জনকণ্ঠ, সমুদ্র হক ॥ সব জায়গায় আলোচনার ঝড়। শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। সকলের মধ্যে
শঙ্কা। তবে কি শেষ পর্যন্ত প্রগতির ধারা রুদ্ধ হয়েই যাবে! মানব-মানবীর
জীবনের উত্তাল নদীর প্রবাহ কি শুকিয়ে মরা গাঙে পরিণত হবে! এরপর দিনে দিনে
মরুভূমি। তৃষ্ণার কাতরতা। তারপর কি! দেশে দেশে নারী-পুরুষ কাঁধে কাঁধ
মিলিয়ে কাজ করে এগিয়ে নিচ্ছে আগামীর পৃথিবীকে। বাংলাদেশ কি ছিটকে পিছিয়ে
পড়বে! বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোতেও নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করছে। মালয়েশিয়ার
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে নামার পর ইমিগ্রেশন থেকে কাস্টমস পর্যন্ত প্রায়
সকল অফিসার নারী। সেখানকার পর্যটন প্রদেশ সাবাহর রাজধানী কোটাকিনাবালু
বিমানবন্দরে প্রবেশের পর সরকারের নারী কর্মকর্তাগণ অভ্যর্থনা জানিয়ে পৌঁছে
দেন গন্তব্যে।
এমন কি ইরানে আয়াতুল্লাহ খোমেনি শাসনভার নেয়ার পরও নববর্ষের
সাংস্কৃতিক উৎসব নওরোজ বন্ধ হয়নি। আগের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতা বেড়েছে।
পারস্যের সংস্কৃতির শিকড়ের অনেক উৎসবে নারী-পুরুষ এক সঙ্গে অংশ নেয়।
তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক নারীদের টেনে এনে দেশকে উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে
নিয়েছেন। যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে পরবর্তী শাসকগণ। ইরাকে সাদ্দাম
হোসেন নারীর শক্তিকে বুঝতে পেরে সেনা নৌ ও বিমান বাহিনীতে নারী সেনা গঠন
করেছেন। পাকিস্তানের মতো গোঁড়া মুসলিম দেশেও নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিনা
রব্বানী খার ভূমিকা কী তাও দেখছে বিশ্বের মানুষ। বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির
অগ্রসরতায় নারীর অবদান কেউ খাটো করে দেখে না। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের
গবেষণায় অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে নারী এগিয়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
ন্যাশনাল এরোনোটিকস এ্যান্ড স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) অনেক বড়
গবেষক এখন নারী। উন্নয়নশীল বাংলাদেশেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। ইতিহাস সাক্ষ্য
দেয় বাংলার মুসলিম নারীর আলোকবর্তিকায় বেগম রোকেয়ার কি ভূমিকা! যুগে যুগে
বাংলার নারী যখন অস্তিত্বের লড়াইয়ে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে দেশকে এগিয়ে
নিয়ে যাচ্ছে তখন একটি গোষ্ঠীর হুঙ্কারের অশনী সঙ্কেতে শিউরে উঠেছে কয়েক
কোটি মানুষ। এমন কি শিশু মনেও প্রভাব পড়েছে। অনেক মেয়েশিশু তাঁদের
বাবা-মাকে প্রশ্ন করেছে তারা কি লেখাপড়া করতে পারবে না! যারা নারীদের নিয়ে
এমন কথা বলেছেন এবং ক্ষমতার মোহে যারা এমন কথায় সায় দিয়েছেন তারা কি একবারও
ভেবে দেখেছেন প্রজন্মের মনে কতটা প্রভাব পড়তে পারে! ওই সমাবেশে নারী
সাংবাদিকদের ওপর যে আচরণ করা হয়েছে তা দেখে মর্মাহত হয়েছে লাখো-কোটি দর্শক।
সাংবাদিক নাদিয়া তো প্রেস লেখা জ্যাকেট ও হেলমেট পরেই ছিলেন। তারপরও তিনি
রেহাই পেলেন না। শুধু নারী সাংবাদিক কেন সকল কর্মজীবী নারী কি সামান্যতম
সম্মানটুকু আশা করতে পারে না! নারী কি মাঠে ময়দানে কাজ করতে পারবে না!
রাজশাহীতে পুলিশের এক সাব-ইন্সপেক্টরকে বিএনপি-জামায়াতী পিকেটাররা যখন ইট
দিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়, তখন প্রথমেই তো এগিয়ে এসেছিলেন বিউটি পার্লারের নারী
কর্মী ঝর্ণা। পরে এসেছিলেন দুই সংবাদ কর্মী। কোথায় ছিলেন তখন দেশের কথা
বলার রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা! ২০০৪ সালে ঢাকার রাজপথে যখন জঙ্গী মৌলবাদী
দল আওয়াজ তোলে, তারা তালেবান, বাংলাকে তারা আফগান বানাবে- তখন জামায়াতকে
সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। এত বড় হুমকির পরও তৎকালীন সরকার কোন
ব্যবস্থা তো নেয়ইনি উল্টো এতটাই প্রশ্রয় দিয়েছে, যার বিস্তৃতি ঘটেছে
দেশজুড়ে। কখনও জামাতুল মুজাহিদীন (জেএমবি), কখনও হরকত-উল-জিহাদসহ নানা
জঙ্গীগোষ্ঠীর নানা নামে। জেএমবি (নিষিদ্ধ ঘোষিত) কী করেছিল দেশের মানুষ তা
দেখেছে। গেল ৭ এপ্রিলের একটি ইংরেজী দৈনিকের খবরের শিরোনাম ছিল ‘টার্গেট
তালেবান রুল।’ উপ-শিরোনাম ছিল ‘কি অরগানাইজার অব হেফাজত লংমার্চ হাবিবুর
ওয়ার্কিং ফর এ্যান আফগান স্টাইল বাংলাদেশ।’ (লক্ষ্য তালেবান শাসন। হেফাজতের
প্রধান সংগঠক হাবিবুর আফগানের মতো বাংলাদেশ গড়ার কাজ করছেন)। বাংলাদেশসহ
বিশ্বের সকল দেশের মানুষ জানে তালেবানীরা আফগানিস্তানের কাবুল কান্দাহারের
ইতিহাসকে কিভাবে ধ্বংস করেছে। কিভাবে নারীদের অবমাননা ও অসম্মান করেছে।
আফগানিস্তানের উন্নয়নের ধারাকে রুদ্ধ করেছে। যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আল
কায়দার ওসামা বিন লাদেনকে গড়ে তুলেছিল, তৈরি করেছিল ইসলামী মিলিট্যান্ট
তারাও নিজেদের তৈরি ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে বুঝতে পেরে ওসামাকে বধ করতে
পাকিস্তানে কিভাবে অভিযান চালিয়েছিল তাও দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা
কিভাবে বাংলার নারীদের সম্ভ্রম লুটেছিল তা এখন ভোলেনি এদেশের মানুষ। যাদের
মধ্যে পাকিস্তানী প্রীতি এখনও আছে তারা কি নিত্যদিন দেখতে পারছে কী হচ্ছে
পাকিস্তানে! সেই হিসেবে বাংলাদেশ প্রগতিশীল ধারায় অনেকটা এগিয়ে আছে।
আগামীতে নারী-পুরুষ এক সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে প্রযুক্তি ও মেধার
সমন্বয় ঘটিয়ে দেশকে যখন অগ্রগতির দিকে এগিয়ে নিতে চাইছে, তখনই
‘ফান্ডামেন্টালিস্ট গ্রুপ’ দেশকে পিছিয়ে দিতে নানাভাবে সহিংসতা উস্কে
দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় ভয়ঙ্কর কথা বলেছে তারা শনিবারের শাপলা চত্বরে। নারী
সমাজসহ দেশের সকল মানুষ বিস্মিত হয়েছে। হতবাক হয়েছে। এমন কি গ্রামের কৃষক
গৃহস্থ সাদাসিধে মানুষ পর্যন্ত বলেছে, বর্তমান সমাজে নারী-পুরুষ একসঙ্গে
চলাফেরা করতে পারবে না এটা ভাবতেই পারে না তারা! গ্রামের মানুষও মন্তব্য
করে- এই কথা শোনার পরও বিরোধী দল নীরব হয়ে থাকল। একটা প্রতিবাদ পর্যন্ত করল
না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে ওই কথার সঙ্গে বিরোধী দলও একমত। কোন অজ্ঞাত
কারণে সরকারও যেন নীরব হয়ে আছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বললে এটা
পরিষ্কার বোঝা যায়- কেউই হেফাজতে ইসলামের ওই কথা কোনভাবেই সমর্থন করে না।
গত দু’দিন ধরে প্রতিটি স্থানে এই কথাটি নিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় তো
নারীরা আন্দোলনে নেমেছে এবং অন্যান্য জেলায় (এমন কি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত)
প্রস্তুতি চলছে আন্দোলনের। মাঠের এই প্রস্তুতির সঙ্গে প্রতিটি ঘরে জেগে
উঠছে নারী। গ্রামেও নারীদের কি ভূমিকা সেদিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়-
বর্তমানে কৃষি কাজের বেশিরভাগই করে নারী। এমন কি ফসল কাটতেও নারী শ্রমিকের
সংখ্যা বেড়ে গেছে। কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর নারী ও পুরুষ
মিলে মিশে পাওয়ার টিলার চালায়, সেচযন্ত্র চালু করে। জমির পরিচর্যা করে। ফসল
ওঠার সময় আঙ্গিনায় নিয়ে তা মাড়াই করে সিদ্ধ -শুকানও করে। উত্তরাঞ্চলের
চলনবিল পারের চামারী ও বিলদহর এলাকায় গিয়ে দেখা যায় জলবায়ুর পরিবর্তনের
ধাক্কায় বিল অনেকটা শুকিয়ে যাওয়ার পর পুরুষ জেলেরা যখন ঢাকাসহ বড় শহরমুখী
হয় তখন নারীরাই সেখানে হাল ধরে। শুকনো ভূমিতে আবাদ শুরু করে। চারা রোপণ
থেকে শুরু করে পরিচর্যার পর ফসল ওঠা পর্যন্ত কৃষির সকল কাজই করে নারী। এই
নারী আবার সংসার সামলায়। সন্তানের লেখাপড়া দেখাশোনা সবই করে। বর্তমানে
নারীরাই উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে নিচ্ছে বিলপাড়ের সকল এলাকা। দেশের প্রতিটি
গ্রামে গিয়ে চোখে পড়বে নারী-পুরুষ মিলে কতটা দ্রুত এলাকাকে উন্নত করছে।
বগুড়ার সোনাতলার বাঙালী নদী তীরের বিদ্যুতায়িত রানীরপাড়া গ্রামের গৃহস্থ ও
কৃষকের ঘরে গেলে বোঝাই যাবে না এটা গ্রামের ঘর। শহুরে সুবিধাগুলো আয়ত্ব
করেছে গ্রামের নারী। ওই গ্রামের প্রতিটি ঘরেই এখন নারী শিক্ষায় আলোকিত।
পুরনো দিনের লোকও বুঝে নিয়েছে নারী শিক্ষা ও নারীদের উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে
নেয়া ছাড়া আগামী পৃথিবীতে চলার কোন উপায় নেই। ওই গ্রামে রঙ্গিন টিভি ফ্রিজ
এলপি গ্যাসের চুলা প্রেসার কুকার ওভেন পর্যন্ত আছে। কেবল সংযোগে তারা দেশের
চ্যানেল ছাড়াও বিশ্বের নানা দেশের চ্যানেল দেখে। এলাকার এসব চিত্রের
পাশাপাশি সকল দুর্যোগে (ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি) নারীই প্রথমে ঘর
সামলায়। শিশু সন্তানকে কোলে নিয়েও ঘরের জিনিসপত্র রক্ষা করতে এক স্থান থেকে
আরেক স্থানে নিয়ে যায়। দুর্যোগের পরও নারীই ঘর গোছায় আগে। সারাদেশে নারী
উন্নয়নের চিত্রের অতি ক্ষুদ্র এই চিত্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় একটা সময় নারীই
বিশ্ব চালাত। সেই বিশ্বে ছিল না কোন হিংসা-বিদ্বেষ যুদ্ধ। নারী-পুরুষ এক
সঙ্গে কাজ করে যখন বিশ্বকে দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে, তখন একটি অশুভ তালেবানী
শক্তি বাংলাদেশে ঢুকে নারীর কর্ম-ক্ষমতা ও মর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে
উদ্যত। ২০০৪ সালের কথা- ঢাকায় যখন তালেবানী সমর্থকরা মিছিল করে, তখন বগুড়া
সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয় এক মৌলবাদী
জঙ্গীগোষ্ঠী। তখন কয়েক শিশু শিক্ষার্থী তাদের বাবাকে বলেছিল ‘আব্বু ওরা
নাকি আমাদের স্কুলটা উড়িয়ে দেবে। আমরা কোথায় লেখাপড়া করব!’ সেদিন শিক্ষক ও
অভিভাবক বলেছিলেন, ‘ওই স্কুলের আঙিনাতেই পড়বে আমাদের মেয়েশিশুরা। কোন শক্তি
নেই নারীর অগ্রযাত্রা রোধ করতে পারে। চাকরি সূত্রে বগুড়ায় কাজ করছেন একজন
উর্ধতন কর্মকর্তা হোস্নে আরা মনি। যিনি একজন লেখিকা। তাঁর লেখালেখির অনেকটা
জুড়েই থাকে নারীর অগ্রযাত্রা। বললেন- ‘যত তালেবানী আসুক ভয় পাই না। বাংলার
নারী এগিয়ে যাবেই...।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন