বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

জামায়াত নিষিদ্ধ কতদূর

জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের ব্যাপারে সরকারি পর্যায়ে কোনো নির্দেশনা কিংবা তৎপরতা নেই। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের আইনগত প্রক্রিয়া শুরুর জন্য যে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছিল দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগেও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়। তবে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে প্রসিকিউশন। যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামায়াতের বিচার কীভাবে এবং কোন প্রক্রিয়ায় করা যেতে পারে সে ব্যাপারে সম্প্রতি প্রসিকিউশন কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আইন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, জামায়াত নিষিদ্ধের বিষয়ে হাইকোর্টে রাজনৈতিক দল হিসেবে দলটির নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিট মামলার ফলাফলের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে সরকার। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব ও বর্তমান প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের ২৫ নেতা বাদী হয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদনটি করেন। রিট আবেদনে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের ৯০বি (১) (বি)(২) এবং ৯০সি-এর সাংঘর্ষিক ও সংবিধান-পরিপন্থী বলে দাবি করা হয়। আবেদনটি বর্তমানে হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি পর্যায়ে রয়েছে।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ওই রিট মামলার কথা উল্লেখ করে সমকালকে বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট মামলা বিচারাধীন রয়েছে। হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চে শুনানি চলছে। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এখন সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সঠিক হবে না।

অন্যদিকে এ মামলায় রিট দায়েরকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর সমকালকে বলেন, এই রিট আবেদনের সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কোনো সম্পর্ক নেই। মামলাটি শুধু রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। অন্যদিকে ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনেই জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করা যায়। জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের যে জাতীয় দাবি উঠেছে সেখানেও জঙ্গি সংগঠন হিসেবেই তাদের নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ দমনের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারের অবস্থান থেকেও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দায় রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের।

নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু সমকালকে বলেন, জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে বর্তমান সরকার অতীতের মতো কোনো জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটতে দেবে না। যে কোনো ধরনের নৈরাজ্য কঠোর হাতে দমন করা হবে।

গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার সমকালকে বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারির সমাবেশ থেকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের আলটিমেটাম দেওয়ার পর এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি সরকারের কাছ থেকে। সরকার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে আদৌ কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি-না তাও জানে না সাধারণ মানুষ। এতে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্ম দেশপ্রেমিক জনতা অসন্তুষ্ট। আজকের মুক্তিযোদ্ধা মহাসমাবেশ থেকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

শুরু থেকেই গণজাগরণ মঞ্চের ছয় দফা দাবির দ্বিতীয় দাবি যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। প্রথম দাবিটি ছিল, সব যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা। ২১ ফেব্রুয়ারি প্রজন্ম চত্বরের মহাসমাবেশ থেকে ২৬ মার্চের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রক্রিয়া শুরু করতে সরকারের প্রতি আলটিমেটাম দেওয়া হয়।

বিশিষ্টজনরাও গণজাগরণ মঞ্চের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদারদের কায়দায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা দেশজুড়ে তাণ্ডব, জাতীয় পতাকা পোড়ানো, শহীদ মিনার ভেঙে দেওয়া, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িতে আগুনসহ স্মরণকালের ভয়াবহ হামলার পর জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিটি আরও জোরালো হয়।

জাতীয় সংসদে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননসহ সরকারি দলের কয়েকজন সদস্য নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে বক্তব্য দেন। সংসদে সংবিধানের ৩৮(গ) ধারা, ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের যে কোনো একটি প্রয়োগ করে এ মুহূর্তেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তোলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। রাশেদ খান মেনন ২০০৯ সালের সন্ত্রাস দমন আইনে জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধের উদাহরণ দেন। সরকারিভাবে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা কী হতে পারে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সমকালকে বলেন, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সবারই রাজনৈতিক দল ও সমিতি করার অধিকার থাকবে। তবে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের জনগণের সম্পত্তি নষ্ট করার অধিকার নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনও মারামারি ও খুন-খারাবিতে বিশ্বাস করে না। যেসব দল এসব কাজ করছে, আমরা আইন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি, এসব দল রাজনীতি করার অধিকারপ্রাপ্ত কি-না।

নির্বাহী আদেশে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনই কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে জানান স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু। তিনি বলেন, হাইকোর্টে এ বিষয়ে একটি রিট মামলা চলছে। মামলা চলা অবস্থায় নির্বাহী আদেশে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা যারা মাঠ পর্যায়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিতে বক্তব্য দিচ্ছেন, তারাও এ বিষয়ে দলীয় অবস্থানের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

তবে সংসদে আইন সংশোধনের পর সংশোধিত আইনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংশোধিত আইনে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়েরের বিষয়ে সম্প্রতি প্রসিকিউশন কার্যালয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে আইন প্রতিমন্ত্রীসহ প্রসিকিউশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, রাজনৈতিক দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে কোন প্রক্রিয়া গ্রহণ করা যেতে পারে এ ব্যাপারে উপস্থিত প্রসিকিউটরদের মতামত নেওয়া হয়। এ বিষয়ে আইনগতভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজকে এ ব্যাপারে কাগজপত্র সংগ্রহসহ যাবতীয় বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তার নেতৃত্বে একটি টিম ইতিমধ্যে কাজ শুরু করছে বলে জানা গেছে।
সমকাল, ২৬ মার্চ, ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন