রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ কর, হেফাজতের শফির ফাঁসি চাই

০ চট্টগ্রামে স্মরণকালের বৃহত্তম সুন্নি সমাবেশ
০ ২৫ মে ঢাকায় মহাসমাবেশ
স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে লাখো ধর্মপ্রাণ মানুষের মহাসমুদ্র প্রমাণ করেছে এদেশ কখনই পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো জঙ্গীবাদী রাষ্ট্র হবে না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের আহ্বানে সুন্নি জনতার এ সমাবেশ থেকে দাবি ওঠে- ইসলামের নবীর অবমাননা-কারীদের সর্বোচ্চ শাস্তির পাশাপাশি ‘জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করতে হবে। রুখতে হবে জামায়াত-হেফাজতীদের। গগনবিদারী স্লোগান ছিল- ‘জামায়াত-শিবিরের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও। স্বাধীনতাবিরোধী ও জঙ্গীদের রুখতে হবে- রুখে দাও।’ সমাবেশ থেকে আহলে সুন্নাত নেতারা হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা আহমেদ শফিকে ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারও ফাঁসি দাবি করেন। নেতৃবৃন্দ দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘ইসলাম জঙ্গীবাদী ও সন্ত্রাসী ধর্ম নয়।
মওদুদীবাদী-ওহাবীদের বিরুদ্ধে সুন্নি জনতা জেগে উঠেছে। এ সুিন্ন জনতাকে যারা সমর্থন করবেন তারাই আগামী দিনে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবে। সমাবেশ থেকে আগামী ২৫ মে রাজধানীতে সুন্নি জনতার মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়ে বক্তারা বলেন, ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্টা এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ রুখে দেবে। সমাবেশে ১২ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে ধর্মের অবমাননা বন্ধ করা, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে সরকার ও বিরোধী দলের সংলাপ, হরতাল বন্ধে জাতীয় সংসদে আইন পাস, নারীনীতি থেকে কোরান সুন্নাহ বিরোধী অংশ বিশেষ বাতিল করা ইত্যাদি।
শনিবার ঐতিহাসিক লালদীঘি ময়দানের এই সুন্নি মহাসমাবেশকে ঘিরে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ছিল ব্যাপক আগ্রহ। হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া আহলে সুন্নাতের আহ্বানে এ সমাবেশে যোগ দেয় লাখ লাখ সুন্নি জনতা। বিকেল ৩টা থেকে সমাবেশের ঘোষণা থাকলেও দুপুরের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় লালদীঘি ময়দান। এরপরও একের পর এক আসতে থাকে বড় বড় মিছিল। ফলে বিপুলসংখ্যক জনতাকে থেমে যেতে হয় কেসি দে রোডের মুখ, আন্দরকিল্লা, কোতোয়ালি ও জেল রোডে। ফলে বিরাট একটি এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। চট্টগ্রামে ধর্মপ্রাণ মানুষের এত বড় জমায়েত স্মরণকালে আর হয়নি।
সুিন্ন মহাসমাবেশে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য, ষোলশহর জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও চট্টগ্রামের জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা আল্লামা জালাল উদ্দিন আল কাদেরী বলেন, ধর্মের নামে যারা এদেশের সহজ সরল মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা ইমানি দায়িত্ব। ধর্মপ্রাণ জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, তাদের ধোঁকা থেকে আপনারা নিজের ইমানকে রক্ষা করুন। ইসলাম ধর্ম কোন হামলা ও হত্যাকে সমর্থন করে না। যারা লাঠি হাতে মসজিদে প্রবেশ করে, মসজিদের জায়নামাজ পোড়ায় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে হবে। আহলে সুন্নাত একটি শক্তি। দেশের সুন্নি জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এ শক্তিকে যারা সমর্থন করবেন তারাই ক্ষমতায় যেতে পারবেন।
মহাসমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও আহলে সুন্নাতের কেন্দ্রীয় নেতা এমএ মতিন বলেন, ব্লগারদের মধ্যে যারা নাস্তিক আছে আমরা তাদের শাস্তি চাই। কিন্তু এ নাস্তিক্যবাদীর বিরোধিতার নামে যে জঙ্গীবাদরা মাঠে নেমেছে তারা ইসলাম ও দেশের দুশমন। হেফাজত ইসলাম ও জামায়াত ইসলাম যেভাবে মানুষ হত্যা ও জানমালের ক্ষতি সাধন করছে তা আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগকে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা সুন্নি মুসলমানরা এদেশকে জঙ্গীবাদী পাকিস্তান ও আফগানিস্তান হতে দেব না। হরতালের নামে দেশে নৈরাজ্য ও তা-ব চলছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদেশের মানুষ আর এ ধরনের ধ্বংসাত্মক হরতাল করতে দেবে না। আইনের মাধ্যমে এদেশে হরতালকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তিনি তিনটি মহাসমাবেশের ঘোষণা দেন। সে অনুযায়ী আগামী ২৫ মে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হবে সুন্নি মহাসমাবেশ। এর আগে ২৭ এপ্রিল হবিগঞ্জে এবং ১১ মে নারায়ণগঞ্জে সুন্নি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা’আতের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুফতি ওবায়দুল হক নঈমী বলেন, ইসলাম রক্ষার নামে হেফাজতীরা মানুষ হত্যায় নেমেছে। আমরা নাস্তিক্যবাদের যেমন বিরুদ্ধে তেমনিভাবে ওহাবীবাদ ও মওদুদীবাদেরও বিরুদ্ধে। কারণ তারা ইসলামের শত্রু“। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে এ হেফাজত ইসলাম নেতারাই মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতায় নেমেছিল। ধর্মের নামে তারা এদেশের মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করেছে। এ স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার করতে হবে।
শায়খুল হাদীস মাওলানা কাজী মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন আশরাফী হেফাজত ইসলাম আমির আল্লামা শফিকে নবী বিরোধী আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এই শফি আমাদের নবী করিমকে (স) সাধারণ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বলেছেন আল্লাহ মিথ্যা কথা বলতে পারেন।’ তিনি হেফাজত নেতা আল্লামা শফির বিচার দাবি করেন।
শাহজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ আল হাছানী আল মাইজভান্ডারী বলেন, যাদের ইমান আছে তারা কখনই দেশ ও দেশের আইনের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। ইসলাম ধর্ম মানবতা ও দেশপ্রেমের শিক্ষা দেয়। তিনি বলেন, হেফাজত ইসলামে অনেক লোকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে- যারা আফগানিস্তান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। কিন্তু এতে সুন্নি জনতা ভিত নয়। কারণ এদেশে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও ট্রেনিং জমা দেননি।
তরিকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী তাঁর বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধের জন্য জামায়াত ইসলামের শাস্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, ওহাবীদের পরিচালিত কওমী মাদ্রাসাগুলো থেকে জঙ্গীবাদ প্রচারিত হচ্ছে। আল্লাহর নবী ও অলির শানে যারা আঘাত করতে চায় তাদের প্রতিহত করা হবে। যে আলেমদের বিরুদ্ধে জামায়াতীরা মৃত্যু পরোয়ানা দিয়েছে তাদের গায়ে আঘাত আসলে সুুন্নি জনতা বসে থাকবে না। তিনি হেফাজতের লং মার্চ বন্ধ করতে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও কিছু নেতার নেগোসিয়েশন প্রচেষ্টার সমালোচনা করেন।
আহলে সুন্নাত প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুস সামাদ বলেন, এদেশে জঙ্গীবাদের স্থান হবে না। হেফাজতে ইসলাম আসলে হেফাজতে ইসলাম নয়, তারা খেয়ানত ইসলাম। ওহাবী মাদ্রাসায় জঙ্গীরা ট্রেনিং নিচ্ছে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি হিসেবে। তবলীগ জামায়াতের নামে পৃথিবীর কিছু দেশ থেকে বাংলাদেশে জঙ্গী অনুপ্রবেশ ঘটছে বলে উল্লেখ করে তিনি তবলীগের ওপর সরকারী নজরদারির দাবি জানান।
আবুল কাশেম ফজলুল হক তাঁর বক্তব্যে বলেন, হেফাজত আমির আল্লামা শফি আমাদের নবীকে সাধারণ মানুষ হিসেবে উল্লেখ করে অপমান করেছেন। তার শাস্তি হতে হবে। কওমী মাদ্রাসাগুলোতে জঙ্গীবাদ তৈরি হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি এ সকল মাদ্রাসায় সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ করার আহ্বান জানান। সাধারণ জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এদের ফেতরা, জাকাত ও কোরবানির চামড়া দেবেন না।
আল্লামা আশরাফুজ্জামান কাদেরী বলেন, যাদের নাস্তিক ব্লগার বলা হচ্ছে তাদের সৃষ্টি হয়েছে ইসলামের মওদুদীবাদী ও হেফাজতী ব্যাখ্যার কারণে। তরুণরা হেফাজত আমিরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও আল্লামা শফি রাজি হননি। এর কারণ আল্লামা শফি জানতে চাইলে তরুণরা জবাব দিত ‘আমাদের এ বেয়াদবি আপনারা শিখিয়েছেন।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন মাওলানা আবুল কাশেম নুরী, শাহজাদা সৈয়দ তাহসিন আহমেদ, সোবহানিয়া আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা হারুনুর রশীদ, হযরত মাওলানা আবদুল মান্নান, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, কাজী মোঃ সোলায়মান চৌধুরী, ইসলামী ছাত্র সেনার সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক চিশতী এবং দেশের বিভিন্ন সুন্নি মাদ্রাসা ও সুন্নি আকিদায় বিশ্বাসী মাজার, দরবার এবং সংস্থার প্রতিনিধিরা।
লালদীঘি মাঠের সুন্নি মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে শনিবার চট্টগ্রাম পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। বিভিন্ন জেলা থেকে শত শত গাড়িযোগে সুন্নি আকিদায় বিশ্বাসী মানুষ চট্টগ্রাম শহরে আসে। অনতি দূরে গাড়ি রেখে তারা মিছিল সহকারে যোগ দেয় মহাসমাবেশে। তাদের মুখে স্লোগান ছিল- ‘জামায়াত শিবিরের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, হেফাজতের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও, আল্লামা শফির গালে গালে জুতা মারো তালে তালে, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই- ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি সেøাগান।
আহলে সুন্নাতের ১২ দফা ॥ ১। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার করে বিভিন্ন ফেসবুক এবং ব্লগসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্নভাবে আল্লাহ রসূল এবং ইসলাম অবমাননাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে সংসদে বিদ্যমান আইন সংস্কার করতে হবে। অভিযুক্তদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অবিলম্বে দোষী ব্লগারদের গ্রেফতার করতে হবে। ২। সংবিধানে সর্ব শক্তিমান আল্লাহর একত্ববাদের ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংযোজন করতে হবে। ৩। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট উত্তরণে সরকারী ও বিরোধী দলকে উদ্যোগ নিতে হবে। ৪। ধ্বংসাত্মক ও নৈরাজ্যকর হরতাল বন্ধে সংসদে আইন পাস করতে হবে। ৫। নারীনীতি থেকে কোরান সুন্নাহবিরোধী অংশ বিশেষ বাদ দিতে হবে। ৬। জঙ্গী প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ওহাবীবাদী কওমী মাদ্রাসাসমূহকে সরকারী সিলেবাসের আওতাভুক্ত করে অভিন্ন মাদ্রাসা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে হবে। ৭। ইসলামের নামে চলমান হেফাজত-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক নৈরাজ্যকর কর্মকা- কঠোর হস্তে দমন করতে হবে। ৮। তবলীগ জামায়াতের আড়ালে জঙ্গীবাদী বিদেশী তালেবান গোষ্ঠী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারীদের ওপর নজরদারি রাখতে হবে। ৯। নাস্তিক্যবাদ ও জঙ্গীবাদ প্রজনন নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সমূহে ইসলামী শিক্ষাদানে উপযুক্ত কামিল/ফাজিল পাস শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। ১০। নাস্তিক, মওদুদী, ওহাবী, কাদিয়ানিসহ সব ভ্রান্ত মতবাদের ইসলাম অবমাননাকর প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। ১১। মিয়ানমারসহ বিশ্বের দেশে দেশে ইসলাম ও মুসলিমদের ওপর চলমান সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে জাতিসংঘ ও মুসলিম নেতৃবৃন্দের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ১২। সুন্নি ওলামা মাশায়েখ এবং বিভিন্ন মাজার খানকাসমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে মিডিয়া কর্মী, পুলিশ ও নিরীহ জনতার ওপর হামলাকারীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
#
জনকণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন