রবিবার, ২ জুন, ২০১৩

দেশপ্রেম আর তারুণ্যের আবেগের গণজারণে মহৎ কিছু হবেই

আলোর পথে যাত্রা
এক গণজাগরণ মঞ্চ কর্মীর ভাবনা
 
বাপ্পাদিত্য বসু
মুজিবনগর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। ৩১ মে গণজাগরণ মঞ্চ মুজিবনগর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। খুলনা বিভাগ সফররত প্রতিনিধি দল এদিন দুপুরে যায় সেখানে। আমাদের সাথে ছিলেন মেহেরপুর গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক নিশান সাবের, সংগঠকবৃন্দ, মুজিবনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কামরুল হাসান চাঁদু, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি রোকনুজ্জামান প্রমুখ। সেখানে যখন শ্রদ্ধা নিবেদন করছিলাম, গায়ের লোম কাঁটা দিয়ে উঠছিল। শহীদদের স্মরণে আমরা এক মিনিট নিরবতা পালন করলাম। তারপর গগণবিদারী স্লোগান দিলাম- ‘জয় বাংলা’।


তারপর ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো কমপ্লেক্সটি। পরে গণপূর্ত বিভাগের রেস্ট হাউজে বসে মুজিবনগর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কামরুল হাসান চাঁদু আমাদের অনেক লিচু খাওয়ালেন। পরে চা-বিস্কুট। মেহেরপুরে ফেরার পথে দারিরামপুরে জাহিদ হাসান রাজিব নামে এক ইতিহাসপ্রেমীর আলোকচিত্র সংগ্রহশালা দেখলাম। তার কাছে কিছুসময় আরো থাকতে পারলে খুব ভাল লাগত। কিন্তু পারিনি বলে দুঃখ প্রকাশ করছি।

তবে জাহিদ হাসান রাজিব আমাদের গাড়িতে তুলে দিলেন একগুচ্ছ লিচু। পথে খেতে খেতে চলে এলাম মেহেরপুর। সেখানে এসে মেহেরপুরের বন্ধুরা আমাদের ভাত খাওয়ালেন। খাওয়ার পরে আমরা নিয়ে নিলাম মেহেরপুরের বিখ্যাত মিষ্টি ‘সাবিত্রী’। অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী এ মিষ্টির স্বাদ। সেই স্বাদ মুখে লাগিয়েই আমরা চলে এলাম কুষ্টিয়া। পথিমধ্যে বামুন্দী বাজারে আমাদের সাথে দেখা করল ছাত্র মৈত্রীর স্থানীয় সভাপতি মনিরুজ্জামান। সে তো আবার আমাদের গাড়িতে তুলে দিল কোমল পানীয়।

এর আগে আজ সকালে আমরা চুয়াডাঙ্গা থেকে রওনা হয়ে এলাম মেহেরপুরে। চুয়াডাঙ্গা গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম মালিকসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ আমাদের সকালের নাস্তা করিয়ে তবে বিদায় জানালেন। বড় বড় রসগোল্লার চারটি খেয়ে নিলাম আমি। বাঁধন মুন্সী আবার কিনে নিল চুয়াডাঙ্গার বিখ্যাত চানাচুর।

মেহেরপুরে গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিনিধি সভা অনুষ্ঠিত হলো শিল্পকলা একাডেমীর মিলনায়তনে। জেলা সমন্বয়ক নিশান সাবের এর সভাপতিত্বে ও সাবেক ছাত্র মৈত্রী নেতা মাহবুবুল হক মন্টুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ সভায় কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু, ছাত্র আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মঞ্জুর রহমান মিঠু, অনলাইন এক্টিভিস্ট মাহমুদুল হক মুন্সী বাঁধন এবং মিজানুর রহমান।

কুষ্টিয়ায় পৌঁছাতে আমরা একটু দেরি করে ফেললাম। জেলা শিল্পকলা একাডেমী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হলো এখানকার প্রতিনিধি সভা। গণজাগরণ মঞ্চের জেলা সমন্বয়ক ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক অসিত সিংহ রায়ের সঞ্চালনায় এ প্রতিনিধি সভায় কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের মধ্যে বক্তব্য রাখলেন ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসু (এখানেও আমার বক্তব্য রাখার কথা ছিল না, কিন্তু স্থানীয় সংগঠকদের জোরাজুরিতেই বললাম), ছাত্র ইউনিয়নের সহ সভাপতি কামরুস সালাম সংসদ, ছাত্র সমিতির আহ্বায়ক জাহিদুর রহমান খান, ছাত্র ফ্রন্টের কেন্দ্রীয় সদস্য রাশিব রহমান, অনলাইন এক্টিভিস্ট মাহমুদুল হক মুন্সী বাঁধন এবং পিকলু চৌধুরী। পিকলু এর আগে কোনোদিন বক্তব্য দেয় নি। সফরের সারা রাস্তা সে কোথাও বক্তব্য দিতে চায় নি। কিন্তু আমাদের চাপের মুখে এখানে প্রারম্ভিক বক্তব্য দিল এবং বেশ ভালোই বলল। নিশ্চয়ই ওর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে এতে। কুষ্টিয়ায় ছাত্র ফ্রন্টের নেত্রী শ্যামা। দারুণ স্লোগান দেয়। আমরা সবাই উজ্জীবিত হলাম ওর স্লোগানে।

কুষ্টিয়াতেই আমাদের রাতে থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু আমরা সবাই আবার ঝিনাইদহে গেলাম। সেখানে সংগঠকদের সাথে একটি আলাদা বৈঠক করলাম। নিশ্চয়ই এ বৈঠকটিও সফল হয়েছে। যাবার পথে শেখপাড়া বাজারে গাড়ি থামালাম। ছাত্র মৈত্রীর কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি ইউনুস আলী আমাদের মিষ্টি কিনে দিল। এতো মিষ্টি আমরা খাব কিভাবে? ঝিনাইদহের বৈঠক শেষে সেখানকার সংগঠকরা আমাদের ভাত খাইয়ে তবে বিদায় দিলেন। আমরা আবারো কুষ্টিয়া চলে এলাম। মজমপুর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বেশ রাতে আমরা কফি পান করলাম। আমি আর বাঁধন দেশসেরা কুষ্টিয়ার গামছা কিনলাম। রাতে ঘুমালাম শিল্পকলা একাডেমীর গেস্ট হাউসে। মোরসালিন মিজান আমাদের সাথে ঝিনাইদহে যায় নি। সে আমাদের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে একাই লালন সাঁইয়ের ছেঁউরিয়া ঘুরে এলা। আমরা গেস্ট হাউসে এসে দেখি ঐ রাত একটার দিকেও স্থানীয় সংস্কৃতিকর্মী ও আন্দোলনের সংগঠক তানজিদ বসে আছে আমাদের অপেক্ষায়। আমাদের ঘুমানোর সব বন্দোবস্ত করে দিয়ে তবে সে বাড়ি গেল। ছেলেটা এতো কষ্ট করেছে! সকালে আবার আমাদের সবার ঘুম থেকে ওঠার আগেই তানজিদ এসে হাজির। আমাদের নাস্তা করিয়ে, চা খাইয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তবেই ওর ছুটি। এই আন্দোলন আমাদের এত্তো ভালবাসা দিয়েছে। এর মর্যাদা লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েই দিতে হবে। গাড়িতে ওঠার আগেই জেলা সমন্বয়ক আমিরুল ইসলাম হাজির। আমাদের বিদায় দিলেন বুকে আলিঙ্গন করে।

এখান থেকে আমাদের ফাঁকি দিয়ে থেকে গেল কামরুস সালাম সংসদ। ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক কাজে বাগেরহাট যাবে ও। আগের দিন রাতে কুষ্টিয়ার কর্মসূচি শেষে দলছুট হলো রাশিব রহমান। আর ঝিনাইদহের বিশেষ বৈঠকের পর ছুটে গেল জাহিদুর রহমান খান। আমরা বাকি থাকলাম আট জন।

আমরা এবার ছুটলাম ঢাকার পথে। পথিমধ্যে রাজবাড়ী। শংকর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের চমচম। একি ফেলে আসা যায়! না। তাই আমরা যাত্রাবিরতি দিলাম রাজবাড়ীতে। জেলা ওয়ার্কার্স পার্টি কার্যালয়ে বসলাম। পার্টির নেতৃবৃন্দ আমাদের আমাদের শংকরের চমচম দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সাথে সন্দেশ ও সিঙ্গাড়া পেলাম বোনাস। ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা জ্যোতিশংকর ঝণ্টু, জেলা নেতা রেজাউল করিম রেজা, মওলা বক্স, শাহাদাৎ হোসেন, যুব মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব রায়, ছাত্র মৈত্রীর নেতা গোলাম রসুল রানা, চন্দন, এজাজসহ অনেকেই ছিলেন। তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

পদ্মা। পাড়ি দিলাম ফেরিতে। সবাই মিলে আমরা চা খেলেও বাঁধন ঘুমের মায়া ত্যাগ করতে পারল না। তাই সে গাড়িতেই বসে ঘুমালো। ফেরি পার হয়ে আবার ছুট। ঢাকার কাছাকাছি এসে একটি রেস্তোরাঁয় বসে খেয়ে ঢুকলাম আবারো প্রিয় নগরীর বুকে। দীর্ঘ যানজটের পালা অতিক্রম করে চলে এলাম শাহবাগে। আমাদের কাছে থেকে যাওয়া দুই কেজি মিষ্টি সবাইকে নিয়ে ভাগ করে খেলাম। এবার প্রস্তুতি নিতে হবে অন্য কোনো অঞ্চলের, আরো কিছু জেলায় যাওয়ার। কেন্দ্রীয় সংগঠকরা প্রস্তুত হোন। প্রস্তুত হোন জেলা সংগঠকরাও। বিজয় অর্জন ছাড়া আমাদের এই লড়াইয়ে কোনো বিরতি নেই। নেই কোনো ক্লান্তির অবকাশ।

আমাদের এই পুরো সফরে একজন সঙ্গীর কথা বলাই হয় নি। আকরাম ভাই। আমাদের মাইক্রোবাসের চালক। খুবই ভালো চালান তিনি। সাথে সাথে দারুণ আন্তরিক মানুষ। একটু পান বেশি খান আর কি! আমার একটি ব্যক্তিগত দায় রয়ে গেছে আকরাম ভাইয়ের প্রতি। কুষ্টিয়া থেকে গামছা কিনলাম। আকরাম ভাই একটি গামছা চেয়েছিলেন। আমার দেওয়া হয় নি। আকরাম ভাই, আপনার ফোন নম্বরটি আমার কাছে আছে, আমি কুষ্টিয়া থেকে গামছা আনিয়ে আপনাকে পৌঁছে দেব ঠিকই।

আমাদের দলে শুরুতে ছিলাম দশ জন। পথিমধ্যে মাগুরায় একজন যুক্ত হলো আর চুয়াডাঙ্গা থেকে ঘাটে ঘাটে একেক জন করে থেকে গেল। পুরো দলটিই ছিল দারুণ। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা আর লড়াইয়ের মন্ত্রে দীক্ষিত। শুধু এই দলটিই কেন, সারা বাংলাদেশে গণজাগরণ মঞ্চের যোদ্ধারাই তো এমন। এই যোদ্ধারাই এবারের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় এনে দেবে। জানি না যুদ্ধেও নানা বাঁকে এদের কাকে হারাব। কারণ জীবন তো কাওকে না কাওকে দিতেই হবে। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি দেশের মুক্তির জন্য যদি একজনকেও প্রাণ দিতে হয়, তিনি যেন এই উচ্ছ্বল তরুণগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে আমাকে নিয়ে যান।
জানি, সুড়ঙ্গের শেষ মাথাটা এখনো রুদ্ধ। তবে এও জানি ওপারে আলো আছে। এখন কাজ হলো ঐ শেষ মাথা খুঁজে বের করে আলোর পথে যাত্রা। জানি, সে পথ আমাদের। জানি, বিজয় আমাদের হবেই। জানি, ভবিষ্যৎটা আমাদেরই। জয় বাংলা।

লেখক: বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন