এসএম সাকিল
চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশ আমি দেখেছি। এই নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে শাহবাগ থেকে। আর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী শাহবাগকে নতুন করে জন্ম দিয়েছে। শাহবাগকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে প্রায় কোটি জনতা। এসেছেন শহীদ জননীরা, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। এসেছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোররা।
চোখের সামনে নতুন এক বাংলাদেশ আমি দেখেছি। এই নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে শাহবাগ থেকে। আর লাখ লাখ তরুণ-তরুণী শাহবাগকে নতুন করে জন্ম দিয়েছে। শাহবাগকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে প্রায় কোটি জনতা। এসেছেন শহীদ জননীরা, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা। এসেছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোররা।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ যেমন একদিনে শুরু হয়নি; তেমনি শাহবাগের আন্দোলনও হঠাৎ জন্ম নেয়নি।
শাহবাগ হচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, যা ৪২ বছর ধরে জমে জমে শাহবাগে বিস্ফোরিত হয়েছে।
১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত এই ভূখ ের মানুষ যখন তার রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল, তখন তারা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে প্রাণ দিয়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিস্ফোরিত হয়ে ১৯৭১ সালে আমাদের একটি স্বাধীন দেশের জন্ম দিয়েছে।
৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে দেশটা স্বাধীন হয় ঠিকই, কিন্তু কলঙ্কমুক্ত হতে পারেনি এই বাংলা মা।
৪২ বছর স্বাধীনতাবিরোধীরা এ দেশটাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে গেছে। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে স্বাধীনতাবিরোধীদের মদদও দেওয়া হয়েছে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা মুখ বুজে তা সহ্য করেছেন। সবকিছুরই একটা শেষ আছে। সেই শেষটা দেখার জন্যই তরুণ প্রজন্ম নতুন করে 'এক' হয়েছে।
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩। আমার চোখে দেখা নতুন এক বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছিলাম অনেক বছর ধরে। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না। মিছিল-সমাবেশ দূরের কথা, কোনোদিন মাঠেও খেলতে যাইনি। আবার কম্পিউটারে বসে গেম খেলার মানুষও আমি নই। চেনাজানা মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রের অসঙ্গতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতাম। এক সময় সেই আলোচনা শুরু করলাম ফেসবুকে। ফেসবুকের মাধ্যমে সবাই যেভাবে আলোচনা-সমালোচনা করেন, তা দেখে একটা পেজ খুললাম, যার নাম দিলাম_ 'ফেসবুক ইজ এ রিয়াল ডেমোক্রেসি'। স্লোগানটা থাকে 'আমরা ফেসবুকে নয়, আমাদের রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের সঠিক প্রয়োগ চাই। তবে চর্চা হোক ফেসবুক থেকেই।'
অনেকে সমালোচনা করে বলেছেন, ফেসবুকে আলোচনা-সমালোচনা করে লাভ কী? আমার ভাষ্য ছিল, আমরা ফেসবুকে আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার নানা অসঙ্গতি নিয়ে যেহেতু আলোচনা শুরু করেছি, একদিন সমাধানের পথও ফেসবুকের মাধ্যমেই শুরু করতে পারব।
তার বড় প্রমাণ ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। ফেসবুকের মাধ্যমেই ডাক দেওয়া হয়েছিল আন্দোলনের। দুপুর আড়াইটায় ডাক পেলাম শাহবাগে এক হব। প্রতিবাদ জানাব_ ৩৪৪ জন মানুষ হত্যাকারী কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায় মানি না। সেই ডাকেই ঘর ছেড়ে ছুটে গেলাম শাহবাগে। একে একে অনেকেই ছুটে এলো। ক্রমান্বয়ে মানুষ বাড়তে থাকল। প্রকাশ পেতে থাকল মানুষের মাঝে জমে থাকা ক্রোধ। সব ক্ষুব্ধ মানুষ এক পর্যায়ে মিছিল নিয়ে শাহবাগের চৌরাস্তা অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দিল। পুলিশ বাধা দিল। ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিবাদে পুলিশ দূরে সরে দাঁড়াল। মোটরসাইকেল নিয়ে চলে গেলাম কালো কাপড় কিনতে। হরতাল থাকায় কাঁটাবন, নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, সায়েন্স ল্যাব, এলিফ্যান্ট রোড ঘুরে বাংলামটর পুকুরপাড়ে এক দোকান থেকে কালো কাপড় কিনে আনলাম। আমার সঙ্গে ছিল আন্দোলনের সহযোদ্ধা খায়রুল ভাই।
সেই কালো কাপড় মাথায় বেঁধে শুরু হলো প্রতিবাদ। প্ল্যাকার্ডে লেখা হলো_
'এমন রায় ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বেইমানি। এই রায় আমরা মানি না',
'কোন আঁতাতে এমন রায় জনগণ জানতে চায়',
'বিচার মানে মুক্তি? হয়েছে কি চুক্তি?'
'এমন রায়ে কাঁদছে চোখ, আমার না হয় ফাঁসি হোক'
'এমন রায় মানি না, রাজপথ ছাড়বো না'।
সেই রাজপথ আমরা ছাড়িনি। রাজপথ না ছাড়ার অঙ্গীকার নিয়ে স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠল শাহবাগ। একেকটি স্লোগানকে মনে হচ্ছিল বাঘের হুঙ্কার! এরই মধ্যে দেখলাম ছাত্র-জনতার মিছিল আসা শুরু হয়েছে। বিকেলের সূর্য যখন পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছিল, তখন শাহবাগ থেকে নতুন বাংলাদেশের সৃষ্টি হচ্ছিল। মোমবাতি কিনতে চলে গেলাম এলিফ্যান্ট রোডে। ফিরে এসে দেখলাম শাকিল আহমেদ অরণ্য ভাই কয়েক হাজার মোমবাতি নিয়ে সবার হাতে পৌঁছে দিয়েছেন। মুহূর্তেই মোমবাতিগুলো জ্বলে উঠল।
'আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।/ এ জীবন পুণ্য করো'_ গানের কথামালার মতোই সবাই মোমের আগুনে নিজেকে পুণ্য করে রাজপথে বসে রইলেন সারারাত। দাবি একটাই_ সব রাজাকারের ফাঁসি চাই।
শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। আন্দোলনের উদ্যোক্তা বা সংগঠক হিসেবে আমরা কয়েকজন ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে মাথায় হলুদ ব্যাজ বাঁধলাম। এরই মধ্যে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে শাহবাগে সহযোগিতা করতে থাকল। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের মূল শক্তি ছিল ছাত্ররা। তাই ২০১৩-এর নতুন প্রজন্মের আন্দোলনে ছাত্র সংগঠনগুলো যখন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করল, তখন আমাদের শক্তি বেড়ে গেল বহু গুণ।
এর পরের ইতিহাস বিশ্ববাসীর জানা। শাহবাগের ডাকে সারাদেশের ৩ মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা, সারাদেশে একসঙ্গে জাতীয় পতাকা ওড়ানো, মোমবাতি প্রজ্বালন_ সবকিছুই জাতিকে আবার একাত্তরের মতো এক জায়গায় নিয়ে এলো।
আবারও একাত্তরের মতো সেই পরাজিত শক্তি জাতিকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। তারা যখন দেখতে পেল, এ জাতি এক হয়ে গেছে, তাদের আর বাঁচার পথ নেই; তখন জাতিকে বিভ্রান্ত করতে বিভিন্ন অপপ্রচার শুরু করল।
পানির স্রোতে যেমন বাঁধ দেওয়া যায় না, তেমনি জনস্রোতে একেকটি অপপ্রচার বিলীন হয়ে গেল। এ জাতি একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে কোনো আপস করবে না।
শাহবাগ অনেক কিছুই নতুন করে সৃষ্টি করল। এই নবপ্রজন্মকে এক হতে দেখে সবাই সমর্থন দিয়ে চলেছেন এবং এ প্রজন্মের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও রয়েছে অনেক। দেশবাসীর স্বপ্ন এখন এই প্রজন্মকে ঘিরে। আমার বিশ্বাস, এই প্রজন্ম গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণ করবে ইনশা আল্লাহ্?।
এসএম সাকিল :শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন