রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফাঃ একুশ শতকে এ দাবি সমর্থনযোগ্য নয়

আবদুল বাছির, মো. নূরুজ্জামান, সৌরভ সিকদার, মামুন আল মোস্তফা, শিশির ভট্টাচার্য্য, মাহবুব আহসান খান, শান্তনু মজুমদার, সাবরিনা সুলতানা চৌধুরী, আকসাদুল আলম, হাকিম আরিফ, ফাহমিদুল হক ও রোবায়েত ফেরদৌস | প্রথম আলো, তারিখ: ২১-০৪-২০১৩
 ভুলে গেলে ভুল হবে যে বাংলাদেশ কেবল বাঙালি আর মুসলমানের রাষ্ট্র নয়; বাংলাদেশ একটি বহু জাতি, বহু ধর্ম, বহু ভাষা ও বহু সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ রাষ্ট্র। এই বহুত্ববাদী দর্শনই আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার মূল নীতি এবং এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এক ধর্মের রাষ্ট্র নির্মাণের চেষ্টা কিংবা একক জাতীয়তাবাদের দেমাগ, ইতিহাস বলে, অতীতে কেবল বহু সমস্যাই পয়দা করেছে, কোনো সমাধান বাতলাতে পারেনি। আধুনিক রাষ্ট্রপরিচালনার এই দর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান লেখায় আমরা হেফাজতে ইসলামের প্রস্তাবিত ১৩ দফা দাবি খতিয়ে দেখার প্রয়াস পেয়েছি; পাশাপাশি দাবিগুলো পূরণ করা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে কতটা সম্ভব হবে, তা বিচার করার চেষ্টা করেছি।

দফা-১: সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনঃস্থাপন এবং কোরআন ও সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করতে হবে।
জবাব: প্রথমত, বিশেষ একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা বা বিশেষ একটি ধর্মের সৃষ্টিকর্তার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপনের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সিদ্ধান্ত জাতি-ধর্মনির্বিশেষে লাখো শহীদের আত্মদান ও নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল চরিত্রের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। গণতন্ত্র অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, কিন্তু রাষ্ট্র কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের কোম্পানি আইন, ব্যাংক আইন, হিন্দু আইনসহ অন্য যেসব আইন কোরআন ও সুন্নাহসম্মত নয়, সেগুলো কি বাতিল করতে হবে?
দফা-২: আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
জবাব: ইসলামের অবমাননার কারণ নিয়ে স্থান-কাল-মাজহাব ভেদে মুসলমানদের মধ্যেই মতপার্থক্য রয়েছে। কোনো একজন মুসলমানের দুর্নীতির সমালোচনাও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। পাকিস্তান রাষ্ট্রে এ রকম সামান্য অপরাধে ব্লাসফেমির মামলা হয়েছে বলে দৃষ্টান্ত আছে। ব্লাসফেমির অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচারকালেই কারাগারে অন্য বন্দীদের হাতে নিহত হয়েছেন, এমন ঘটনাও ঘটেছে।
দফা-৩: কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
জবাব: শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ধর্মের অবমাননা করে কোনো স্লোগানই দেওয়া হয়নি এবং এর কোনো নেতা নিজেকে ঘোষণা করেননি যে তিনি নাস্তিক। মঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তি বিচ্ছিন্নভাবে তার ব্লগে ইসলাম সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য লিখে থাকলে সে অপরাধের বিচার অবশ্যই হতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ব্লগারদের সবাই সেই একক ব্যক্তির অপকর্মের জন্য দায়ী হবে।
দফা-৪: ব্যক্তি ও বাক্স্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
জবাব: অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের ‘অবাধ বিচরণ’ আর ‘বিজাতীয় সংস্কৃতি’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। সংস্কৃতি স্বতঃপরিবর্তনশীল। কমবেশি হাজার বছর আগে বাংলাদেশের জনগণ যোজন দূরের আরব দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। এককালের বিজাতীয় সংস্কৃতি, যেমন টেলিভিশন বা রেডিও বর্তমানকালে অন্যতম জাতীয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে খ্রিষ্টান, হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের ধর্মকর্মে মোমবাতি প্রজ্বালন করে থাকেন, মাজারে প্রজ্বালিত হয় আগরবাতি ও মোমবাতি। এই বিশ্বায়নের যুগে কোনো সরকারের পক্ষে সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ রোধ করা কি আদৌ সম্ভব?
দফা-৫: ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
জবাব: এ কথা ঠিক যে, স্কুল-কলেজে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা দেওয়া হলে মাদ্রাসা থেকে পাস করা ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান সহজ হয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শিক্ষাকে অবশ্যই ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে, কারণ রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের লোক বসবাস করে। রাষ্ট্রকে নারী আর পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতেই হবে। বাংলাদেশের যে বিপুলসংখ্যক নারী উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে চলেছে, তাদের ঘরের চার দেয়ালে বন্দী করে রাখার সাধ্য কারও নেই। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণ কী পরিমাণ বেড়েছে তা কয়েক দশকের পরিসংখ্যানের তুলনা করলেই বোঝা যাবে। নারীনীতি, শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়ে চলেছে পরোক্ষভাবে। কালের প্রবল গতি রোধ করা কোনো সরকার বা গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব হবে না।
দফা-৬: সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা, ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
জবাব: ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। সুতরাং সরকার কোনো নাগরিকের ধর্মপালনে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। সরকারকে বরং যেকোনো নাগরিকের ধর্মপালনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ‘মুসলিম’ হচ্ছেন এমন এক ব্যক্তি, যিনি মহান আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। সুতরাং কে মুসলিম আর কে মুসলিম নয়, তা নির্ধারণের দায়িত্ব একমাত্র আল্লাহর, কোনো ব্যক্তি বা সরকারের নয়।
দফা-৭: মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্য ও নানা মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
জবাব: ইসলামে উপাসনার উদ্দেশ্যে মূর্তি নির্মাণ বা চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ। ভাস্কর্য আর মূর্তির মধ্যে পার্থক্য পরিষ্কার করে বলা দরকার।
দফা-৮: জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
জবাব: এ নিয়ে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়; কিন্তু মসজিদে যখন জ্বালাও-পোড়াও চলে, মসজিদকে যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়, আপত্তির প্রশ্নটি আসে তখনই।
দফা-৯: রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
জবাব: ইসলামের নির্দিষ্ট কোনো পোশাক নেই, বিভিন্ন দেশের মুসলমান বিভিন্ন পোশাক পরেন।
দফা-১০: পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তরকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
জবাব: যাঁরাই কোনো মানুষকে অতীতে ধর্মান্তরে বাধ্য করেছেন বা এখনো করছেন, তাঁদের সবারই শাস্তি হওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার, এই বাংলা অঞ্চলে ধর্মান্তরকরণ ঐতিহাসিকভাবে কখনোই শাস্তিযোগ্য অপরাধ ছিল না।
দফা-১১: রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করতে হবে।....
দফা-১২: সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতিদানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
দফা-১৩: অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
জবাব: শুধু কওমি মাদ্রাসা নয়, যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকের ওপরই ভয়ভীতি-নির্যাতন করা অনুচিত। গ্রেপ্তারকৃতদের কেউ আদতেই বেকসুর হলে তাকে মুক্তি দেওয়া উচিত। তবে এটাও ভুলে গেলে চলবে না যে ইতিমধ্যেই বিচারের তোয়াক্কা না করে একজন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে, অন্য একজনকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ফটিকছড়িতে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। কারও অপরাধ যত গুরুতরই হোক না কেন, তাকে নির্বিচারে খুন করার বিধান শান্তির ধর্ম ইসলাম অবশ্যই দিতে পারে না। সরকারের অন্যতম ব্যর্থতা হচ্ছে, একটি হামলার তদন্ত রিপোর্টও তারা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারেনি। অন্যদিকে ব্লগারদের কারারুদ্ধ করে সরকার হঠকারিতার পরিচয় দিচ্ছে। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে ফেললে হামলাকারীরা আরও উৎসাহিত হবে।
দফাভিত্তিক বিশ্লেষণের এই পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য তাই স্পষ্ট। একুশ শতকে পুরো পৃথিবীর ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি যেভাবে পাল্টাচ্ছে, সবকিছু যে মাত্রায় নিয়ত পরিবর্তনশীল, সেই বাস্তবতায় হেফাজতে ইসলামের দাবিসমূহ মেনে নেওয়া মানে রাষ্ট্রকে এক ধাক্কায় মধ্যযুগে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি সেই মধ্যযুগেই ফিরে যাব? যাওয়া কি আদৌ সম্ভব, না যাওয়া উচিত?
লেখকেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন