জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জামায়াত-শিবির
নিষিদ্ধের দাবিতে জেগে ওঠা গণজাগরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাওয়া হেফাজতে
ইসলামের নারীর অগ্রযাত্রাবিরোধী অবস্থানে ফুঁসছে নারী সমাজ। রাজনেতিক দল
বিশেষত বিরোধী দলের নেত্রীর প্রত্যক্ষ মদদে ধর্মীয় জিকির তুলে ধর্ম
ব্যবসায়ী উগ্রবাদী গোষ্ঠীর তোলা দেশের স্বাধীনতা, সংবিধান, নারী
অধিকারবিরোধী ও নারীর সকল অর্জন মুছে ফেলার পাঁয়তারার ঘটনায় ক্ষুব্ধ দেশের
নারী নেত্রীরা। এ অপচেষ্টাকে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে তারা
বলেছেন, নারীদের বোরখা পরিয়ে ঘরে বন্দী করে রেখে হেফাজতে ইসলাম নামধারী
উগ্রবাদী গোষ্ঠী দেশকে তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।
দেশের অধিক
জনগোষ্ঠীকে ঘরের চার দেয়ালে আটকে রেখে নারীর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে চায়
ওরা। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা ও সংবিধান, নারী অধিকারবিরোধী এ ধরনের যেকোন
অপচেষ্টা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা হবে। কোন রাজনৈতিক শক্তিকেই নারীর
অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে দেয়া হবে না। ৬ এপ্রিল রাজধানীতে স্বাধীনতা, সংবিধান, নারীবিহীন ও নারীবিরোধী হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য যেমন ছিল, তেমনি পেশাগত দায়িত্ব পালনে গিয়ে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছে নারী সাংবাদিকদের। নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবিতে লংমার্চ করে মতিঝিলে মহাসমাবেশ করেছে, তাতে যোগ দিয়ে সংহতি জানিয়েছেন বিএনপির নেতারা। পুরো কর্মসূচীতে অংশ নিয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মী। হেফাজতের বিশাল সমাবেশের মধ্যে কোন নারীকে দেখা যায়নি। পেশাগত কাজে যেসব নারী সাংবাদিক গেছেন, তারাও জানিয়েছেন বিড়ম্বনার কথা। চট্টগ্রাম ও রাজধানীতে হেফাজত কর্মীদের বাধার মুখে পড়তে হয়েছে নারী সাংবাদিকদের। শুধু ‘নারী’ হওয়ার কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কয়েকজন। হেফাজতকর্মীরা মহাসমাবেশের খবর সংগ্রহ করতে আসা নারী সাংবাদিকদের দেখলেই বলেছে, মহিলা প্রবেশের অনুমতি নেই। মাথায় ওড়না নেই। আপনি এদিকে যেতে পারবেন না। হেফাজতের ১৩ দফা দাবির মধ্যে আছে- ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। সহশিক্ষা বা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছেলে মেয়ে পড়তে পারবে না। এ শিক্ষা বন্ধ করতে হবে বলে দাবি হেফাজতের। বিএনপির চেয়ারপার্সনের হয়ে সংহতি জানাতে আসা বিএনপি নেতাদের পাশে রেখে হেফাজত নেতারা হুমকি দেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে বা আসতে হলে ১৩ দফা মানতে হবে। অন্যথায় অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচী। দাবি করা হয়, মসজিদের নগরী ঢাকাকে মূর্তির নগরী রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ হেফাজতের সব দাবি মানতে হলে ভেঙ্গে দিতে হবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক অপরাজেয় বাংলাসহ সব ভাস্কর্য, বন্ধ করে দিতে হবে নারী-পুরুষের সহশিক্ষা বা মেলামেশাও। হেফাজতের এসব দাবি মানতে হলে পুরোপুরি পাল্টে দিতে হবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, শিক্ষা পদ্ধতি। বন্ধ করে দিতে হবে রাষ্ট্রীয় বহু আচার, মুক্তিযুদ্ধের নাটক-সিনেমা নির্মাণ করা যাবে না, ছেলে মেয়ে একত্রে চলাফেরা চাকরি, পড়ালেখাও করা যাবে না। নারীদের পর্দা ছাড়া পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করা যাবে না বলে হুমকি হেফাজত ও ১৮ দলীয় নেতা আবদুল লতিফ নেজামীর। হেফাজত নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, ইসলাম নারীদের বলেছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখতে। তবে ৬ এপ্রিল উগ্রবাদীদের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ দাবি তোলার ঘটনার পরই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে মুুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল সকল শক্তি। বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিরা।
ইতোমধ্যেই রাজপথে নেমে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রয়োজনে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন নারী আন্দোলনের নেত্রীরা। হেফাজতকর্মীদের নারীবিদ্বেষী বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় নারী নেত্রী শিরিন আক্তার বলেছেন, অবস্থা এমন মনে হচ্ছে যে, দেশটাকে তারা আফগানিস্তানের দিকে নিয়ে যেতে চায়। তবে জনগণ এমনটি কখনও হতে দেবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে জাসদ ছাত্রলীগের সাবেক এ সভাপতি। শিরীন আখতার বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দেশের স্বাধীনতা, সংবিধান এবং নারী অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অবিলম্বে এ ১৩ দফাকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। সর্বশেষ আদমশুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যা ১৫ কোটি ২৫ লাখ ১৮ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ কোটি ৬৩ লাখ ৫০ হাজার ৫১৮ জন, নারী ৭ কোটি ৬১ লাখ ১৭ হাজার ৪৯৭ জন। ভোটার তালিকায় ৯ কোটি ২২ লাখেরও বেশি ভোটারের মধ্যে ৪ কোটি ৬৫ লাখ পুরুষ ও নারী ৪ কোটি ৬১ লাখ। শিক্ষায় পুরুষের চেয়েও ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে নারী। গত বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এর মধ্যে ছাত্র ৭৮ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং ছাত্রী ৭৯ দশমিক ০৯ শতাংশ। এছাড়া মাধ্যমিক এবং প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ছাত্র ও ছাত্রীর পাসের হার প্রায় সমান। কর্মক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই নারী। দেশের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। সাংবাদিকতা, ক্রীড়া, পুলিশ, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগেও নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমেই বাড়ছে। এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, আমি প্রচ- উদ্বিগ্ন, বিক্ষুব্ধ। এই বাংলাদেশ তো চাইনি আমরা। এই যে নারীর প্রতি লাঞ্ছনা চলছে, এখন যদি কর্মক্ষেত্র থেকে নারীদের ফিরিয়ে নেয়া হয়, তাহলে কী অর্থনীতির চাকা ঘুরবে? আমাদের দেশের নারীরা তৃণমূল থেকে এখন হিমালয় শিখরে। ঠিক এই মুহূর্তেই নারীদের পেছনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে। নারীদের অধিকারের বিষয় এলেই বলা হচ্ছে, ধর্ম গেল। কই এক নারী ধর্ষণের শিকার হলে তো এদের (হেফাজত) আন্দোলন করতে পাওয়া যায় না। শীর্ষ দুই দলের প্রধান নারী। আমরা তার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দেখি তারা কী করেন। না হলে আমাদেরই পথে নামতে হবে। তিনি বলেন, উগ্রবাদী গোষ্ঠীটি আমাদের দেশকে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করতে চায়। সকল অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে হায়। নারী নেত্রী মাহফুজা খানম বলেন, নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলাসহ নারী সমাজের প্রতি অবমাননাকর দাবি তোলার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উচিত ছিল হেফাজতের সমাবেশকে ধিক্কার জানানো। তিনি বলেন, এ নারীদের ওপর হামলাকারীদের গ্রেফতার করে শাস্তির ব্যবস্থা না করা হলে লাখ লাখ নারীকে ঢাকায় সমবেত করে মহাসমাবেশ করা হবে। মাহফুজা খানম বলেন, হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফার প্রতিটি দাবি সংবিধানবিরোধী। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, হেফাজতে ইসলাম জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতির বিরোধিতা করছে। কিন্তু এই নীতিতে কী আছে, তার এক লাইনও হয়ত তারা পড়ে দেখেনি। অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী বলেন, ১৩ দফা দাবি মানলে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে রাজনীতি ছেড়ে বোরখা পরে ঘরে ফিরে যেতে হবে। এসব দাবি বিবেচনার আশ্বাস বা সংহতি জানানো পুরো জাতিকে হতবাক করেছে। এ ধরনের দাবির প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। ইতোমধ্যেই তারা বিক্ষোভ করে প্রয়োজনে কঠোর কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের সেøাগানকন্যা লাকী আক্তার বলেছেন, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি পড়ে তারপর তাতে সম্মতি দিয়েছেন কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দেশের এ ধরনের পরিস্থিতিতে নারী প্রধানমন্ত্রী বা নারী বিরোধীদলীয় নেতা কীভাবে রাজনীতি করবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপন করেন এই সেøাগানকন্যা।
মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দেশের ১ শতাংশ ভোটারের পক্ষ নেবে, নাকি নারী ও তরুণ সমাজ মিলে যে ৪৫ শতাংশ ভোটার, তাদের পক্ষ নেবে, তা ঠিক করতে হবে। লাকি আরও বলেন, হেফাজতে ইসলাম আজ জামায়াতে ইসলামে পরিণত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সকল নারী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এদিকে এ বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী, গবেষক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ড. হামিদা হোসেন ইতোমধ্যেই তার এক লেখায় বলেছেন, আজ হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবি পেশ করছে তাতে সংবিধানে ও আমাদের আইনী কাঠামোতে বিরাট পরিবর্তনের দাবি আছে। যে নারীনীতি পেয়েছি আমরা, এটি তো আমাদের নারী সমাজের দীর্ঘদিনের দাবির ফসল। অনেক বছর ধরে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে নারী অধিকার কর্মী ও নারীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নীতিমালাটি তৈরি হয়েছে। এটা একদিনে ভুঁইফোড় কারও দাবির প্রেক্ষিতে হয়নি। আমি প্রশ্ন করব, আমাদের দেশের নারীদের অধিকার সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্র যে নীতিমালা মেনে চলবে, তা বদলে ফেলার জন্য তারা দাবি করার কে? মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জমায়েত করে কিছু দাবিনামা হাজির করলেই কি হবে? কে তাদের এসব দাবি করার অধিকার দিয়েছে? এ সমাবেশ ‘শান্তিপূর্ণ’ হয়েছে দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওদের ধন্যবাদ পর্যন্ত জানিয়েছেন। আর ওদিকে ওরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গলা কাটতে চেয়েছে! এ হলো রাজনীতি। হেফাজতে ইসলামী নামের দলটি শুধু নারীনীতির বিরোধিতা করছে না, তারা অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার প্রসঙ্গে ব্লাসফেমি আইন চালুর কথাও বলছে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ব্লাসফেমি আইন চালু আছে? ওদের সামনে উদাহরণ পাকিস্তান ও সৌদি আরব। তাহলে আমার কি বাদবাকি সভ্য রাষ্ট্রের উদাহরণ বাদ দিয়ে একটি বা দুটি রাষ্ট্রে চালু মধ্যযুগীয় কোন্ আইনকে আদর্শ মনে করব? তাহলে তো আমরাও মধ্যযুগে ফিরে যাব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন