রমনা থানায় বেআইনীভাবে মুদ্রণ নীতিমালা অমান্য করে আমার দেশ পত্রিকা ছাপানোর দায়ে ১৯৭৩ সালের ৩২ ও ৩৩ নম্বর ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন।
এদিকে ধর্মীয় উস্কানির সূত্রধরেই গত ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচী পালন করে হেফাজতে ইসলাম। এরপর সমাবেশের অনুমতি নিয়ে মতিঝিল, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম, তার সামনের অন্তত হাজারখানেক দোকানপাট, ৬ শতাধিক পবিত্র কোরান শরীফ, বায়তুল মোকাররম মসজিদে আগুন দেয়। ২ শতাধিক যানবাহনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। সাংবাদিক, পুলিশ, পথচারীসহ অন্তত ২ শতাধিক জনকে আহত করে। অন্তত শতাধিক ভবন ভাংচুর করে তারা। আর হাজারখানেক দরিদ্র হকারের দোকান পুড়িয়ে দিয়ে তাদের চিরদিনের জন্য পথে বসিয়ে দেয়। ওইদিন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পুলিশ সাংবাদিক, পথচারীসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয়।