অজয় দাশগুপ্ত
পরিস্থিতি উত্তেজনাময় বা অগ্নিগর্ভ থাকলেই সন্তুষ্ট থাকেন, আমি তেমন মানুষের দলে নই। কোনো বিশেষ পরিবেশ, সময় বা উত্তেজনার কারণে দেশ উত্তপ্ত হলে তখন একটি দিকে যাবার বিকল্প থাকে না। বিশেষত যদি তা হয় আদর্শ ও অস্তিত্বের স্বার্থে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, যে সংঘাত তাতে আমরা আমাদের পক্ষ বেছে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যে দিকে আমরা তো সে দিকেই থাকবো। ধর্ম-নিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতা যে এক নয় তা পই পই করে বলার পরও যারা বোঝে না, যারা ভাবে ধর্ম মানে আধিপত্য, ধর্ম মানে অন্যকে কাফের ডাকা, নাস্তিক বলে ফতোয়া দেয়া, তাদের পক্ষে কেন যাবো আমরা? আমরা কি এইসব ইতর প্রাণীদের চিনি না? অনলাইনে পাঠক প্রিয় পত্রিকা ভোরের কাগজ, যে কোনো লেখার ই-সংস্করণেই পাঠকের মতামত সুলভ।
এই এখানেও ধর্মান্ধদের আসল চেহারা, বিকৃত রুচির পরিচয় দেখি, মত বা আদর্শে না বনলেই কাফের, মালাউন বলে গালাগাল। আরে বাবা, বাংলাদেশ কি তোদের বাপের তালুক না মগের মুল্লুক? যে কোনো দেশের জন্ম প্রক্রিয়াই তার ইতিহাস। সে ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের মিলিত অবদান ত্যাগ সংগ্রামের পরও ‘ভারতের দালাল’ খেতাব পিছু ছাড়লো না। ভারতের চাইতে চৌদ্ধগুণ আগুয়ান দেশ, বিশ্বের দু কি তিন নম্বর উন্নত নগরীতে বসবাসের পরও ঐ এক গালাগাল। এইসব অপগ- মূর্খরাই আজ আস্তিক ও নাস্তিকের পার্থক্য রচনায় মাঠে নেমেছে। দেশের বাস্তবতাকে জটিল করে তুলেছে। তাদের সৃষ্ট, জামাতিদের তা-ব ও বিএনপির উত্তেজনার আঁচ এখন প্রবাসেও গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। আগেই বলেছি আগুন আগুন খেলা আমার অপছন্দ। আমরা বাংলাদেশের শান্তি উন্নতি আর অগ্রগতি দেখে মরতে চাই। যে প্রজন্ম দেশের বলে ধরবে, যে প্রজন্ম দেশ ও বিদেশে বাংলা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে তাদেরকে যথাস্থানে দেখতে চাই।পরিস্থিতি উত্তেজনাময় বা অগ্নিগর্ভ থাকলেই সন্তুষ্ট থাকেন, আমি তেমন মানুষের দলে নই। কোনো বিশেষ পরিবেশ, সময় বা উত্তেজনার কারণে দেশ উত্তপ্ত হলে তখন একটি দিকে যাবার বিকল্প থাকে না। বিশেষত যদি তা হয় আদর্শ ও অস্তিত্বের স্বার্থে। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ থেকে বাংলাদেশের যে পরিস্থিতি, যে সংঘাত তাতে আমরা আমাদের পক্ষ বেছে নিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা, বঙ্গবন্ধু ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যে দিকে আমরা তো সে দিকেই থাকবো। ধর্ম-নিরপেক্ষতা আর ধর্মহীনতা যে এক নয় তা পই পই করে বলার পরও যারা বোঝে না, যারা ভাবে ধর্ম মানে আধিপত্য, ধর্ম মানে অন্যকে কাফের ডাকা, নাস্তিক বলে ফতোয়া দেয়া, তাদের পক্ষে কেন যাবো আমরা? আমরা কি এইসব ইতর প্রাণীদের চিনি না? অনলাইনে পাঠক প্রিয় পত্রিকা ভোরের কাগজ, যে কোনো লেখার ই-সংস্করণেই পাঠকের মতামত সুলভ।
দেখতে চাই দেখতে চাই বলে চিৎকার করলে তো হবে না। এর একটা প্রক্রিয়া আছে। বিধি আছে। সেই বিধি বা প্রক্রিয়া আজ মারাত্মকভাবে আক্রান্ত। বাংলাদেশ বলতে কেবল স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়–য়া আধুনিক ও শিক্ষিত ছাত্রছাত্রী বা যুবসমাজ নয়, গ্রাম-গ্রামান্তরে অশিক্ষা-কুশিক্ষা ধর্মীয় উন্মাদনায় বেড়ে ওঠা যুবক-যুবতীরাও দেশের অংশ। রাষ্ট্র ও সমাজ তাদের এড়িয়ে চলতে পারবে না। তারা যা ভাবে, যা করে তাতে যদি ভুল থাকে গলদ থাকে তা চিহ্নিত দায়িত্ব জাতির বিবেক নামে পরিচিতজনদের। কি দেখছি আমরা? হঠাৎ দৃশ্যপটে আবির্ভূত চিহ্নিত কিছু স্বনামধন্য লেখক, টকশো বক্তা আর জ্ঞান পাপীরা জাতিকে দুভাগে বিভক্ত বলে ফাল পাড়ছেন। সে বিভক্তি কমানো বা গ্যাপ সংকোচনের নির্দেশনা দিতে পারার চেষ্টা নেই তাদের। নেই সমঝোতা বা শান্তি প্রক্রিয়া তুলে ধরার মেধা, প্রকারান্তরে ধর্মীয় উন্মাদনায় পাগল হওয়া যুব সমাজকেই উসকে দিচ্ছেন তারা। ধর্মীয় পরিচয় তাদের কাছে এতোই প্রকট জামাত-শিবিরের রক্তকে রক্ত মনে হলেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটিতে লুটিয়ে পড়া সংখ্যালঘুর রক্ত এদের চেতনাকে জাগাতে পারে না। একজন যুবক তার স্বাধীন মতামতের জন্য বাড়ির দেয়ালে নির্মমভাবে খুন হলেও এরা পাথরের মতো নিশ্চুপ নিশ্চল থাকেন। আত্মরক্ষায় ব্যস্ত রাষ্ট্রীয় সংস্থা, পুলিশ বা নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিতদের বলেন গণহত্যাকারী। শব্দের এমন অপপ্রয়োগ আগে শুনিনি। আমি অন্ধ আওয়ামী সমর্থক নই। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তাকে কি গণহত্যা বলা যায়? বাস্তবতা কী বলে? কোন মিডিয়া কী বলছে, কোন মিডিয়া উসকাচ্ছে তাকি অদৃশ্য কিছু?
এমন জটিলতায় বাংলাদেশ আগে পড়েনি। পড়েনি, কারণ এদ্দিন ধরে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র রাজনীতি চলে আসছিল। মানুষের গায়ে যতো দামি পোশাক পরিয়ে দেয়া হোক না কেন ক্যান্সার থাকলে তা বেরিয়ে আসবেই। ধর্মের রাজনীতি ও রাজাকার তোষণের ক্যান্সার বেরিয়ে এসেছে। যার ভয়াবহ চেহারা দেখে সরকার, প্রশাসন, প্রগতিশীলতা আজ আতঙ্কিত। এর দায় কেউই এড়াতে পারবেন না।
দেশে-বিদেশে বাঙালি বাংলাদেশীরা আজ দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একভাগ মুক্তিযুদ্ধ, জয় বাংলা, প্রগতিশীলতার কথা উচ্চকণ্ঠে বলছেন বলতে পারছেন। কারণ তা বলা যায়। অন্য দল যা বলছেন বা করছেন তা কিন্তু তাদের মনের কথা নয়। মনের বাসনা ও মনের গোপন কথা এখনো বলতে পারছে না তারা। আপাতত ধর্ম ও নাস্তিকতার মতো স্পর্শকাতর বিষয় দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলেও তারা চায় মুক্তিযুদ্ধের নাম নিশানা মুছে দেয়া নব্য পাকিস্তান।
গণজাগরণ মঞ্চই পরিস্থিতির উদগাতা, পরিস্থিতির প্রকৃত চেহারা আবিষ্কারক ও বাংলাদেশকে তার প্রকৃত চেতনায় ফিরিয়ে নেয়ার কৃতিত্বের মালিক, কিন্তু তারাই সমাধান নয়। সমাধান নয় বলেই তাদের আন্দোলনের একটা পর্যায় আছে। সে পর্যায়ের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছেন তারা। এখন দেশ-বিদেশে ঐ চেতনা, ধারা ও সংগ্রামের রথ টানার জন্য চাই ব্যাপক অংশগ্রহণ। লক্ষ রাখতে হবে প্রতিপক্ষ কিন্তু সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছে। খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী যতোই মানসিক অসুস্থ বলুন না কেন তিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে সিদ্ধান্ত নিতে কালমাত্র বিলম্ব বা সময় ক্ষেপণ করেননি। মূলত তখন থেকেই জামাত-বিএনপি একত্রে লড়ছে।
আমরা দ্বিধাবিভক্ত। দেশের রাজনৈতিক শক্তি ও দলগুলোর ভেতর জামাত নিষিদ্ধকরণ নিয়ে মতভেদ আছে। আছে কেনা-বেচার রাজনীতি, ভোটের কঠিন অংক মেলানো। যে তারুণ্য জেগে উঠেছিল তারা এসব নেতানেত্রীদের তুলনায় শিশু। ফলে আগুন আগুন খেলা দীর্ঘায়িত হবে না আগুন নিভবে তা বলা মুশকিল। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের হিসাবটাও জটিল। ডাক দিলে মানুষ আসছেন, নারীরা অগ্রগামী, তারুণ্য উদ্দীপ্ত কিন্তু যূথাবদ্ধ আন্দোলন বা কৌশল দেখছি না। আমরা আসলে কী চাই? ধর্মীয় রাজনীতির বিলোপ না সাইজ করা? জামাতিদের নির্বাসন না কম্প্রোমাইজ? মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাষ্ট্রকাঠামো না জগাখিচুড়ি? ফাঁসির আদেশ না শাস্তি কার্যকর হতে দেখা?
এই বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে রাজনীতিকে একটি জায়গায় একমত হতেই হবে। বিবদমান দুপক্ষ পৃথিবীর বহু দেশে বহু জাতিতে লড়াই করেছে, করছে, করবেও। সংস্কৃতি, ইতিহাস, ন্যায় ও ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে রাজনীতি যোগ হলেই মুক্তি এসেছে। যেমন এসেছিল বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এ জন্য চাই ভয় ও আশঙ্কামুক্ত অবস্থান। বাংলাদেশকে শান্তি ও প্রগতি ফিরিয়ে দিতে এখন আর অন্য কোনো বিকল্প নেই। দেশে-বিদেশে বিভক্ত বাংলাদেশ ও বাংলাদেশীদের যে কোনো মূল্যে এক করে এক দিকে এক পথে আনতেই হবে। সময় তাই চায় এবং সেটাই দেশের জন্য মঙ্গলের।
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক।
ভোরের কাগজ : রবিবার, ২৪ মার্চ ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন