মঙ্গলবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৩

ব্লাসফেমির পক্ষে নয় বড় দুই দল, দাবি মূলত জামায়াতের

জনকণ্ঠ, বিশেষ প্রতিনিধি ॥ হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী পাকিস্তানী আদলে ‘ব্লাসফেমি’ আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। ইসলাম অবমাননার অভিযোগে বিচারের জন্য নতুন কোন আইন প্রণয়নের সম্ভাবনা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে উপস্থিত থেকে সমর্থন জানালেও তাদের দাবি অনুযায়ী ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের পক্ষে নয় খোদ বিএনপিও। জামায়াতের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে অবিকল মিল রেখে হেফাজতে ইসলামের এই দাবি নিয়ে সারাদেশেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। প্রধান দুই দল ছাড়াও দেশের সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষেরই আশঙ্কা, দেশের সংবিধান, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির একটিও সরকার মেনে নিলে বাংলাদেশ পরিণত হবে তালেবান রাষ্ট্রে। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে জাতি।

হেফাজতে ইসলামের দাবির মধ্যে অন্যতম ইসলাম অভিযোগের মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে বিচারে নতুন আইন অর্থাৎ পাকিস্তানী আদলে ‘ব্লাসফেমি’ আইন প্রণয়নের বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ নিয়ে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক ও উদার গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে পাকিস্তানের আদলে উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে মওদুদীবাদী মতবাদ অনুযায়ী হেফাজতে ইসলামের এমন দাবি নিয়ে সারাদেশেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে।
ব্লাসফেমি আইন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বাংলাদেশে নতুন নয়। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা দাবিগুলোই ফুটে উঠেছে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দাবির মধ্যে। নির্বাচনী ইশতেহারে জামায়াতে ইসলামী অঙ্গীকার করেছিল, তারা ক্ষমতায় এলে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ‘ব্লাসফেমি আইন’ চালু করবে। হেফাজতে ইসলামের ‘ব্লাসফেমি’সহ ১৩ দফা দাবির সঙ্গে জামায়াতের নীতি-আদর্শ’র সুস্পষ্ট মিল খুঁজে পেয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
১৯৯৩ সালে জামায়াতের মহাসচিব থাকা অবস্থায় যুদ্ধাপরাধীদের দায়ে বিচারের মুখোমুখি মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তানী মডেলে ‘ব্লাসফেমি বিল’ সংসদে উত্থাপন করেন। ওই বিলে ঠিক পাকিস্তানের আদলেই যুদ্ধাপরাধী নিজামী ফৌজদারি আইনের ২৯৫ (খ) ধারায় ‘পবিত্র কোরান’-এর অবমাননায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবনের সঙ্গে এবং ২৯৫ (গ) নতুন উপ-ধারায় ‘মহানবীর (স.) অবমাননা’র জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদ-’র প্রস্তাব করেন। যদিও সংসদে তীব্র বিরোধিতার মুখে বিলটি হালে পানি পায়নি। নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও এতদিন পর জামায়াতের দাবিরই প্রতিধ্বনি করেছে হেফাজতে ইসলাম।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের মতে, লংমার্চ থেকে হেফাজতে ইসলাম নারীনীতি বাতিল, নারীদের অবরুদ্ধ এবং ‘ইসলাম ধর্মের অবমাননা’ রোধে মৃত্যুদ-ের বিধান রেখে ব্লাসফেমি আইন পাসসহ যে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করেছে তা সম্পূর্ণ সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী। দেশকে তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করতেই এসব দাবি উত্থাপন করা হয়েছে। তারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশেও মধ্যযুগীয় কায়দায় দেশ পরিচালিত করতে চায়।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির বিরুদ্ধে সারাদেশের মানুষ যখন সোচ্চার, ঠিক তখনই সরকারের এ বিষয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুযায়ী ইসলাম অবমাননার অভিযোগ বিচারের জন্য নতুন কোন আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা নেই সরকারের। তিনি বলেন, হেফাজতে ইসলাম এ দাবি করেছে। তবে এ রকম কোন পরিকল্পনা আমাদের নেই। কারণ আমাদের বিদ্যমান আইনেই এ বিষয়ে বলা আছে। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সরকার সব সময়ই সব ধর্মের মানুষের অধিকার রক্ষার চেষ্টা করে যাবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের অবস্থান তুলে ধরে বলেন, সরকার হেফাজতের সব দাবিই দেখবে। এর মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য হলে তা পূরণ করা হবে। আর যেসব দাবি ‘গ্রহণযোগ্য নয়’, বা বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার ‘উপযোগী নয়’ সেগুলো পূরণ করা হবে না। কেউ যদি অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার চেষ্টা করে- সে বিষয়ে আমাদের আইন আছে। সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি এবং ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
এই উগ্র ও ফ্যাসিবাদী আইনের পক্ষে নয় খোদ বিএনপিও। হেফাজতে ইসলামের লংমার্চে সমর্থন ও সংহতি প্রকাশ করলেও তাদের প্রধান দাবি ‘ব্লাসফেমি’ আইন প্রণয়নের সঙ্গে একমত নন দলটি। যিনি হেফাজতে ইসলামের মঞ্চে গিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন সেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও দাবিটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি তিনবার ক্ষমতায় ছিল। কিন্তু তিনবারের ক্ষমতায় থাকার সময় এ ধরনের (ব্লাসফেমি) আইনের ব্যাপারে আমরা সমর্থন করিনি। হেফাজতে ইসলাম কিভাবে আইনটি চাচ্ছে- তা দলীয় ফোরামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সবকিছু দেখেশুনে পরে দলীয়ভাবে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।
শুধু আওয়ামী লীগ বা বিএনপিই নয়, স্বাধীনতায় বিশ্বাসী সকল মানুষই হেফাজতে ইসলামের এই দাবিটির তীব্র বিরোধিতা করেছে। দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ছাত্র-শিক্ষক, নারী নেত্রী, মানবাধিকার ও উন্নয়নকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সবারই একই কথা, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেশের সংবিধান পরিপন্থী। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক এসব দাবির একটিও সরকার মেনে নিলে বাংলাদেশ পরিণত হবে তালেবান রাষ্ট্রে। পাকিস্তান, আফগানিস্তানের চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে জাতি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও হেফাজতের দাবি সংবিধান ও মানবাধিকার পরিপন্থী মন্তব্য করে তাঁদের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এদের দাবি মানলে আমরা মধ্যযুগে ফিরে যাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা মূল্যবোধ আর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে দেশ পরিণত হবে তালেবান রাষ্ট্রে। হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক দাবি করলেও তাদের প্রতিটি দাবিই একটি বিশেষ রাজনৈতিক মহলের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। উন্নয়নের এ যুগে এ ধরনের সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দাবি কেউ আশা করে না, এসব দাবি কেউ মানবেও না।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবির তীব্র বিরোধিতা করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, হেফাজতের ১৩ দফার দাবির একটি দাবি মেনে নিলে বাংলাদেশ আর বাংলাদেশ থাকবে না, বাংলাদেশ তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। তিনি বলেন, জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদীর বইয়ে এই ব্লাসফেমি আইনে মৃত্যুদ-ের কথা রয়েছে, পাকিস্তানে আইনটি চালু আছে। কিন্তু আইনটির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হচ্ছে আইনের অপব্যবহার। পাকিস্তানেও এই আইনে যত মামলা হয়েছে তার ৯৯ ভাগই আইনের অপব্যবহার করে করা হয়েছে। আর বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মওদুদীবাদ বা ওহাবী মতবাদে নয়, সুফী ও সুন্নি ইসলামী মতবাদে বিশ্বাসী। বাংলাদেশকে তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করতেই হেফাজতে ইসলাম এসব দাবি করেছে।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক এ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে জনকণ্ঠকে বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে অপরাধ সংঘটনের শাস্তি হিসেবে দ-বিধির ২৯৫ (ক) ধারায় বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে ইন্টারনেট বা অনুরূপ উপায়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে, এমন অপরাধ সংঘটনের বিচারের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০৬-এর ৫৭ ধারায় ১০ বছরের কারাদ- এবং কোটি টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। যেহেতু ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অপরাধ বিচারের জন্য দ-বিধি ও তথ্যপ্রযুক্তি আইনে বিধান রাখা হয়েছে, তাই নতুন আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতা নেই। তা ছাড়া এরূপ নতুন আইন প্রণয়নের জন্য বর্তমান সরকার কোন নির্বাচনী অঙ্গীকার করেনি। এরূপ আইনের প্রয়োজনীয়তা বোধ করে ভবিষ্যতে কেউ জনগণের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় এলে তারা বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন