আবু সাঈদ খান
একাত্তরের মুক্তিসংগ্রাম জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধে সব ধর্ম, বর্ণ, জাতি,
সম্প্রদায়, শ্রেণী-পেশার মানুষ একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে।
একাত্তরের বিজয় সম্মিলিতভাবে সমগ্র জনগোষ্ঠীর অর্জন_ তা খণ্ডিত করে দেখার
সুযোগ নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের গতি-প্রকৃতি বোঝাতে জনগণের বিভিন্ন অংশের
ভূমিকা আলাদাভাবে নিরূপণের প্রয়োজন রয়েছে।
ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা, সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশের অংশগ্রহণ, নারীর অবদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাদাভাবে কাজ হয়েছে। গ্রন্থ প্রণয়ন ও লেখালেখি হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধকে শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নিরূপণের জন্য যে ধরনের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। তবে কোনো গবেষক-পর্যবেক্ষক-মুক্তিযোদ্ধা অস্বীকার করেন না যে, মুক্তিযুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক, সৈনিকসহ সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষের অংশগ্রহণই ছিল সবচেয়ে বেশি।
ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা, সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশের অংশগ্রহণ, নারীর অবদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলাদাভাবে কাজ হয়েছে। গ্রন্থ প্রণয়ন ও লেখালেখি হয়েছে। তবে মুক্তিযুদ্ধকে শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নিরূপণের জন্য যে ধরনের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। তবে কোনো গবেষক-পর্যবেক্ষক-মুক্তিযোদ্ধা অস্বীকার করেন না যে, মুক্তিযুদ্ধে কৃষক-শ্রমিক, সৈনিকসহ সমাজের নিম্নবর্গীয় মানুষের অংশগ্রহণই ছিল সবচেয়ে বেশি।
২৬ মার্চ এলে একটি ঘটনা আমাকে আলোড়িত করে। '৭১-এর ২১ এপ্রিল গোয়ালন্দে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধবূ্যহ ভেঙে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাঁজোয়া গাড়িগুলো দু'পাশে গোলাগুলি করতে করতে ভয়াবহ আতঙ্ক ছড়িয়ে ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করেছে_ এ খবর পাওয়ার পর ফরিদপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে আমার গ্রামের বাড়ির আঙিনা থেকে আমি দেখতে পেলাম, আকাশে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। পরে জানলাম, ওই সময়েই কৃষক যুবক মোহন শেখের এক দুঃসাহসিক অভিযানের কথা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনারা যখন নামছে, তখন মোহন এক হাতে ঢাল, আরেক হাতে সড়কি উঁচিয়ে ছুটে যান। হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে সড়কি ছুড়ে দেন, সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক বুলেট এসে তার বুক ঝাঁজরা করে দেয়।
কৃষক মোহনের মতো অগণিত মানুষের বুকভরা সাহসই ছিল মুক্তিযুদ্ধের অপরাজেয় শক্তি। এই সাহসের অধিকারী কৃষক, ক্ষেতমজুর, শ্রমিক, সিপাহি_ নিম্নবর্গীয় মানুষই হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী সেনা। এটি আমাদের প্রজন্মের জানা, কীভাবে দেশজুড়ে মুক্তিযোদ্ধা দল গড়ে উঠেছিল। শুরুতে ৫-৭ জন রাজনৈতিক কর্মী বা ছাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো এলাকায় এসেছিল, তখন আগ্রহী কৃষক-ক্ষেতমজুর, শহর থেকে আসা ছাত্র-শ্রমিক, যুবকরা তাদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ায় সে সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক ছাত্রকর্মীদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা দল। সেসব দলের অংশগ্রহণকারীরাও সাবেক সেনাসদস্য, স্থানীয় কৃষক-ক্ষেতমজুর, শ্রমিক ও ছাত্র। কৃষকই ছিল এসব বাহিনীর আশ্রয় ও অন্নদাতা। প্রকৃতপক্ষে কৃষকের গৃহই পরিণত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দুর্গে। এ মুক্তিযোদ্ধা দলের বীরত্বগাথা আমাদের ইতিহাসকে করেছে সমুজ্জ্বল। স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা বা বিকশিত মুক্তিযোদ্ধা দলগুলোর হাজারো যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া সম্ভব। আমার এলাকার একটি যুদ্ধের বর্ণনা দিতে চাই। ২৯ মে সেনাবাহিনীর সাবেক সুবেদার আজিজ মোল্লার নেতৃত্বে সংঘটিত যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৬ পাকসেনা নিহত হয়। এ কাহিনীর ওপর খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের 'মুক্তির কথা' সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে। ওই যুদ্ধে কয়েক হাজার জনতা ঢাল-সড়কি নিয়ে অল্প কয়েকজন রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধার পাশে দাঁড়িয়েছিল, মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশল আর জনতার গগনবিদারী জয়বাংলা স্লোগানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকিস্তানি সেনারা বিলের মধ্যে নেমে পড়ে। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধা জনতার কাছে পরাস্ত ও নিশ্চিহ্ন হয়।
এসব যুদ্ধকে বলা যায় 'কৃষকের যুদ্ধ, মজুরের যুদ্ধ'। এমনই অগণিত যুদ্ধে কৃষকসহ নিম্নবর্গীয় মানুষের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। বলাই বাহুল্য, শ্রমিক, সিপাহি তো বটেই, ছাত্রদের অধিকাংশই ছিল কৃষকসন্তান।
প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষক ও নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী কী চেয়েছে? কেউ কেউ বলে থাকেন, পাকিস্তানি বাহিনীর অতর্কিত হামলা ও নির্বিচারে গণহত্যাই তাদের মুক্তিযুদ্ধে শামিল করেছে। কথাটি সত্যের একটি দিক। অপর দিকটি হচ্ছে, নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে শোষণ মুক্তির স্বপ্ন দেখেছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগে মুসলিম লীগের নেতারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারা তা মিথ্যায় পর্যবসিত হতে দেখেছে। দেশ বিভাগের অব্যবহিত পরেই তারা শুনেছে মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রের কথা। তারা অনুধাবন করেছে সেই লোকগানের মর্মবাণী_ 'মরি হায়রে হায়/লীগের পোলা বিলেত যায়/মোগো পোলা মোষ খেদায়।' মুসলিম লীগের শাসনের কুফল তারা অবহিত হয়েছে। যে কারণে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর নৌকায় তারা ভোট দিয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। কৃষক-শ্রমিক-জনতা যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা, আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার মর্মকথা উপলব্ধি করেছে। সেটির সারসংক্ষেপ এরূপ_ বাংলার মানুষের রক্তে ভেজা অর্থে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি-পিন্ডি শহর হচ্ছে, সেখানে ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে, অথচ সর্বাধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলার কৃষকরা পিছিয়ে পড়ছে, পাটের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না, তাদের সন্তানদের পড়াতে পারছে না, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি পাচ্ছে না, পূর্ব বাংলার মানুষ দাসে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের শোষণের জাঁতাকলে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়েছে। ব্রিটিশ খেদিয়ে তারা মুক্তি পায়নি। নতুন করে বাংলার মানুষের পায়ে পরানো হয়েছে পরাধীনতার শিকল।
তাই কেবল ২৫ মার্চের বর্বরোচিত ঘটনার প্রতিক্রিয়াতেই নয়, দীর্ঘকাল ধরে দেখা মুক্তির স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। এই স্বপ্ন বুকে নিয়ে শেখ মুজিবের নৌকায় ভোট দিয়েছে। কিন্তু সামরিক জান্তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা দেবে না তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যখন স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছে, স্বাধীনতার ইশতেহার পড়েছে, সেই খবরও বিদ্যুৎবেগে গ্রামবাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে গ্রামবাংলার সর্বত্রই উড়েছিল বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলার পতাকা। শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন কি-না, মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনার অগ্রগতির খবর নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি। বরং তারা স্বাধীনতার স্বপ্নকেই বুকে লালন করেছে। তাই ২৫ মার্চের পর দ্রুততার সঙ্গেই তাদের কর্তব্য পালনে দ্বিধান্বিত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধকালে কৃষক-শ্রমিক-জনতা স্বপ্ন দেখেছে_ বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। কেউ খাবে, কেউ খাবে না_ তা হবে না। ২২ পরিবারের শোষণ থাকবে না। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে, চাকরি পাবে। বাংলার সব মানুষ হাসবে, কেউ কাউকে কাঁদাবে না, কেউ ঠকবে না, কেউ ঠকাবে না, যে ব্যবস্থার নাম সমাজতন্ত্র। জনগণের নয়নমণি 'শেখ সাহেব', 'শেখের ব্যাটা' তো সব সভায় বলেছেন, সমাজতন্ত্র হবে। শোষণহীন সমাজ হবে। নতুন করে আর ২২ পরিবার হবে না। জনগণ বিশ্বাস করেছে, এ কথার নড়চড় হবে না।
স্বাধীনতার পর ৪২ বছর গড়িয়ে গেছে। পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে, তারপরও এগিয়েছে বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে। মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু শোষণের জাঁতাকল বন্ধ হয়নি। দেশটা এখন ধনীর রাষ্ট্র। এখানে ধনীকে আরও ধনী করার জন্য সবকিছু হচ্ছে।
হতাশার মাঝেও আশার বাণী শুনছি। শাহবাগ থেকে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে ধারণ করেছে, যা আছড়ে পড়েছে দেশময়। অভূতপূর্ব এ জাগরণ। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আরাধ্য স্বপ্ন বাস্তবায়নে আজ অঙ্গীকারবদ্ধ। তারা সরকার ও বিরোধী দলকে একাত্তরের চেতনায় পথ চলতে আহ্বান জানাচ্ছে। এই নবজাগরণের বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তি নিম্নবর্গীয় মানুষ কি তাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ পাবে? বাংলাদেশ কি শোষণহীন রাষ্ট্র হবে, না ধনীদের রাষ্ট্র থাকবে?
জাতির সামনে এটিই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একাত্তরের চেতনায় যেমনি ধনীর দেশ গড়ার নীতির সমর্থন নেই, তেমনি দেশকে ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়ে বিভক্ত করার সুযোগ নেই। অথচ বিভাজন টেনে এনে মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। কী সেই মৌল চেতনা? নতুন করে বলার অবকাশ রাখে না যে তা হচ্ছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক-ক্ষেতমজুর-শ্রমিক-জনতার মুক্তি, ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা থেকে মুক্তি।
দুর্ভাগ্য আমাদের, শাসক দলগুলো সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদসহ নানা উপসর্গকে স্বার্থ হাসিলের জন্য ব্যবহার করছে, জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করতে হলে বিভ্রান্তির কুয়াশা ঝেঁটিয়ে নতুন প্রজন্ম ও জনগণকে একাত্তরের মতো করে ঐক্য গড়তে হবে। একাত্তরে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষ, বাঙালি, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, গারো, মণিপুরি, খাসিয়াসহ সব জাতির জনগোষ্ঠী যেভাবে একাট্টা হয়েছিল স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য, সেভাবেই আবারও সংগঠিত হতে হবে।
একাত্তরের চেতনায় ক্ষুধা-দারিদ্র্য-শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়াই হবে এ সংগ্রামের লক্ষ্য; যেখানে সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ বা রাজাকারের কোনো স্থান নেই।
আবু সাঈদ খান :সাংবাদিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন