বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

হরতাল আতঙ্কে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক

১ এপ্রিল শুরু এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা
উদ্বেগে বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ও
জনকণ্ঠ, বিভাষ বাড়ৈ ॥ সদ্য শেষ হওয়া এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চলাকালে বিএনপি-জামায়াত জোটের দফায় দফায় হরতালের পর এবার এইচএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়েছে হরতাল আতঙ্ক। আগামী ১ এপ্রিল থেকে দেশের ১০ শিক্ষা বোর্ডে শুরু হবে এইচএসসি, আলিম ও এইচএসসি বিএম পরীক্ষা। কিন্তু আন্দোলনের নামে এ পরীক্ষা চলাকালেও হরতাল দিতে পারে বিরোধী দল বিএনপিÑ এমন খবর প্রকাশ হওয়ার পর দেশজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে লাখ লাখ পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মাঝে। উদ্বিগ্ন শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর কর্মকর্তারাও। এসএসসিতে হরতালের কারণে ছয়টি পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ার বিড়ম্বনার পর এবার এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর ঠিক আগ মুহূর্তে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। বিএনপি-জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানিয়ে তাঁরা বলেছেন, আমাদের ভবিষ্যত গড়ার দায়িত্ব আপনাদের। তাই আমাদের শিক্ষাজীবন রক্ষা করার দায়িত্বও আপনাদের নিতে হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা পরীক্ষার সময়ে দফায় দফায় হরতালের ঘটনায় আসন্ন পরীক্ষা ঠিকভাবে নেয়া সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে বলেছেন, গেল এসএসসি পরীক্ষার মতো যদি আসন্ন এইচএসসি পরীক্ষারও ধারাবাহিকতা নষ্ট হয় তবে সেটা লাখ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য হয়রানি হয়ে যাবে। দেশের স্বার্থের কথা বলে মুখে ফুলঝুরি ফোটালেও দেশের শিক্ষা এমনকি বিশাল এ পরীক্ষার কথা বিবেচনায় না নিয়ে ধ্বংসাত্মক কর্মসূচীর ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ভুক্তভোগী শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে। তাঁরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, পরীক্ষার মধ্যে হরতাল ডাকা যুক্তিহীন, দায়িত্বহীন, জ্ঞানহীন ও অবিবেচকের কাজ। ব্যাপক রাজনৈতিক সঙ্কটেও ইতোপূর্বে পরীক্ষার কথা মাথায় রেখে হরতাল, অবরোধ কর্মসূচী দিয়েছে বিভিন্ন দল। কিন্তু এই সংস্কৃতিকে নষ্ট করছে দুটি দল। বিএনপি-জামায়াতের শিক্ষাবিরোধী লাগাতার অপরাজনীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন দেশের ছাত্রছাত্রী। জিম্মি হয়ে পড়েছে তাঁদের শিক্ষকসহ পুরো পরিবার। দফায় দফায় কর্মসূচী দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবনকে অনিশ্চিত করে ফেলা হচ্ছে। পরীক্ষার সময় হরতাল না দিতে আদালতের আদেশ এবং শিক্ষার স্বার্থে শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া আহ্বানকেও মাথায় আনছে না বিএনপি-জামায়াতের নেতারা। দেশ ও শিক্ষার স্বার্থকে বিবেচনায় আনছে না বলেই তারা গত এসএসসি, জেএসসি পরীক্ষার মতো পাবলিক পরীক্ষার সময়ে হরতাল দিয়ে সমালোচনায় পড়লেও আবার একই সঙ্কট তৈরি করছে। এবার এসএসসি পরীক্ষা শুরুর আগে রাজধানীতে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করেছিল দেশের প্রধান প্রধান স্কুলের শত শত শিক্ষার্থী। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কর্মসূচী থেকে তারা সেদিন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে হরতাল-অবরোধ না দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল। বাংলাদেশ স্টুডেন্ট কাউন্সিল আয়োজিত মানববন্ধনের কর্মসূচীতে শিক্ষার্থীরা এ আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন ততই জোরদার হচ্ছে। দাবি আদায়ে তারা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচী দিচ্ছে। যা দেশের শিক্ষা তথা দেশের জন্য ক্ষতিকর। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের বলছি, আমাদের ভবিষ্যত গড়ার দায়িত্ব আপনাদের। তাই আমাদের শিক্ষাজীবন রক্ষা করার দায়িত্বও আপনাদের নিতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ সংবাদ সম্মেলন করে সেসময়ই রাজনৈতিক দলগুলো কাছে কোটি কোটি শিক্ষার্থী তথা দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোন ফল দেয়নি। গেল প্রাথমিক, জেএসসি ও সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষার সময়ে দেয়া হয় দফায় দফায় হরতাল ও অবরোধ। ওই পরীক্ষায় ছয়টি পরীক্ষা পিছিয়ে নিতে বাধ্য হয় শিক্ষা বোর্ডগুলো। একপর্যায়ে পুরো সময়সূচী পাল্টে যায়। পেছাতে হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা।
একই সঙ্কটে পড়ে সারাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সকল বর্ষের অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষা। অনেক পরীক্ষা তাই এখনও শেষ করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। একপর্যায়ে পরীক্ষা চলাকালে হরতালের বিরুদ্ধে আদেশ চেয়ে আদালতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন একজন অভিভাবক। সঙ্কট কিছুটা হলেও সামাল দিতে মধ্যরাতে ‘এ’ লেভেল এবং ‘ও’ লেভেলের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল শিক্ষার্থীদের। কিন্তু তাতেও সুফল পায়নি শিক্ষার্থীরা। ঠিক এমন অবস্থায় এবার আসন্ন এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময়েও হরতাল দেয়ার হুমকি আসছে বিএনপির নেতাদের পক্ষ থেকে। গণমাধ্যমে বিরোধী দলের হরতালের হুমকির খবর প্রকাশ হওয়ার পর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে পরীক্ষার্থী, অভিভাবক এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বোর্ডের কর্মকর্তাদের মাঝে।
জানা গেছে, চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষার ঘোষিত সময়সূচী অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষা ১ এপ্রিল শুরু হয়ে শেষ হবে ২৮ মে। এরপর ব্যবহারিক পরীক্ষা চলবে ১ থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত। শুধু হরতালের কারণেই গত এসএসসি পরীক্ষায় মোট ৬টি পরীক্ষার তারিখ পেছানোর কারণে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে আতঙ্ক অনেক বেশি। সরকারী বিজ্ঞান কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী আকবর ও তেজগাঁও কলেজের পরীক্ষার্থী হাসনাত বলছিল, এসএসসি পরীক্ষার মতো যদি আমাদের পরীক্ষারও নষ্ট হয় সেটাই এখন ভয়। মূলত এসএসসি পরীক্ষার ভূত তাড়া করছে সকলের মাঝে। এসএসসি পরীক্ষার সময় সরকার প্রথম দিকে হরতালের মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। তাই এইচএসসি নিয়েও ভরসা পাচ্ছেন না অভিভাবকগণ। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি সিলেটে ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে জামায়াত-শিবির হরতাল ডাকলেও এসএসসি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়। তবে হরতালে এই দুই বিভাগের পরীক্ষার্থীদের হরতালের কারণে বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এরপরেও জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতালের কারণে ৪ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষা পিছিয়ে ৮ ফেব্রুয়ারি ও ২৮ ফেব্রুয়ারি পরীক্ষা ৮ মার্চ, ৩ মার্চ রবিবারের পরীক্ষা ৯ মার্চ নেয়া হয়। ৫ মার্চ মঙ্গলবারের পরীক্ষা ৯ মার্চ শনিবার অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও ২৩ ফেব্রুয়ারির পরীক্ষা পেছাতে বাধ্য হয়েছিল বোর্ডগুলো। দীর্ঘ পরীক্ষায় অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায় লাখ লাখ পরীক্ষার্থী। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী রতœার মা রোকসানা আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন, শিক্ষার্থীদের আগামী দিনের ভবিষ্যত ও সকলের সন্তানের কথা চিন্তা করে বিরোধী দলকে হরতাল না দেয়ার কথা বলা হলেও কর্ণপাত করছে না বিএনপি ও জামায়াত। পত্রিকায় বিএনপির চিন্তাভাবনা দেখে এখন আমরা ভয় পাচ্ছি। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন ইতোমধ্যেই বলেছেন, যেসব দল হরতাল দিচ্ছে তাদের কর্মী সমর্থকদের সন্তানরা যদি পরীক্ষার্থী হয়, তবে তাদের জন্য সেটা হয়রানি হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যে সিলেবাস রয়েছে তাতে এমনিতেই শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছিয়ে পড়ে। এর মধ্যে এইচএসসির মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা গ্রহণের সময়কাল যদি হরতালের কারণে দীর্ঘ হয় তবে সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে কলেজ পরিদর্শক ড. শ্রীকান্ত কুমার চন্দ বলেন, হরতাল দিলে অংশগ্রহণকারী ৯ বা ১০ লাখ পরীক্ষার্থীই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয় না বরং পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গেল পরীক্ষা নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে তারপরে চিন্তা বেড়েছে সকলের আরও বেশি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন