মোহীত উল আলম
২০১৩ সালে এসে জটিল আবর্তে পড়েছে দেশ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎ করার
জন্য জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির গত নভেম্বর থেকে
সহিংস আন্দোলন করে যাচ্ছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্দলীয় সরকারের
দাবিতে একই রকম সহিংস হরতালের মধ্যে আন্দোলন করে যাচ্ছে। জাপার এরশাদ সাহেব
'ধরি মাছ না ছুঁই পানি'র ধারায় অবস্থান নিয়েছেন। ব্লগারস অ্যান্ড অনলাইন
অ্যাক্টিভিস্ট নামে একটি ওয়েবসাইটের তরুণ পরিচালনাকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের
বিচার নিশ্চিত ও ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি করে ৫ ফেব্রুয়ারি
থেকে অহিংস আন্দোলন করে যাচ্ছেন, যার বিভিন্ন শাখা দেশের প্রায় সর্বত্র
কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সহিংসদের দমন করতে গিয়ে
পুলিশের গুলিতে আন্দোলনকারী অনেকে মারা গেছেন এবং যাচ্ছেন, আবার
আন্দোলনকারীদের আক্রমণে পুলিশ এবং সাধারণ জনগণও মারা পড়েছেন।
বহু যুগ আগের
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবাদপ্রতিম আইনজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি
অলিভার ওয়েন্ডেল হোমস জুনিয়র (কার্যকাল :১৯০২-৩২) বাক-স্বাধীনতার সংজ্ঞা
দিয়েছিলেন এই বলে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত 'ক্লিয়ার অ্যান্ড প্রেজেন্ট ডেঞ্জার'
তৈরি না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত বাক-স্বাধীনতা স্বীকার করা যেতে পারে। তার
পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয় জামায়াত-শিবির এবং বিএনপির ডাকা সহিংস হরতালগুলোর
কারণে দেশে সন্দেহাতীতভাবে তাৎক্ষণিক বিপদ তৈরি হয়েছে, কাজেই হরতালের নামে
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তা দমনে সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী সচেষ্ট হবে এবং তাই দেশ সামগ্রিকভাবে একটি ভয়াবহ সংকটে পড়েছে।সংকটের প্রকৃতি যেটা বোঝা যাচ্ছে, সেটার আলামত অষ্টম সংশোধনীর মধ্যে লুক্কায়িত আছে। সংসদীয় অর্থে বাংলাদেশ একটি ইসলামী রাষ্ট্র, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি একটি মধ্যম গোছের ইসলামী রাষ্ট্র, যার ভিত্তিমূল হলো এ ইতিহাস যে, মুসলমানরা এ ভূভাগে প্রবেশ করার পর থেকে বহু শতাব্দী ধরে এখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে। অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের মনে আগে বাঙালি না আগে মুসলমান, বা আগে মুসলমান না আগে বাঙালি_ সেটা নিয়ে পরিচিতি সংকট থাকলেও সেটা কখনও রাজনৈতিক সহিংস রূপ লাভ করেনি। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় না মানা ও বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য জামায়াত-শিবির যে সহিংস আন্দোলন পরিচালনা করছে এতে যেন বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদী ইসলামের কর্মকাণ্ডের ছায়া পাওয়া যাচ্ছে। হরতাল, বিক্ষোভ মিছিল এবং মানববন্ধনের নামে তারা সন্ত্রাস এবং তাণ্ডবের মাত্রা বাড়িয়ে নির্বিচারে এমন সব কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে যা সাদা চোখেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়। এ অপরাধকাণ্ডের ফিরিস্তি সবার জানা আছে_ মানুষ খুন, ঘরবাড়ি পোড়ানো, যানবাহন ভাঙা ও পোড়ানো, বৃক্ষনিধন, রাস্তা কাটা, ট্রেনে আগুন, রেলসেতু অকার্যকর করা, রেলের বিট খুলে ফেলা, বৈদ্যুতিক স্থাপনা পোড়ানো, সরকারি দফতর লুণ্ঠন ও পোড়ানো, পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলা, সর্বোপরি হিন্দু জনগোষ্ঠীর এলাকায় আক্রমণ, তাদের উপাসনালয় ও মূর্তি ভাঙা, তাদের ঘরবাড়ি লুণ্ঠন, তাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তোলা এবং পাশাপাশি সাইবার সন্ত্রাসের মাধ্যমে ধর্মের অপপ্রচারমূলক ও বিকৃত ব্যবহার করে মানুষের ধর্মের অনুভূতিকে বিপথে উস্কে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সৃষ্টি করা_ এরকম সব কাজই তারা করে যাচ্ছে।
আমার এ লেখার উদ্দেশ্য জামায়াত-শিবিরের এরকম উচ্চমাত্রার সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একটি কারণ খুঁজে বের করা।
ভারতবর্ষে মুসলমানরা কর্তৃত্ব হারায় ১৮৫৭ সালের পর। এরপর থেকে মুসলমানরা বিজিত বোধ নিয়ে সময় কাটালেও তারা তাদের অস্থিরতার কোনো রাজনৈতিক সুরাহা পাচ্ছিল না। কিন্তু যেটা লক্ষ্য করার বিষয়, ভারতবর্ষের মুসলমানরা তাদের সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্য হারিয়ে বিক্ষুব্ধ থেকেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, আধুনিক রাজনীতির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একটি কৌম-মুসলিম দেশ পেতে ব্রতী হয়েছে। ইংরেজ বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা আধুনিক চিন্তারও বিরোধিতা করেছে। ইংরেজদের সঙ্গে প্রাথমিক অবস্থায় অসহযোগের যুগেও মুসলমানদের এ সংকল্প যে পিছিয়ে পড়ার রাস্তা, সেটা অনেকে অনুধাবন করেছিলেন। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮) তার ইংরেজপ্রীতির জন্য একজন বিতর্কিত শিক্ষাবিদ ও নেতা হতে পারেন, কিন্তু ভারতবর্ষে মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি সচেষ্ট ছিলেন কোনো ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে নয়, বরং মুসলমানরা যে আধুনিক জীবনযাত্রা থেকে পিছিয়ে পড়ছিল সে জন্য। কিন্তু উপমহাদেশের মুসলমানরা জ্ঞানার্জনের কঠিন পথে না গিয়ে যেতে চেয়েছে অপেক্ষাকৃত সহজ পথ_ ধর্মের নামে জিগির তুলে একটি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে। যদিও ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, মুসলমানরা প্রাথমিকভাবে সাম্প্রদায়িক ছিল না, কিন্তু যখন '৪৭ সালে ব্রিটিশদের হাতে দেশ বিভাজন হলো, দেখা গেল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলো নিতান্তই দ্বিজাতিতত্ত্ব নামক একটি সাম্প্রদায়িক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে।
পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে সাম্প্রদায়িকতার মোচন একটি বড় তাড়না ছিল অবশ্যই, কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক চেতনা বালি-মাখা ভাত মুখে দিলে যেমন বালির কামড়টা ভাত খেয়ে শেষ করার দীর্ঘক্ষণ পরেও দাঁতে ঠেকে, ঠিক সে রকম তেলে-জলে মিশে আছে।
সাম্প্রদায়িক চিন্তার মূল দর্শন হলো চিন্তাশক্তিকে তুলনারহিত করে দেওয়া। নিজের সবকিছুকে শ্রেষ্ঠ মনে করা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ধরন। একটি অগণতান্ত্রিক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া ও তার লালন-পালন করা সাম্প্রদায়িক চিন্তার বৈশিষ্ট্য। তখন মনের মধ্যে একটি বিবর তৈরি হয়, গুহায় শুধু নিজের ছায়াকে একমাত্র অস্তিত্ব মনে হয়। আর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা যখন রাষ্ট্রীয় জীবনের পরিকাঠামোয় সমন্বিত হতে থাকে (যেমন অষ্টম সংশোধনী) তখন রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বস্তরে একটি বেসামাল অবস্থা তৈরি হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে জামায়াত-শিবিরের সহিংস তৎপরতা শক্তি ও সমর্থন পাচ্ছে ওই সমন্বিত ব্যবস্থা থেকে।
অন্যদিকে অসাম্প্রদায়িক শিক্ষার চর্চা হলো এই যে পুরো জীবন, পুরো বিশ্ব_ সেগুলো একটি তুলনামূলক কাঠামোর মধ্যে বিরাজিত থাকে। তখন এ প্রশ্নটা একজন আধুনিকমনস্ক মুসলমানের মনে আসতে বাধ্য যে, ইরাকের মুসলমান নৃপতি সাদ্দাম হোসেন মাটির নিচে গর্ত করে লুকিয়েছিলেন, আর সেটি কি-না যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রপতি বুশ সাহেব স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনুসন্ধান করে জেনে ফেললেন। বা জিহাদি ইসলামের অন্যতম প্রতিভূ বিন লাদেনকে ঠিকই আবিষ্কার করে হত্যা করে ফেললেন সিআইএর বড় কর্তা লিওন প্যানেট্টা, আর এবোটাবাদ-ইসলামাবাদের পাকিস্তান সরকার সেটা জানতেও পারল না। জ্ঞানই শক্তি, জঙ্গিবাদ নয়।
তারপরও জঙ্গিবাদ ভর করেছে রাজনৈতিক ইসলামের মধ্যে। এবং ধারণা করা যেতে পারে, এটির গোড়ায় আছে পরাজিতের অসহিষ্ণুতা, না-পারার হিংস্রতা; কিন্তু এটির মধ্যে নেই ধৈর্যশীলতা, গণতান্ত্রিকতা, জ্ঞানের অনুশীলন এবং সত্যতা। যেমন জঙ্গিবাদী ইসলামের সর্বোচ্চ বিজয় যদি নিউইয়র্কের টুইন-টাওয়ার ধ্বংসকে মনে করা হয়, কিন্তু তার ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে ইরাক, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান_ এ তিনটি মুসলিম দেশসহ আরও কিছু মুসলিম দেশ সর্বোচ্চ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাজেই জঙ্গিবাদ ইতিহাসের ঘটনাবলি দ্বারা বারবার পরাজিত শক্তি বলে প্রমাণিত হচ্ছে, কিন্তু সেটিই এখন জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক তাণ্ডবমুখর রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে থাবা বিস্তার করার সুযোগ নিচ্ছে।
এ সাম্প্রদায়িকতানির্ভর জঙ্গি মনোভাব দূর করার জন্য এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশের জন্য মূলত যে কাজটি করা উচিত ছিল সেটি কখনও হয়নি। শিক্ষার ক্ষেত্রটা বাংলাদেশে এখনও সবচেয়ে দুর্বল ক্ষেত্র। স্কুল-কলেজের কথা হয়তো আমি তেমন বলতে পারব না, কিন্তু উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রে বলতে পারি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে বিনিয়োগের দশ শতাংশ পর্যন্ত লেখাপড়া হয়নি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা শিক্ষিতভাবে প্রসারিত হবে, তার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিক শিক্ষার প্রক্রিয়া চালু থাকা দরকার ছিল, তা কখনও হতে পারেনি। এটি হচ্ছে কেননা আমরা জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা বিস্তারের কঠিন পথে না গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মাস্তানির আখড়া হিসেবে তৈরি করতে সময় দিয়েছি। বইয়ের বদলে অকাতরে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে বিরাজ করেছে বন্দুক এবং তা এখনও করছে। অন্যদিকে মাদ্রাসা ও ধর্মভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে গ্রামাঞ্চলের সাধারণ জনগণের ঐকান্তিক ধর্মানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে নিতে পেরেছে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্বব্যাপী সব রকম জঙ্গিবাদে প্রচুর অর্থায়ন হচ্ছে অস্ত্রব্যবসা টিকিয়ে রাখার জন্য। ইসলামী জঙ্গিবাদের পেছনেও প্রচুর অর্থায়ন হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি তৎপরতার পেছনে বিদেশি অর্থায়নের ধারণা হয়তো অমূলক নয় এবং পত্রিকার খবর অনুযায়ী, নাশকতামূলক কাজ ঘটানোর জন্য কর্মী কিংবা ভাড়াটে দুষ্কৃতকারীদের বিভিন্ন হারে টাকা-পয়সাও দেওয়া হচ্ছে। হয়তো আফগানিস্তান, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদীরা তাদের নিরাপদ ক্ষেত্র মনে করছে। তারপরও তাদের কর্মকাণ্ড এতটা চরমে উঠতে পারত না যদি জনগণের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক ও তুলনামূলক শিক্ষার প্রসার আমরা অব্যাহতভাবে করে যেতে পারতাম।
তৃতীয়ত, জঙ্গিবাদী ইসলামের আরেকটি প্রচার-প্রক্রিয়া হচ্ছে সাইবার সন্ত্রাস। ডেইলি স্টারের ১৭ মার্চ সংখ্যায় জামায়াত-শিবিরের সাইবার সন্ত্রাসের কতিপয় নমুনা ছাপা হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি একেবারে ধর্মবিরোধিতার শামিল। এক. পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তনের ছবিকে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাঈদীর মুক্তির জন্য কাবাঘর কর্তৃপক্ষের দাবি হিসেবে। দুই. তুরস্কে একটি পবিত্র ধর্মমিছিলকে (প্রফেটস অব লাভ) ছড়ানো হয়েছে সাঈদীর মুক্তির দাবিতে, আর একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানের একটি ধর্মীয় ব্যানারকে ফটোশপ করে বলা হয়েছে 'আল্লামা সাঈদীর মুক্তি চাই'। ফটোশপের বাইরেও জামায়াত-শিবিরের সহিংস কর্মকাণ্ডের আরেকটি ধরন হচ্ছে বিপজ্জনক গুজব রটানো।
সাধারণ গ্রামবাসীর ধর্মীয় অনুভূতিকে ধর্মের নামে অপপ্রচারের যারা হোতা তারা কীভাবে তা কাজে লাগায় তার একটি উদাহরণ আমরা পাই বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাঈদীর ছবি চাঁদে দেখা গেছে বলে জামায়াত-শিবির যখন গুজব ছড়াল, আর তা বিশ্বাস করে যখন হাজার হাজার মানুষ রাতের বেলায় ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামল সাঈদীর মুক্তির দাবিতে। বুঝলাম, জামায়াত-শিবির তাদের অপপ্রচারের স্বার্থে জনগণকে, বিশেষ করে বগুড়ার শাজাহানপুর থানাসহ কয়েকটি থানার লোকজনকে নানা কায়দায় প্রস্তুত রেখেছিল ওই শিশুসূলভ গুজবটাকে ভিত্তি করে একটি সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক ভয়াবহ তাণ্ডব সৃষ্টি করার। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, সাধারণভাবে মানুষ যখন এরকম গুজব বিশ্বাস করে ফেলছে, সেখানে জামায়াত-শিবিরের গুজব তৈরি ও প্রচারের সাফল্যের চেয়েও বড় প্রশ্ন হলো এরকম গুজব মানুষ বিশ্বাস করে কীভাবে?
আরেকটি উদাহরণ দিই : শ্রীলংকার সঙ্গে চলতি সিরিজে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের একজন খেলোয়াড় সেঞ্চুরি করার পর মাটিতে সিজদা দিয়ে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানান। সে ছবিটা ফেসবুকে একজন বন্ধু ট্যাগ করে ক্যাপশন করেন যে ওই ব্যাটসম্যান পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন বিধায় সেঞ্চুরিটা পেয়েছেন। এখানে যে দিকটা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে সেটা হলো বহু মুসলমান ক্রিকেটারই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পালনসহ ধর্মের বিভিন্ন উপাচার শুদ্ধভাবে পালন করে থাকেন, কিন্তু তারা ওই ব্যাটসম্যানের মতো সেঞ্চুরি পান না। যিনি ফেসবুকে এ ছবিটা ট্যাগ করেছিলেন তিনি খেলোয়াড়ের সাফল্যের সঙ্গে তার আধ্যাত্মিক চর্চার যোগসূত্র খুঁজতে চেষ্টা করেছিলেন। অথচ ওই ব্যাটসম্যানের সেঞ্চুরি করার সঙ্গে সম্পর্ক হলো খেলোয়াড় হিসেবে তার প্রতিভা, দক্ষতা, ক্ষিপ্রতা, মনঃসংযোগ, ধৈর্য এবং শারীরিক সবলতার সম্পর্ক, পাশাপাশি অবশ্যই তার ধর্মীয় চেতনা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। খেলোয়াড়েরা_ তারা যে ধর্মেরই হোন না কেন, তারা কমবেশি ধর্মপ্রবণ হয়ে থাকেন এবং ভাগ্যে বিশ্বাস করে থাকেন। যে কোনো খেলোয়াড়ই সাধারণভাবে তার সৃষ্টিকর্তার কাছে মনে মনে প্রার্থনা করেন যেন তিনি ভালো খেলেন, কিন্তু এ ভালো খেলাটা নির্ভর করে তার খেলাবিষয়ক দক্ষতার ওপর। টেন্ডুলকারকে দেখেছি প্রতিটি সেঞ্চুরির পর আকাশের দিকে মুখ তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে। কিন্তু এই টেন্ডুলকারই সবচেয়ে বেশি নেট প্র্যাকটিস করেন। যেমন ভালো ছাত্র হতে গেলে পরীক্ষার আগে সারারাত ইবাদত করা নিশ্চয় নেতিবাচক কাজ নয়, কিন্তু জরুরি হলো পরীক্ষা দেওয়ার বিষয়ে মনঃসংযোগ সহকারে নিবিড়ভাবে পাঠ করা, তা না হলে ফল ভালো হওয়ার আশা নেই। যেমন বাংলাদেশে মাসব্যাপী হরতাল দিয়ে উৎপাদন বন্ধ রেখে যদি সৃষ্টিকর্তাকে বলি_ আমাদের উন্নতি দাও, রাস্তাঘাট দাও, বিশ্ববিদ্যালয় দাও_ তাহলে তো হবে না। ইংরেজিতে একটা পুরনো কথা আছে, গড হেল্পস দোজ হু হেল্প দেমসেলভ্স। আল্লাহ্ তাদের সাহায্য করেন যারা (সৎকাজে) নিজেদের সাহায্য করেন।
এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নস্যাৎকারীদের প্রধান অস্ত্র হয়েছে ধর্ম নিয়ে অপপ্রচার। ব্যক্তিগত জীবনে শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত হোক গুজবে বিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের সীমাহীন, কিন্তু ধর্মীয় অপপ্রচারের জন্য গুজবকে যখন রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন তার সাফল্যে আমরা বিস্মিত বা আহত হতে পারি, কিন্তু কেন এ অবস্থার সৃষ্টি হলো সেটির দিকে দৃকপাত করতে হবে। কারণ সমষ্টিগতভাবে একটি রাজনৈতিক সমাজে হাজার হাজার লোক যখন প্ররোচিত হয়ে কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একজন ধর্মীয় নেতাকে চাঁদে দেখা যাচ্ছে_ এরকম একটা গুজবে বিশ্বাস করে ফেলে, তখন যুক্তিবাদী সমাজের দায়িত্ব হচ্ছে সমস্যাটা বুঝতে চেষ্টা করা।
অধ্যাপক মোহীত উল আলম
ইংরেজি বিভাগ, ইউল্যাব, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন