সোমবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৩

কিলিং মিশনে শিবিরঃ পরিকল্পনায় জামায়াতের সঙ্গে হেফাজত আর বিএনপিও

রমেন দাশগুপ্ত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
 চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর ইউনিয়নের কাজীরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের মিছিলে সহিংস তান্ডবের পরিকল্পনা এবং হামলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছে পুলিশ। জামায়াত, বিএনপি এবং হেফাজতে ইসলামের ১২ জন মিলে মিছিলের ‍আগের দিন সন্ধ্যায় হামলার পরিকল্পনা নেয়। এদের মধ্যে ১০ জনের নেতৃত্বে ১০ টি দল ভাগ হয়ে সরাসরি হামলায় অংশ নেয়। বাকি দু’জন ছিলেন ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর কাজে।


তবে জামায়াত, বিএনপি ও হেফাজত মিলে হামলার পরিকল্পনা করলেও খুনের ঘটনা ঘটায় সরাসরি শিবিরের ক্যাডারেরা। আর হামলার পরিকল্পনায় যেসব বিএনপি নেতা অংশ নেন তারা ফটিকছড়ির সাংসদ মানবতা বিরোধী অপরাধে বন্দি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য, আদালতে আসামীর দেয়া জবানবন্দি এবং ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে পুলিশ এ পূর্ণাঙ্গ ছক উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছেন।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘হামলার পরিকল্পনা কারা করেছে, কিভাবে হামলা হয়েছে, কারা সেই হামলায় অংশ নিয়েছে তার পুরো ছক এখন আমাদের হাতে। হামলার আগে পরিকল্পনা বৈঠক আরও হয়ে থাকতে পারে। তবে আগের দিন সন্ধ্যায় কাজীরহাটে বৈঠকেই মূল পরিকল্পনা হয়।’

গত ১১ ফেব্রুয়ারি ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার কাজিরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল চলাকালে ভয়াবহ গুজব ছড়িয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়। এতে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন কর্মী নিহত হন এবং অর্ধশতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আহত হন। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এবং গুজবে বিভ্রান্ত স্থানীয় জনতা মিলে এসময় শতাধিক মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন পুড়িয়ে দেয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে পুলিশ জানতে পেরেছে, ঘটনার আগের দিন ১০ এপ্রিল সন্ধ্যায় ভুজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা শফিউল আলম নূরীর নেতৃত্বে কাজীরহাট এলাকায় একটি গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে বাগানবাজার ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ওহিদুর রহমান সওদাগর, ভুজপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য বিএনপি নেতা মো.জাহিদ ওরফে জাহিদ মেম্বার, শিবির ক্যাডার বেলাল, পারভেজ ও ফরিদ এবং হেফাজত ইসলামের পক্ষে কাজীরহাট এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার (কওমী মাদ্রাসা) শিক্ষক আজগর ছালেহসহ ১২ জন উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে শিবির ক্যাডার বেলালকে মসজিদের মাইকে উস্কানিমূলক ঘোষণা এবং শফিউল আলম ন‍ূরীকে পুলিশের বিরুদ্ধে উসকানি দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী  মিছিল ভুজপুরে ঢোকার সময় কাজীরহাট জামে মসজিদের মাইকে বেলাল ঘোষণা দেয়, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মসজিদে হামলা চালাতে এসেছে, সবাই দা, কিরিচসহ যার যা কিছু আছে তা নিয়ে বাজারে আসুন। এসময় ইউনিয়নের অধিকাংশ মসজিদ থেকে কাজীরহাট এমাদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার মুহতামিম বড় হুজুরকে ছাত্রলীগ তুলে নিয়ে যাচ্ছে বলে গুজব ছড়ানো হয়।

অন্যদিকে হামলা শুরুর পর চেয়ারম্যান শফিউল আলম নূরী এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার ভেতর মসজিদের মাইকে বারবার পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন, পুলিশ ভাইয়েরা আপনারা গুলি চালাবেন না, আপনাদের গুলিতে ইতোমধ্যে আমাদের ৫০ জন মানুষ আহত হয়েছেন, অনেকে শহীদ হয়েছেন। চেয়ারম্যানের এ ঘোষণার পর হামলাকারী গ্রামের লোকজন আরও উত্তেজিত হয়ে উঠেন।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে চেয়ারম্যান নূরী মাদ্রাসার মাইকে উসকানি দিয়েছেন। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে তিনি আমাদের বলেছেন, তিনি এলাকাবাসীকে শান্ত থাকার কথা বলেছেন।’

এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার মাইকে ঘোষণা দেয়ার বিষয়ে ওই মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা জোনায়েদ বিন জালাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘এ ধরনের কোন ঘটনা মাদ্রাসা থেকে ঘটেনি।’

সূত্র জানায়, হেফাজতের প্রতিনিধি কাজীরহাট এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার শিক্ষক আজগর ছালেহসহ বৈঠকে উপস্থিত ১০ জনের উপর দায়িত্ব পড়ে ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও পাড়া থেকে লোকজন নিয়ে ১০টি দলে ভাগ হয়ে সরাসরি হামলায় অংশ নেয়া। পুলিশ ৯টি দলে ভাগ হয়ে হামলায় অংশ নেয়ার বিষয়ে এ পর্যন্ত নিশ্চিত হয়েছে। এছাড়া আজগর ছালেহ এবং শিবির ক্যাডার পারভেজ মুঠোফোনে বিভিন্ন উসকানিমূলক ম্যাসেজ ছড়িয়ে দেন বলেও তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

মাদ্রাসা শিক্ষকের হামলা পরিকল্পনার বৈঠকে যোগদানের বিষয়টি মিথ্যা দাবি করে মুহতামিম মাওলানা জোনায়েদ বিন জামাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আজগর তো হেফাজতের কেউ না। সে কেন হেফাজতের প্রতিনিধি হয়ে বৈঠকে যাবে ? আর হেফাজতের সঙ্গে জামায়াতের কোন লিঁয়াজো নেই। ঘটনার সময় সে আমার সঙ্গে মাদ্রাসার ভেতরে ছিল, মাইকে লোকজনকে শান্ত থাকার জন্য বলেছিল।’

জোনায়েদ জানান, আজগর ছালেহ চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে কিছুদিন ভুজপুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এরপর তিনি ভুজপুরের একটি স্থানীয় পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত আছেন। মাদ্রাসায় আজগর ছালেহ পার্ট টাইম শিক্ষক হিসেবে চাকুরি করেন।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আজগর জামায়াত করে আবার হেফাজতও করে। আর ইদানিং জামায়াতের লোকজন নিজেকে হেফাজত পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।’

ঘটনার পর থেকে আজগর ছালেহ পলাতক আছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া বৈঠকে উপস্থিত থাকা শফিউল আলম নূরীসহ এ পর্যন্ত পাঁচজনকে পুলিশ আটক করতে সক্ষম হয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, হামলার জন্য সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে লেলিয়ে দেয়ার পর চিহ্নিত শিবির ক্যাডাররা অবস্থান নেয় গ্রামের ভেতরে। হামলায় মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার পর আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী গ্রামের ভেতরে আশ্রয়ের জন্য যান তাদের নৃশংসভাবে কোপাতে থাকে এসব শিবির ক্যাডার।

হামলায় আহত অনেকে আশ্রয়ের জন্য যান কাজীরহাট এলাকায় ন্যাশনাল প্রাইমারি স্কুলে। সেখানে শিবির ক্যাডার তৌফিক এবং তার ভাই মিলে কুপিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জনকে। দু’ভাইয়ের নৃশংসতার ভিডিও ফুটেজ এখন পুলিশের হাতে আছে।

সূত্র ‍জানায়, ঘটনার পর থেকে তৌফিকসহ দু’ভাই পলাতক আছে। এর মধ্যে তৌফিক বিদেশে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে।

এদিকে হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া সেকান্দর নামে এক আসামী আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়ে হামলার সঙ্গে জড়িত ১০ জনের নাম প্রকাশ করেন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দিতে সেকান্দর জানায়, সে হেফাজতের ঘাঁটি আহমদ শফীর বড় মাদ্রাসার পাশে জনৈক পেয়ারু মেম্বারের ডেকোরেশনের দোকানে কাজ করে। ঘটনার দিন সেকান্দর কাজীরহাট বাজারে ছিল। মসজিদের মাইকে হামলার কথা শোনার পর সেকান্দর রাস্তায় চলে যায়। এসময় সে নিজেও দু’টি ইট মারে মিছিলের উপর। এসময় কে বা কারা এসে তার মাথায় আঘাত করে।

উল্লেখ্য ভুজপুরে তান্ডবের ঘটনায় পুলিশের উপর হামলা এবং তিনটি হত্যাকান্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ভুজপুর থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এসব মামল‍ায় এ পর্যন্ত ৮৮ জনকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিয়েছে ‍পুলিশ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন