রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৩

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মৌলবাদ

শাহরিয়ার কবির
৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় বিজয়ের এক বছরেরও কম সময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থপতিরা সদ্যজাত রাষ্ট্রের জন্য যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন তা ছিল অনন্যসাধারণ এক রাষ্ট্রীয় দলিল। এই সংবিধানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের চার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল- ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’, ‘জাতীয়তাবাদ’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলমান অধ্যুষিত এবং অর্থনৈতিকভাবে পেছনের সারির একটি দেশ চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ভেতর ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। যদিও বাঙালী জাতীয়তাবাদ চরিত্রগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, তারপরও রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক রাখার জন্য আমাদের সংবিধান প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কথা বলেছেন। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে সাংবিধানিকভাবে ধর্মের নামে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।
এ বিষয়ে আমি এর আগেও লিখেছি, ‘বাংলাদেশে সেক্যুলারিজমের ধারণা পশ্চিমের চেয়ে বহুলাংশে স্বতন্ত্র। বাংলাদেশে এবং ভারতেও সেক্যুলারিজম বলতে বোঝায় রাষ্ট্র ও ধর্মের বিচ্ছিন্নতা (Separation of state from religion), ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা নয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন- “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দিবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রের কারো নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কারো বাধা দিবার মতো ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রিস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হলো, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার বাংলাদেশের মাটিতে চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে- আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” (গণপরিষদের ভাষণ, ১২ অক্টোবর ১৯৭২)

‘ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল- যা সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে কোন সেক্যুলার গণতান্ত্রিক দেশে সম্ভব হয়নি। এই সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে বর্তমানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার ও জঙ্গী মৌলবাদের জেহাদী উন্মাদনা দেখতে হতো না।

’৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের পর এটি দুই ধরনের সমালোচনা শিকার হয়। এক পক্ষ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, যারা ইসলামকে মনে করে পরিপূর্ণ জীবনবিধান যা রাষ্ট্র-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি সবকিছু তাদের ব্যাখ্যা ও বিধান অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করবে। অপরপক্ষ হচ্ছে সমাজতন্ত্রী ও কমিউনিস্টরা, যারা পশ্চিমের প্রভাবে ধর্মকে ব্যক্তি ও সমাজজীবন থেকে নির্বাসনের পক্ষে। তাদের বক্তব্য ছিল ‘সেক্যুলারিজম’-এর প্রকৃত বাংলা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ নয়, ‘ইহজাগতিকতা’। অপরদিকে মৌলবাদীরা বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে আক্রমণ করেছে এই বলে যে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হচ্ছে নাস্তিকতা, রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলে মানুষের ধর্মপালন ও প্রচারের স্বাধীনতা থাকবে না। মৌলবাদী নয়, এমন দক্ষিণপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা ছিল-’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে ঢুকিয়ে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি ও ধর্মের প্রতি অনুরাগের বিষয়টি উপেক্ষা করেছেন। শতকরা ৮৫% মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোগী যাঁরা ’৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করেছেন তাঁরা ধর্মকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি থেকে পৃথক করার কথা বললেও ব্যক্তিজীবনে ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন। যে কারণে ইংরেজি সেক্যুলারিজমের বাংলা তাঁরা ‘ইহজাগতিকতা’ করেননি, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ করেছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বার বার তাঁদের বলতে হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়।’

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় প্রধান সহযোগী জামায়াতে ইসলামী যে কারণে ইসলামের প্রতিপক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেছিল একই কারণে ’৭২-এর সংবিধানও তাদের কাছে ছিল ইসলামের প্রতিপক্ষ। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ’৭১-এ সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। সাঈদীর বিভিন্ন ওয়াজে কীভাবে রাষ্ট্রের চার মূলনীতিকে ইসলামের প্রতিপক্ষ বানিয়ে এর প্রতি বিষোদগার করা হয়েছে, কীভাবে অন্যান্য ধর্ম এবং অমুসলিম নাগরিকদের বিরুদ্ধে কদর্য সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে- কিছু নমুনা দেয়া হয়েছে আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘জিহাদের প্রতিকৃতি’তে।

’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মকে অবৈধতা প্রদানের পাশাপাশি এর দর্শনকে বাংলাদেশের মাটিতে যেভাবে সমাধিস্থ করেছে, পাকিস্তানী শাসকরা এবং তাদের এদেশীয় তল্পিবাহকরা কখনও তা মেনে নেয়নি। এ কারণেই তারা ১৯৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী চার শীর্ষ নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতাদের হত্যা না করলে ৩০ লাখ শহীদের রক্তে লেখা সংবিধান থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা মুছে ফেলা সম্ভব হতো না। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীর দ্বারা সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা, ‘বাঙালী জাতীয়তাবাদ’ ও সমাজতন্ত্র মুছে ফেলে শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ’ এবং মুখবন্ধে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ বিশ্বাস...’ ইত্যাদি সংযোজন করে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় জেনারেল এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মূল সংবিধানের চার মূলনীতি পুনঃসংযোজন করলেও জেনারেল জিয়ার ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং জেনারেল এরশাদের ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রেখে দিয়ে এটিকে স্ববিরোধী এক সংবিধানে পরিণত করেছে। ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সম্পূর্ণভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতলবে ইসলামের নামে বাংলাদেশের সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতা প্রবর্তন করেছেন। এ বিষয়ে তখন আমি লিখেছিলাম- ‘ইসলামের ইতিহাস ও মহানবীর (সা.) শিক্ষার আলোকে যদি দেখি- সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ রাখা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও অপ্রয়োজনীয়। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের স্বগোত্রীয় মৌলবাদী দলগুলো দাবি করে কোরআন নাকি তাদের সংবিধান। তারা মানবরচিত সংবিধান, আইন-আদালত মানে না। তাদের এই বক্তব্য থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় ইসলামের তকমাধারী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্ম নিয়ে বৈশ্যবৃত্তির স্বরূপ। যে কোন ধার্মিক মুসলমান বিশ্বাস করেন কোরান আল্লাহর কালাম, কোরআনের একটি হরফও বদলানো যায় না। সংবিধান হচ্ছে মানুষের শাসিত রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন ও নিয়মকানুন। সংবিধান হচ্ছে রাষ্ট্রের কাণ্ডারিদের সঙ্গে জনগণের চুক্তিবিশেষ-যা প্রয়োজন ও নিয়ম অনুযায়ী সংশোধন ও পরিবর্তন করা যায়।

‘বিশ্বের প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র মদিনার সংবিধান রচনা করেছিলেন স্বয়ং মহানবী (স.)। তিনি চাইলে কোরআনকে মদিনার সংবিধান হিসেবে চালু করতে পারতেন, ইসলামকে মদিনার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা দিতে পারতেন। মহানবী (স.) তেমন কিছু করেননি বরং তাঁর সংবিধানে মদিনার মুসলিম ও অমুসলিম নাগরিকদের সমান অধিকার দেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রকে কারও ধর্মের বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়া হয়নি এবং অমুসলিমদের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। যে কারণে ৬২২ সালে মহানবী (স.) কর্তৃক প্রণীত মদিনার সংবিধানকে গণ্য করা হয় বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান হিসেবে।

‘ধার্মিক মুসলমানরা বিভিন্ন ইমামের বিধান মেনে চলেন। সুন্নি মুসলমানরা যে চার ইমামকে অনুসরণ করেন তাঁরা হচ্ছেন-১) ইমাম মালিক, ২) ইমাম আল শাফি, ৩) ইমাম আবু হানিফা ও ৪) ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল। অধিকাংশ সুন্নি মুসলমান ইমাম আবু হানিফার অনুসারী, যাদের বলা হয় হানাফি। মওদুদিবাদী জামায়াতীরা তথা ওহাবিরা নিজেদের হানাফি বলে দাবি করলেও অনুসরণ করে ইমাম হাম্বলের বিধান। চার ইমামের ভেতর সবচেয়ে রক্ষণশীল হচ্ছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, যিনি জেহাদকে প্রত্যেক মুসলমানদের জন্য ফরজ করেছেন। কোরআনের উৎসের ব্যাখ্যা নিয়ে বাগদাদের খলিফা মামুনের সঙ্গে তার মতপার্থক্য চরম আকার ধারণ করলে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল বলেছিলেন, খলিফা যেন রাজ্য শাসন ও রাজনীতির মধ্যে নিজের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখেন, ধর্মের বিষয়ে যেন নাক না গলান; কারণ ধর্মের ব্যাখ্যা দেয়ার এখতিয়ার ইমামের, খলিফার নয়। ইমাম ইবনে হাম্বলের এই বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে রাজনীতি থাকবে রাজনীতির জায়গায়, ধর্ম থাকবে ধর্মের জায়গায়। জামায়াতী ও ওহাবীদের মোনাফেকী হচ্ছে- দরকার মতো তারা হানাফি হবে, আবার তাদের দরকার হলে হাম্বলি হবে, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক মতলবে ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির খিচুড়ি পাকিয়ে শান্তির ধর্ম ইসলামকে কলুষিত করবে এবং ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ ধর্মভীরু মানুষদের তা গেলাবে।

‘মওদুদীবাদী, ওহাবীবাদীরা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য, নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের জন্য দেশে দেশে ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে- তাদের কৌশল যখন ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল অনুসরণ করে। ইসলামের ব্যাখ্যা নিয়ে আমিনীদের সঙ্গে নিজামীদের গুরুতর মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু যখনই ক্ষমতার মূলো নাকের ডগায় ঝোলে তখনই তারা আদর্শগত যাবতীয় বিরোধ ভুলে গিয়ে মূলোয় দাঁত বসাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।’ (পঞ্চদশ সংশোধনীর আলোকে বাংলাদেশের সংবিধান, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, নবেম্বর ২০১১)

বাংলাদেশের আমজনতাকে শাসকরা সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী মনে করলেও ইতিহাসে বার বার দেখেছি এদেশের মাটিতে মৌলবাদ কখনও শেকড় গাঁড়তে পারেনি। ধর্মের নামে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের মতো মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব আমরা ’৭১-এ দেখেছি, আবার দেখেছি ২০০১ থেকে ২০০৬-এ বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে। সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের জন্য জামায়াত-বিএনপি একই কৌশল অবলম্বন করেছে। এবার আমাদের ভরসা হচ্ছে শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের মহাজাগরণ, যারা নিজেদের দাবি করেছে- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আন্দোলনের সন্তান। একুশ বছর আগে জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং তাদের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে যে নাগরিক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীপ্ত শাহবাগের মহাজাগরণের নায়করা তার নেতৃত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। ছাত্র-জনতার এই মহাজাগরণ ঢাকার শাহবাগের চত্বর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জামায়াত-বিএনপি যত বেশি প্রজন্ম চত্বরের তরুণদের ‘শাহবাগী নাস্তিক, ‘মুরতাদ’, ‘কাফের’ ফতোয়া দিয়ে হত্যার হুমকি দিচ্ছে, ততই তারা সাধারণ মানুষের ঘৃণা কুড়োচ্ছে।

শাহবাগের গণজাগরণের নেতারা বার বার বলেছেন তাদের আন্দোলন ইসলাম বা কোন ধর্মের বিরুদ্ধে নয়। তারা স্লোগান দিচ্ছেন-‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে চরম উস্কানিমূলক বক্তব্য ও ফতোয়া অব্যাহত রয়েছে। সকল উস্কানি সত্ত্বেও তারা যুদ্ধাপরাধী ও মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনের কথা বলছেন। তাদের চারপাশে মৌলবাদী হিংস্র শ্বাপদরা যেভাবে উন্মত্ত সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালাচ্ছে, যেভাবে তারা রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করছে- সরকারের গান্ধীবাদী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু আমাদের শিখিয়েছেন অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলনকে কীভাবে রূপান্তরিত করতে হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে।

এবারের যুদ্ধ বাংলাদেশকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার করাল থাবা থেকে মুক্ত করবার জন্য। অতীতে আমরা জয়ী হয়েছি, আগামীতে আমরাই জয়ী হব। এই জয় ইতিহাস নির্ধারিত। মৌলবাদ জয়ী হলে সভ্যতার অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হবে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণে সরকার যত কালক্ষেপণ করবে হত্যা ও ধ্বংসের পরিমাণ তত বৃদ্ধি পাবে। জামায়াতে ইসলামীসহ সকল মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ না করলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় কখনও বাংলাদেশ গড়া যাবে না। শাহবাগের তরুণরা রাষ্ট্রকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের ঋণের দায়। গণহত্যাকারীদের রাজনীতি বহাল রেখে শুধু ব্যক্তির বিচার করলেই এ দায় থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।
২৩ মার্চ ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন