রবিবার, ২ জুন, ২০১৩

শাহবাগ আন্দোলন, অপারেশন ফ্লাশ আউট এবং গণমাধ্যমের ভুমিকা

শিবলী চৌধুরী কায়েস
বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠের আওয়াজ বাস্তবে শুনার ভাগ্য হয়নি এ প্রজন্মের অনেকেরই। ঠিক তেমনি আমিও। স্বপ্ন দেখা সেই ছোট বেলা থেকে। বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন ধারন করেই চলছি আমরা। স্বপ্ন দেখছি, সোনার বাঙলা গড়ার। গেল জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বঙ্গবন্ধু কন্যার দল আওয়ামী লীগকে নিজের ব্যালট সর্মথন দিতেও কুন্ঠাবোধ করেনি। কিন্তু কষ্ট হচ্ছে এই ভেবে যে; অতীত বাদ দিলাম ৯৬-এর আওয়ামী লীগ আর বর্তমান মহাজোট সরকারের দেশ পরিচালনার ধরণ দেখে। কাংখিত স্বপ্নের সোনার বাঙলা প্র্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো।
৭৫-এর কালোরাতে সেই স্বপ্ন ধ্বংস করা হয়েছে। শুনেছি বাবার মুখে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে ৫ মে’র কালো রাত জাতির জন্য অপেক্ষমান ছিলো তা স্বপ্নেও ভাবিনি। শাহবাগ থেকে ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ডের শুরু। জন্ম নেয় হেফাজত ইসলাম নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। আল্লামা শাহ্ আহমদ শফির নেতৃত্বে রাজপথে নামে আলেম ওলামারা। শুধু আলেম সমাজ বললে ভুল হবে। কোরাআন ও ইসলাম রক্ষায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ দেখা গেছে। গেল ৬ এপ্রিল হেফাজত ইসলামের মহাসমাবেশই তার বড় প্রমান। যে জনস্রোতে সৃষ্টি হয় ইতিহাসের নজিরবিহীন জনসভায়।

হেফাজত ইসলাম নামের একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও; তাদের নিয়ে রাজনীতির খেলায় মেতে উঠেছে সরকার ও বিরোধী দল। যা সবার জানা। নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৩ দফা দাবি আদায়ে একমাস পরে ফের মাঠে নামে হেফাজত কর্মীরা। ঢাকা অবরোধ কর্মসূচিকে ঘিরে লাখো জনতরা ঢল নামে রাজধানীর বুকে। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে সর্বশক্তির প্রয়োগ করে সরকার। দিনের আলো গড়িয়ে রাতের অন্ধকারে চলে অপারেশন।

৫ মের কালো রাত। ঘড়ির কাটায় রাত ২টা ৩০ মিনিট। কেঁপে ওঠে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিল ও আশপাশের এলাকা। অন্ধকার এলাকাটি জুড়ে শুধু গুলি আর গ্রেনেডের আওয়াজ। যৌথ বাহিনীর সাঁজোয়া যানের সাইরেনে চলে একতরফা যুদ্ধ। ‘অপারেশন ফ্লাশ আউট’ নামের এ অভিযানে অংশ নেয় বিজিবি, র‌্যাব আর পুলিশের ১০ হাজার সদস্য। মতিঝিল, দৈনিক বাংলা, ফকিরাপুল, ইত্তেফাক মোড়সহ আশপাশের এলাকা পরিনত হয় এক নারকীয় বধ্যভুমিতে। যদিও হতাহতের সঠিক পরিসংখ্যান কারোর জানা নেই। গুলি আর বোমার সামনে টিকতে না পেরে দিক-বিদিক সটকে পড়ে হেফাজত কর্মীরা। সমাবেশস্থলে বসে থাকা নিরস্ত্র ও অসহায় এসব আলেমদের রক্তে ভেসে যায় শাপলা চত্বরের কালো পিচঢালা পথ। যাদের তাজা রক্তের ধারা পানিতে মিশে যায়। ফ্যাসিবাদি কায়দায় এ হামলার ঘটনায় প্রকম্পিত হয়ে উঠে পুরো রাজধানী। নিরস্ত্র আলেম-ওলামাদের ওপর হামলায় ও প্রানঘাতির পরিসংখ্যান নিয়ে দেশব্যাপী গুজব ছড়িয়ে পড়ে।

সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের ত্রিমুখী হামলার ঘটনাকে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ হিসেবে দেখছেন অনেকে। এ ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যম’সহ সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কে উঠে আসে হামলার বর্ণনা। সূত্রমতে, ‘কেউ কেউ ঘুমের মধ্যেই চলে যান চিরঘুমের দেশে। অনেকে আবার কিছু বুঝে উঠার আগেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে’।

‘‘কিন্তু ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে সরকার ধর্মভীরু এসব সাধারণ নিরিহ মানুষের লাশের উপর দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে?’’ অপরাশেন ফ্লাশ আউটে হয়তো টিকে থাকার লড়াইয়ে সাময়িক সফলতা বয়ে এনেছে সরকার। বাস্তবতা নিয়ে শঙ্কিত এখন পুরো দেশ ও জাতি। সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত সরকারকে বেকায় ফেলেছে। যা হচ্ছে অপারেশন চলাকালে ভিন্ন মতের দুটি টিভি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ করা। যার ফলে মানুষের মনে শঙ্কা আর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন উঠে ‘সাভার ভবন ধসের ১৭ দিন পর একজন নারী শ্রমিকের জীবিত উদ্ধার নিয়ে। সবই নাকি সরকারের কৌশল’?!

অপারেশন শেষে বিভাজন সৃষ্টিকারি শাহবাগ আন্দোলন মঞ্চ গুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে যদি এ সহজ কাজটি সরকার আগে করতে পারতো! তাহলে হয়তো দেশে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতোনা। হেফাজতে ইসলাম এখনও একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু কেউ যদি একে রাজনৈতিক সংগঠনে পরিণত হতে বাধ্য করে, তাহলে কাকে দোষ দেয়া যায়? নারীদের চলাফেরা নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা হেফাজতে ইসলামের হয়তো ছিলোনা। তবে শাহবাগিদের মতো অবাধে মেলামেশা বন্ধ/নিষিদ্ধের দাবি ছিলো তাদের ১৩ দফাতে।

সরকার ব্লগারদেরকে মাসের পর মাস ব্যস্ত শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়ার সুযোগ দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে বিরিয়ানী খায়ানো’সহ পুলিশ দিয়ে তাদেরকে প্রটেকশনও দেয়ারও। অথচ দেশের আলেম-উলামাদের সে সুযোগ একটি দিনের জন্যও দিল না। হাসিনা সরকারের কাছে ইসলামপন্থিরা যে কতটা অসহ্য, তাদের বিরুদ্ধে এ সরকার যে কতটা নিষ্ঠুর ও আগ্রাসী; তার প্রমাণ ৫ মে’র অপারেশন। এসব না ভেবে ব্লগারদের পক্ষ নিয়ে এবং তাদের রক্ষায় সরকার কতটা সফলতা অর্জন করতে পারবে তা আগামী বলে দেবে। বর্তমানে সবার মুখে একটাই কথা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই নৃশংস বর্বরতার রেকর্ড নির্মিত হয়। আওয়ামী লীগের এটিই আসল রূপ। কিন্তু কেন? এর জন্যই কি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিলো? বঙ্গবন্ধু কি এ স্বপ্ন দেখেছিলেন! ‘যেমন পিলখানায়, তেমনি সাভারের রানা প্লাজা ধস ও মতিঝিলের অপারেশন ফ্লাস আউট’।

যে কথা না বললেই নয়! যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সৃষ্টি শাহবাগ আন্দোলন। একে অস্বীকার করাটা বোকার স্বর্গে বসবাস। কারন ন্যায়-অন্যায় যাই হোক। স্রোতের উল্টো অবস্থান কারো জন্যই কাম্য নয়। তেমনি হেফাজত ইসলামের আন্দোলন কিংবা জনস্রোতকে প্রতিহত করে সরকার সঠিক পথে যায়নি অনেকের দাবি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘‘বিচার বিভাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোনো রায় বের করে নিয়ে আসার প্রবণতা সমাজে ভালো ফল দেয় না’’।

যদি ফাঁসির রায় দেয় তাহলে শিবির চুড়ান্ত শক্তি নিয়ে ময়দানে নামবে। ‘‘চোরাগুপ্তা হামলা চালাবে।শত শত লোক নিহত হবে। কিছু মন্ত্রী, এমপি, বিচারক, পুলিশ প্রথম চোটেই মারা যাবে। এটা বাড়তে বাড়তে এমন হবে, স্বয়ং সরকার কিংবা প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রনে থাকবে না। জনমনে এমন ভয়, উৎকন্ঠা ঘুরপাক খাচ্ছে প্রতিনয়িত’’। ‘তখন নেমে আসবে মার্শাল’ল। ফের ওয়ান ইলেভেনের উৎপত্তি। চোর, দূর্বৃত্ত আর ৫৭ সেনা হত্যার বদলা যখন হবে, চূড়ান্ত ক্ষতি হবে কার? আওয়ামী লীগের নিশ্চয়ই। বাঙালী জাতি এসব আর দেখতে চায় না’।(সূত্র-বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত)।

গেল ৫ই ফেব্রয়ারি ২০১৩। যে দাবিকে ঘিরে এই নতুন প্রজন্মের উৎপত্তি, দিন বাড়ার সাথে সাথে জনস্রোত বাড়লেও একে ঘিরে রাজনীতি ও নেতৃত্ব পরিষ্কার ছিলো না। তাদের আন্দোলন কি সরকারের নীতিজ্ঞানহীন গোপন আঁতাতের বিরুদ্ধে; নাকি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে? (যাতে পুলিশী কোন বাধা ছিলো না।......) অন্যদিকে ব্লগার অ্যাক্টিভিস্ট সংগঠনের আহ্ববায়ক যিনি ঐতিহাসিক চরম পত্র পাঠ করেছিলেন। তিনি কিনা সরকার সমর্থিত চিকিৎসক পরিষদ স্বাচিপ নেতা এবং রংপুর মেডিকেল শাখার ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। এমন অভিযোগ ও তথ্য প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তাহলে কি বলতে পারি এ আন্দোলন অরাজনৈতিক?

২১ শে ফেব্রুয়ারির তরুণপ্রজন্মের মহাসমাবেশে ইসলামবিরোধী অবস্থানের কিছুটা নমনীয়তা দেখা গেছে। সারাদেশের আলেম ওলামাদের হুঁশিয়ারী এর অন্যতম কারণ। তবে জাতিকে বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে এমন অভিযোগও উঠে আসে বিভিন্ন মহল থেকে। রাসুল (স.) ও ইসলাম বিরোধী কর্মসূচির/কটূক্তির প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারী শুক্রবার সমমনা ইসলামী দল ও সংগঠনের ব্যানারে জুমার নামায শেষে দেশব্যাপী মুসল্লীদের বিক্ষোভ সমাবেশ কে ঘিরে যে ঘটনা ঘটেছে তা সত্যিই জাতি হিসেবে আমাদের কাম্য নয়। তাহলে কি এক শাহবাগ আন্দোলন সাংবাদিক সমাজ ও জাতিকে বিভক্তির নিয়ে যায়। জন্ম নেয় হেফাজত ইসলাম নামের এই সংগঠনটি। যাদের সাময়িক দমিয়ে রাখা হলেও আরো সু-সংগঠিত হবার কথাও উঠে আসছে বিভিন্ন মাধ্যমে।

‘‘দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আমাদের গণমাধ্যমের ভুমিকা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। যা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়বে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা সাংবাদিকদের নীতি আদর্শ এখন প্রশ্নের মুখে’’।

সরকার ভিন্নমতের গণমাধ্যম দৈনিক আমারদেশ প্রকাশনা, দিগন্ত টিভি ও ইসলামী টিভি সম্প্রচার বন্ধ করে অনেকটা বিপাকে পড়েছে। তবে সাময়িক সফলও বলা চলে। কারন অন্যসব গণমাধ্যম এখন সরকারের নির্দেমনা মাফিক চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিখ্যাত লেখক নজরুল হাফিজ নদভীর ‘পশ্চিমা মিডিয়ার স্বরুপ’ এই বইটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে বিশ্বজুড়ে। টেলিভিশন যুদ্ধ এবং প্রশাসনের হস্তক্ষেপে গোটা জাতিকে কিভাবে ধ্বংসের মূখে ফেলে দেয়; তার উদাহরণ এই বইটি। উপসাগরীয় যুদ্ধের কথা সবারই জানা। সে সময় পশ্চিমা টিভি কোম্পানীগুলো এক প্রতিযোগীতায় নামে। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং পশ্চিমা স্বার্থ সংশ্লিষ্টতাই ছিল যার মূল লক্ষ্য।

বৃটিশ টেলিভিশন (ইটিভি) বর্তমানে যার কোন অস্তিত্ব নেই। উপসাগরীয় যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহে বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় বহন না করতে পেরে ময়দান থেকে ছিটকে পড়ে। যেখানে শুধুমাত্র সিএনএন ২৪ঘন্টায় লাইভ সম্প্রচারে বিশ্বব্যাপী টেলিভিশন রিপোর্টিং-এর এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। মূল এজেন্ডা ছিল পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করা।

এ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সিএনএন লাইভ সম্প্রচারে ব্যয় করেছিলো প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন মার্কিন ডলার। যার বিপরীতে মূনাফা অর্জন করে, নয় গুনের বেশী। মিথ্যা প্রচারনা আর বিশ্বের জনগণের সাথে ধোঁকাবাজি ও প্রতারণা’সহ গুপ্তচরবৃত্তিতে দ্বিধাবোধ করেনি সিএনএন সংবাকর্মীরা।\

একমাত্র সিএনএন ছাড়া উপসাগরীয় যুদ্ধের সকল গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর ‘পেন্টাগন’ নিষধাজ্ঞা আরোপ করে। কারন পেন্টাগণের মর্জির ওপর সংবাদ পরিবেশনকারীরাই পেয়েছিলেন অ্যাক্রেডেটিশন কার্ড। অন্যরা ছিল তালিকার বাহিরে। তখনকার সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের নেতৃত্বে প্রায় দেড় হাজার সদস্য পেন্টাগণের এই নিষধাজ্ঞার প্রতিবাদ জানায়। সাংবাদিকদের প্রতিবাদ ছিল শুধুমাত্র সিএনএনকে কেন উপসাগরীয় যুদ্ধে একচ্ছত্র অধিকার দেয়ার বিরুদ্ধে। মার্কিন টাইম ম্যাগাজিনের এক সাংবাদিককে প্রায় ২৪ঘন্টা আটকে রাখে সেনাবাহিনী। একতরফা রিপোটিং এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিগ্যানের প্রেস সচিব ‘টিকেল ডেভিড’ বলেছিলেন, ‘‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকতার এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন জর্জ বুশ’’।

১৯৯১ সালের ১৭ই জানুয়ারি। বাগদাদে নিযুক্ত সিএনএন রিপোর্টার ‘পিটার অরেন্ট’ ইরাকে মার্কিন হামলায় পরিকল্পনার দায়িত্ব পান। তার তথ্যানুসারেই পেন্টাগন বাগদাদে হামলা চালাতো। উপসাগরীয় যুদ্ধের সংবাদ সরবরাহকারী ৪ হাজার ৬শ সাংবাদিকের একমাত্র তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম ছিলো সিএনএন। সত্য কিংবা মিথ্যে যাই হোক না কেন; সিএনএন এর উপর নির্ভর করতো বিশ্ববাসী। ইহুদি মালিকানার এ চ্যানেলটির অসাধারণ রিপোর্টিং ও সংবাদ সম্প্রচারের কথা বিশ্বব্যাপী সামাদৃত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ মিত্র দেশের এক রাষ্ট্রপ্রধানকে গর্ব করে বলেন, ‘সিআইএ থেকেও সিএনএন পরিকল্পনা মাফিক বেশী তথ্য দিচ্ছে’। সিআইএর প্রধান পরিচালক উইলিয়াম ভিসিটার, জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ব্রান্ট সেকা ক্রাফট’কে সিএনএন-এর তথ্যের উপর বাগদাদে মিজাইল ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর নির্দেশও দেন বুশ। যুদ্ধ পরবর্তী ইরাকের ইতিহাস সবার জানা।

বাংলাদেশেও কি একই কায়দায় মিডিয়া আগ্রাসন চলছে? ভিন্ন মতাদর্শের গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদদের অভিযোগে তা উঠে আসছে প্রতিনিয়ত। অনেকটা নতুন আঙ্গিকে মিডিয়ার কন্ঠরোধের চেষ্টার ধারাবাহিক অংশই হচ্ছে শাহাবাগের গণজাগরণ মঞ্চ বিষয়ে অতিমাত্রায় সম্প্রচার।

মিডিয়া বন্ধে অতীতের সরকারের রেকর্ড আছে। দেশের একমাত্র বেসরকারী ও জনপ্রিয় টেলিভিশন একুশে টিভি বন্ধ করার পর দলীয় মালিকানায় নতুন চ্যানেলের অনুমোদন। ঠিকই তারই ধারাবাহিকতায় আরো কয়েক ধাপ এগিয়েছেন বর্তমান সরকারও। অনুমোদন দেন সারিসারি টিভি চ্যানেলের।.... ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের প্রথম ও একমাত্র ২৪ঘন্টার নিউজ চ্যানেল সিএসবি বন্ধ করে দেয়।

ধারাবাহিকতায় আরো একধাপ এগিয়ে যায় মহাজোট সরকার। প্রথমে জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেল-ওয়ান সম্প্রচার বন্ধ করা হয়। মতপার্থক্য থাকায় লাইসেন্স দেয়ার পরও পরিপূর্ণ সম্প্রচারে আসা হয়নি ২৪ঘন্টার সংবাদ ভিত্তিক চ্যানেল যুমনা টেলিভিশনের। ডিজিটাল বাংলাদেশে অনলাইন পত্রিকাও আলোচনা-সমালোচনা ঝড় তুলেছে। সরকারের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বন্ধ হলো অনলাইন সংস্করণ ‘শীর্ষ নিউজ’।

সর্বশেষ হেফাজত ইসলামকে কেন্দ্র করে প্রথমে দৈনিক আমারদেশ প্রকাশনা বন্ধ’সহ গ্রেফতার করা হয় পত্রিকাটির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে। ৬ মে’র ভোর রাতে দিগন্ত ও ইসলামী টিভির সম্প্রচার বন্ধ করে মহাজোট সরকার। বলা যায়, এক শাহবাগ আন্দোলন সাংবাদিকদের ঐক্যে ফাটল ধরালেও ধারাবাহিক গণমাধ্যম বন্ধের ফলে শীর্ষ ১৫টি দৈনিকের শ্রদ্ধেয় সম্পাদকদের ঐক্যমত দাবিটি প্রত্যাশা করেনি মহাজোট সরকার। দেশের প্রজ্ঞাবান এসব সম্পাদকমন্ডলীদের নিয়ে সৃষ্টি হয় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার।

যে দলেরই হোক না কেন; ক্ষমতার পালাবদলে মিডিয়ার মালিক বনে গেছেন অনেকেই। একজন সাংবাদিক বলেছেন, ‘টুকরি করে ফেরিওয়ালার মত টিভি চ্যানেল দিচ্ছে সরকার’। তার এই মতামতটির গুরুত্ব অনেক গভীর। শুধু যুদ্ধাপরাধী নয়; ভূমি ধস্যুতা, শেয়ার মানি লুণ্ঠন’সহ নানা অভিযোগও আছে এসব মিডিয়া মোঘলদের বিরুদ্ধে। বেকার জীবনের অবসানে সংবাদকর্মীরা কামলা খাটছেন কেবল। কাজ করছেন মোঘলদের ইচ্ছে পূরণে।

মিডিয়া বিজ্ঞাপন নির্ভর। ব্যবসা এবং ক্ষমতার একটা বড় মাধ্যমও বটে। সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও টিভি স্টেশনের বিশেষ কিছু ইস্যুতে নিজস্ব মতামত থাকতে পারে। সেটা কর্তৃপক্ষ তার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী কিংবা সংবাদকর্মীর মাধ্যমে তুলে ধরারও নজিরও আছে। দেশের সবক’টি মিডিয়ায় সম্পাদনা পরিষদ এবং মালিক পক্ষের মতামতের উপর ভিত্তি করেই সংবাদ সংগ্রহ ও সম্প্রচার প্রচলিত ধারারই অংশ।

আমাদের স্বাধীন দেশের গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করছে কিনা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রশ্ন হচ্ছে সাংবাদিকরা কি আসলেই জাতির বিবেক? নাকি এটা কথার কথা;যা প্রবাদেই সীমাবদ্ধ। সাংবাদিকতা এখন পূঁজিবাদের দখলে। পেশাগত দায়িত্ব পালনে নিজের বিবেক এবং জাতীয় স্বার্থ বড় নয়। যদি তাই হতো; তাহলে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি’সহ অগনিত সাংবাদিকের জীবন বৃথা যেতো না। চ্যানেলের মালিকদের স্বার্থরক্ষাই প্রধান লক্ষ সাংবাদিকদের। জার্নালিজম ইথিকস কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

অষ্ট্রলিয়ার ধন্যাঢ্য ইহুদি পরিবারে জন্ম বিশ্বের প্রভাবশালী মিডিয়ার কর্ণধার ‘রবার্ট মারদুখ’। ৯০ এর দশকে যিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার রাজত্বের মোঘল ও মাহারাজা নামে পিরিচিত। সে সময়কার আন্তর্জাতিক নিউজ করপোরেশনের প্রেসিডেন্টও ছিলেন ‘রবার্ট মারদুখ’।তার একটা বিখ্যাত উক্তি ‘‘আসলো দেখলো এবং জয় করে নিল’’।

প্রসিদ্ধ এই উক্তিটির জন্য বিশ্বব্যাপী সুনামও কুড়িছেন তিনি। মিডিয়া আগ্রাসন কাকে বলে ‘রবার্ট মারদুখ’ তার এক অন্যন্য উদাহরণ। যার নিয়ন্ত্রনে ছিলো প্রায় চল্লিশ হাজারের বেশী সংবাদকর্মী, কর্মকর্তা ও কর্মচারি। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়া’সহ চারটি মহাদেশের মিডিয়ার রাজত্ব ছিল তাঁর দখলে। লন্ডন ও সানডে টাইমস, সানবার্ট, স্কাই টেলিভিশন, স্টার টিভি’সহ প্রায় ১শ ২৫টি দৈনিকের মালিক ছিলেন তিনি।

‘আর এই মিডিয়ার সৃষ্টি ছিলো বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন’। শুরুর দিকে দেশব্যাপী স্বতস্ফূর্ত এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে; অবশেষে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। কিন্তু পরে তা থেকে সরে যায় দলটি। এটাও কি রাজনীতি? নব্বইয়ের শুরুতে আরম্ভ হওয়া আইনের শাসনের সংগ্রাম ভেস্তে গেছে একবিংশ শতাব্দির দুয়ারে এসে। ওয়ান-ইলেভেনের পটভুমি আইন ও বিচার বিভাগ তথাপি সংবিধানকে তোয়াক্কা করেনি।

কর্তৃপক্ষীয়, চাপানো শাসন প্রতিষ্ঠায় শুকনো বুলি রঙ ছড়াতো প্রচার মাধ্যমের বদৌলতে। বলা হতো আইন তার নিজের গতিতেই চলবে! এখন দেখছি খোদ ‘আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল’-এর আদেশ মানা হচ্ছে না। আইনের শাসনের জন্য লজ্জার কথা। নাকি রীতিমতো আদালত অবমাননা? প্রতিনিয়তই হাইকোর্টের হাইথট-ওয়ালাসব রুল জারি প্রচার হতো গণমাধ্যমে।

এফএম রেডিওতে কীভাবে বাংলা বলা হবে, স্বাধীনতার ঘোষক কে, প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে উপন্যাস লিখবেন ইত্যাদি। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে শাহবাগের গণজোয়ারে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং মিতিঝিলে অপারেশন ফ্লাস আউট বিষয়ে সেই উচ্চ আদালত ছিলো দর্শকের ভূমিকায়। দেশ ও জাতির প্রত্যাশা-প্রাপ্তিতে আইনের শাসন তাহলে কোন দিকে যাচ্ছে?

দেশের সংবিধানেও আনা হয়েছে পরিবর্তন। ক্ষমতায় টিকে থাকতে স্বাধীনতার পর প্রায় প্রতিটি সরকারই সংবিধানে হাত দিয়েছেন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। নির্বাচিত মেয়ররা পদত্যাগ করে নির্বাচন করলেও সংসদ সদস্যরা নির্বাচন করবেন পদে থেকেই। শুধু তাই নয় নির্বাচনে পরাজিত হলেও সংসদের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল থাকবেন। ফলে একই সাথে দু'জন সংসদ সদস্যকে দেখা যাবে।

এদের একজন নব-নির্বাচিত, অন্যজন বিদায়ী। নব-নির্বাচিতরা বিদায়ী সংসদ সদস্যের মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত শপথের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এটি বর্তমান সংবিধানেরই বিধান। এখন অনেকেই বলছেন, ‌‘‘বর্তমান সরকার সব অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। গণতন্ত্র/বাক-সস্বাধীনতা হরণ করে পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ কি ক্ষমতায় টিকে ছিলো? এমন নজির খুবই কম। সংসদ নির্বচানের আগেই দেশের বেশীরভাগ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনেক কিছুই ঘটে যাবে। হেফাজত ইস্যুতে সরকার সাময়িক টিকেছিলো হয়তো; কিন্তু মতিঝিলের সেই কালোরাতের ঘটনায় মূল্য আওয়ামী লীগকে আজীবন দিতে হবে। ইতোমধ্যে সিলেট'সহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছে। সরকার দলের ভালো এবং ধর্মভীরু প্রার্থীরাও নির্বাচনী প্রচারণায় সাধারণ মানুষের তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে’’।

যে কোন ইস্যুতেই নিজস্ব মতামতের স্বাধীনতা থাকতে পারে। কিন্তু সেটা কেন হবে দেশ ও জাতির ক্ষতি করে? এটা কি আমাদের ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের ফসল..? এখনো যে দেশে মেহেদীর রঙ না মুছতেই গলায় ফাঁস, এসিডদ্বগ্ধ রমনি, বুলেটবিদ্ধ যুবক, খুন-ধর্ষণ, দূর্নীতি নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা।

সেই সাথে ক্ষমতার পালাবদলে আইন ও বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তন। জাতি হিসেবে এসব কি আমাদের প্রত্যাশা ছিলো..? পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির নেই যে, ভিন্নমতের গণমাধ্যম বন্ধ করলেই দেশের স্বাধীনতা সুরক্ষিত থাকবে। ২০ কোটি মানুষ কিন্তু গুটি কয়েকজনে’র ইচ্ছের কাছে জিম্নি থাকতে পারে না।

আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা দেশটা কাউকে লিজ দিয়েও যায়নি। ভিন্নমতকে না মানতে পারাটাও ব্যর্থতা। এসব চলতে থাকলে জাতি বিভক্ত হয়ে পড়বে এবং পড়েছেও। তা থেকে কেউই রেহাই পাবে না। রক্তের বিনিময়ে অর্জন আরো বিনষ্ট হয়ে পড়বে। আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক ঐতিহ্যকে ধংসের হাত থেকে বাঁচাতেই ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। সামন্তবাদী পাকিস্তানের উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়েছি হিন্দুস্থানের আর্যবাদীদের তাবেদারী করার জন্য নয়। তাদের নোংরা সংস্কৃতিতে বিলীন হওয়ার জন্য নয়।

বাংলাদেশের অস্তিত্বে দ্বিমত যাদের; তাদের অস্তিত্ব বিলীন হোক। কিন্তু যখন দাড়ি-টুপি ধরে টানাটানি করা, বিজাতীয় সংস্কৃতির ফসল। তখন জতি কি বিপথগামী নয়? রাম-বাম তথা পরিমলীয় ঐতিহ্য চাপিয়ে দিয়ে দেশীয় ভিন্নমত কিংবা স্বাধীনচেতা গণমাধ্যম বন্ধ কাম্য নয়। হিন্দী সংস্কৃতির আগ্রাসী চ্যানেল চালু রেখে তা কি সম্ভব? বাঙালী স্বাধীন জাতি। তারা চাপানো শ্লোগানকে মানতে বাধ্য নয়। দলমত নির্বিশেষে সবার গণতান্ত্রিক আচরণই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলকর।

E-mail: siblichowdhury@hotmail.com,

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন