রবিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতের ১৩ দফা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক

নির্মূল কমিটির আলোচনা
বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ॥ হেফাজতে ইসলামীর ১৩ দফা দাবির প্রত্যেকটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের দাবি জানিয়ে তারা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছে। অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। পাশাপাশি দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত হয়ে একটি আলাদা মঞ্চ গঠন করতে হবে। পাড়ায় মহল্লায় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টিকারীদের পরাজিত করতে হবে।

শনিবার বিকেলে রাজধানীর ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘হেফাজতে ইসলামীর ১৩ দফা : সরকার ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক আলোচনাসভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। কমিটির উপদেষ্টাম-লীর সদস্য সাংবাদিক কামাল লোহানীর সভাপতিত্বে আলোচনাসভায় বক্তব্য রাখেন সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন, নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির, হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনরিটিজের সভাপতি অধ্যাপক অজয় রায়, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম, বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলনের সম্পাদকম-লীর সদস্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হারুণ হাবীব ও নির্মূল কমিটির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।
আলোচনাসভায় এ্যাডভোকেট প্রমোদ মানকিন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা হতাশ নই, কিন্তু কিছুটা আতঙ্কিত। কেননা অতীতেও যখন ধর্মের নাম নিয়ে কোন আন্দোলন শুরু হয়েছে তখনই বিপদে পড়েছে সংখ্যালঘুরা। তাদের বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
তিনি বলেন, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বাংলাদেশ আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অনেক ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। এমন অবস্থায় হেফাজতে ইসলাম বা জামায়াত-শিবিরের মতো যুদ্ধাপরাধী শক্তির সহিংস কর্মকা-ে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। একটা কথা বলা হতো, বাংলাদেশে একজন বাঙালী থাকলেও দেশ স্বাধীন থাকবে। কিন্তু জামায়াত-শিবিরের মতো স্বাধীনতাবিরোধীরা এমন কর্মকা- চালাতে থাকলে আমাদের স্বাধীনতা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে হেফাজতে ইসলাম আজ মাঠে নেমেছে। তাদের ঠেকাতে আমাদের এখন এক প্রকার দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে নামতে হয়েছে। অবশ্যই এ যুদ্ধে আমরাই বিজয়ী হব।
নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিবিসির সাক্ষাতকারে ব্লাসফেমি আইন হবে না মর্মে যে ঘোষণা দিয়েছেন, দেশবাসীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আশা করি তা রক্ষা করবেন। ব্লাসফেমি আইনের ফলে কি হতে পারে তা পাকিস্তানের দিকে তাকালেই আমরা দেখতে পারি। সেখানকার ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা কিভাবে প্রতিনিয়ত ভীতিকর অবস্থায় দিনাতিপাত করে তা প্রত্যক্ষ করছি আমরা।
হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, ইসলামের হেফাজত করা একমাত্র আল্লাহর দায়িত্ব। তাঁর দায়িত্বে অংশগ্রহণের কথা শয়তান ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। হেফাজতের ১৩ দফা দাবি বাংলার মানুষকে জাহান্নামে পৌঁছে দেয়ার একমাত্র দফা। তাদের কোন দাবির একটাও ইসলাম সমর্থন করে না।
তিনি হেফাজত নেতৃবৃন্দের প্রতি প্রশ্ন রাখেন, একাত্তরে যখন ইসলামের নামে বাংলার মুসলমানদের বিনা বিচারে হত্যা করা হয়েছিল, তখন তারা কোথায় ছিলেন। দেশপ্রেম যখন ঈমানের অঙ্গ, তখন একাত্তরে জাতির সৎকটময় মুহূর্তে হেফাজতের নেতারা কোথায় ছিলেন? কোরানে হত্যার বদলে হত্যার বিধান থাকলেও যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধ যারা করেছে তাদের বিচারের দাবি কেন হেফাজত করছে না?
আয়েশা খানম বলেন, হেফাজতের মতো মৌলবাদী সংগঠনগুলো যাতে গড়ে উঠতে না পারে সে জন্য শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন, নারীনীতির বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটাই যে, স্বাধীনতার ৪২ বছরেও আমরা কোন ধারাবাহিক নীতি অনুযায়ী চলতে পারলাম না।
নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, সংঘাত এড়ানোর কোন সুযোগ নেই। যুদ্ধাপরাধী শক্তিকে বিতাড়িত করে আমরা নতুন প্রজন্মকে সত্যিকারের স্বাধীনতা উপহার দেব। কারও কাছে আমাদের নতজানু হলে চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে কোন ধর্মীয় রাষ্ট্র করতে দেয়া হবে না।
তিনি সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সরকারের মধ্যে হেফাজতের দাবি বাস্তবায়ন নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, এরা জামায়াতেরই সামাজিক সংগঠন। দীর্ঘদিন ধরে এরা একত্রিত হচ্ছে। যখন জামায়াত রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হয়েছে তখনই তাদের ব্যবহার শুরু করেছে। জামায়াতের পাশাপাশি হেফাজতকেও নিষিদ্ধ করতে হবে।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, হেফাজতে ইসলাম নামটাই শিরক। একটা শিরক নাম ধারণ করে কেউ মানুষকে ইসলামের দিকে ডাকবে তা হতে পারে না। বাংলাদেশে দু’ধরনের মুসলমান রয়েছে। এক ধরনের হচ্ছে ফন্দিবাজ মুসলমান। তারা ধর্মকে আশ্রয় করে রাজনীতি করে যা আমরা গত ৬০-৭০ বছর ধরে দেখে আসছি। আর এক ধরনের রয়েছে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তারা ধর্মের ব্যাপারে একটু ভীত। ফন্দিবাজরা তাদের সবসময় ব্যবহার করতে চায়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যেও ধর্মের ব্যাপারে ভীতির এ প্রবণতা রয়েছে। তারা ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে ভয় পায়। ভোটের রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা ইসলামের ব্যাপারে যেসব মিথ্যাচার করা হয় সে ব্যাপারেও কিছু বলে না। কিন্তু ভোটের বিবেচনা যদি করা হয়, তবে তাদের জেনে রাখা উচিত দেশটা আওয়ামী লীগের একার নয়। বাংলাদেশ প্রগতিশীল লোকদেরও। তাদের পাশাপাশি নতুন ভোটার আর নারীদের ভোট পেতে হলে আওয়ামী লীগকে অবশ্যই যে কোন ধরনের সমঝোতার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সাংবাদিক হারুণ হাবীব বলেন, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন শুধু সরকারবিরোধী নয়, এটা রাষ্ট্রবিরোধী আন্দোলন। সরকারের একটি অংশ যারা দেশের উন্নতি চায় না, নারী প্রগতিতে বিশ্বাস করে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিশ্বাস করে না তারা হেফাজতের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা হতে দেয়া হবে না।
তিনি প্রস্তাব করেন, যুদ্ধাপরাধী শক্তিকে প্রতিহত করতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তিকে একত্রিত হয়ে একটি মঞ্চ গঠন করতে হবে। তা না হলে হেফাজত যদি তাদের দাবির আংশিকও পূরণ করতে পারে তবে বাংলাদেশকে তালেবানী রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলবে।
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির প্রত্যেকটাই কিভাবে বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক তা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, হেফাজতের দাবিসমূহ রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের শামিল। সরকারের উচিত দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া।
#
জনকণ্ঠ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন