আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ছোটবেলায় পাঠ্য কিতাবে একটি কবিতায় পড়েছিলাম, ‘উই আর
ইঁদুরের দেখো ব্যবহার, যাহা পায় তাহা কেটে করে ছারখার।’ বাংলাদেশের
রাজনীতিতে বিএনপি আর জামায়াতের ভূমিকা এই ‘উই আর ইঁদুরের ব্যবহারের’ কথা
স্মরণ করিয়ে দেয়। শুধু কবিতার দু’টি লাইনকে একটু ঘুরিয়ে বলতে হবে- ‘জামায়াত
আর বিএনপির দেখো ব্যবহার, দেশের সমস্ত কিছু করে সংহার।’ বিএনপি ও
জামায়াতের সাম্প্রতিক রাজনীতি তো কেবল সন্ত্রাস আর সংহার।
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যু উপলক্ষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মতিগতি কিছু ফিরেছে বলে মনে হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপনের জন্য বেগম জিয়ার বঙ্গভবনে গমন, সাবেক রাষ্ট্রপতির জানাজায় বিএনপি নেতাদের যোগদান, পূর্বঘোষিত একদিনের হরতাল প্রত্যাহার এসব কিছু দেখে মনে হয়েছিল, সর্বঅমঙ্গলের মধ্যে যেমন কিছু মঙ্গলালোক থাকে, তেমনি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর গভীর সন্তাপের মধ্যেও হয়ত কিছুু সান্ত¡না আছে। সেই সান্ত¡নাটি হলো দেশের সংঘাতময় রাজনীতিতে সমঝোতার আভাস।
বিএনপি ও বিএনপি নেত্রীর গত কয়েক দিনের আচার-আচরণ দেখে মনে হয়েছিল, শত হোক তাঁরা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, বেগম জিয়া নিজে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী। সুতরাং নেত্রী এবং তাঁর দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক শুভ চেতনা হয়ত ফিরে এসেছে। তাঁরা সংঘাত ও সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসবেন। সংসদে যোগ দিয়ে একজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেবেন, প্রয়োজনে তাঁদের মনোনীত একজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দাঁড় করাবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে সংসদের ভেতরে ও বাইরে জনমত গড়ে তোলার জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সর্বাগ্রে সন্ত্রাসী মৌলবাদী জামায়াতের সঙ্গে সংস্র্রব ছিন্ন করবেন এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত দ-দানের দেশব্যাপী দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবেন।
দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের এই প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। সাবেক রাষ্ট্রপতির কবরের মাটি শুকিয়ে না উঠতেই বিএনপি ও জামায়াত তাদের উই ও ইঁদুরের পূর্ব চরিত্রে ফিরে গেছে। জামায়াত ফিরে যাবে এমন একটা সম্ভাবনা সকলেরই মনে ছিল। কারণ গত চার দশকের বেশি সময় ধরে জামায়াত একটি ঘাতক এবং স্বাধীনতাবিরোধী দল। বর্তমানে তাদের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের বিচার হচ্ছে। দু’জন অভিযুক্তকে ইতোমধ্যেই বিচারে মৃত্যুদ-াদেশ এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। পালের গোদা গোলাম আযম এবং আরেকজন অপরাধী কামারুজ্জামানেরও বিচারের রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এ সময় জামায়াতের পক্ষে স্বভাব ত্যাগ ও সন্ত্রাস বর্জন সম্ভব নয়। দেশ জাতি রসাতলে যাক। তারা দল ও দলের ঘাতক সর্দারদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এই ব্যাপারে জামায়াতকে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য বিএনপির একেবারে কোমরে আঁচল বেঁধে একই সন্ত্রাসী রাজনীতিতে নামার দরকারটা কী ছিল? বিএনপি নেত্রী মুখে বলবেন, আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, কাজে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নানা অজুহাতে ভ-ুল করার জন্য জামায়াতীদের সঙ্গে কাঁধ মেলাবেন তা তো হতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতীদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারবে না, এই বিশ্বাস থেকে বেগম জিয়া সব নীতিনৈতিকতা ভুলে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ দাবির বিরুদ্ধে জামায়াতী সন্ত্রাসে শামিল হয়েছেন।
এটা যে ভুল স্ট্র্যাটেজি তা নেত্রীকে বোঝানোর জন্য একজন সুস্থ মস্তিষ্কের উপদেষ্টাও কি তাঁর পাশে নেই? দেশের গত সাধারণ নির্বাচনগুলোর প্যাটার্ন দেখলেই বোঝা যায়, নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন পেলেই সংসদে জামায়াতের আসন সংখ্যা বেড়ে যায়। নইলে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে যায়। বিএনপি ভোট লাভের ক্ষেত্রে জামায়াতের ওপর ততটা নির্ভরশীল নয়।
যদি ধরে নেয়া যায় মার্জিনাল সিটগুলোতে কোন কোন কেন্দ্রে তারা জামায়াতী ভোটের ওপর নির্ভরশীল, তাহলেও দেখা যাবে, জামায়াতের ঘৃণ্য সংস্র্রব ত্যাগ করলে দেশের জামায়াতবিরোধী যে ভোটদাতারা বিএনপিকে ভোট দিতে দেরি করছে না, তাদের সংখ্যা জামায়াতী ভোটের চাইতে অনেক বেশি। বিএনপি একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেকে পুনর্গঠিত করতে পারলে আওয়ামী লীগের জন্য প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কখনও সামরিক বাহিনীর একাংশের সঙ্গে, কখনও জামায়াতের দেশদ্রোহী ভূমিকার সঙ্গে সন্ধি করে, তাদের সহযোগী সেজে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে শামিল হতে হবে না।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রয়াণের পর অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল, বিএনপি ও বিএনপি নেত্রীর মতিগতি বুঝি ফিরেছে। তিনি চক্রান্ত, সন্ত্রাস এবং দেশবিরোধী জামায়াতী তা-বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশময় এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে অথবা নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দুর্নীতিবাজ ও পলাতক পুত্রকে দেশে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা না চালিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশবাসীর ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন সংগঠিত করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু গত রবিবার (২৪ মার্চ) তিনি বগুড়ায় জনসভায় যে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং পরদিন (২৫ মার্চ) তাঁর দল দেশে ২৭ ও ২৮ মার্চ তাঁদের কর্মসূচী হিসেবে যে হরতাল ডেকেছেন, তাতে আমাদের এই ধারণাটি শুধু পাল্টায়নি, মনে হয়েছে উই আর ইঁদুর তাঁদের পূর্ব স্বভাবে আবার অতিদ্রুত ফিরে গেছে। বেগম জিয়া জামায়াত এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা চক্রের চাপের কাছে আবার নতিস্বীকার করেছেন।
বগুড়ায় বেগম জিয়া যেসব কথা বলেছেন, তা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। সে সম্পর্কে আলোচনায় আমি পরে আসছি। আগে ২৭ ও ২৮ মার্চ বিএনপি কোন প্রকৃত ইস্যু ছাড়াই তড়িঘড়ি কেন হরতালের ডাক দিল সে সম্পর্কে আমার ধারণাটা বলি। বিএনপি জানে, দেশের মানুষ আর হরতাল পছন্দ করে না। বিএনপির ডাকে হরতাল এখন আর হয় না। যা হয় তাহলো তাদের সন্ত্রাসের ভয়ে মানুষ গাড়িঘোড়া বেশি রাজপথে নামায় না। হরতালের নামে বিএনপি ও জামায়াত যা করে তাহলো পকেট সন্ত্রাস সৃষ্টি। মফস্বলে যেখানে পুলিশের সংখ্যাশক্তি অথবা উপস্থিত কম, সেখানে ব্যাপকভাবে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটানো এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধদের বাড়িঘর লুট করা ও তাদের ওপর নির্যাতন চালানো বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত কর্মসূচী।
এই পকেট সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘু নির্যাতন দ্বারা যে সরকারের পতন ঘটানো যাবে না এটা জেনেও বিএনপির এত শীঘ্র হরতাল ডাকার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছেÑ এক. গোলাম আযমের বিচার শেষ হয়েছে এবং তার মামলার রায়দানের দিনটি খুবই নিকটে ঘনিয়ে এসেছে। এ সময় জামায়াতের মরিয়া হয়ে চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে এবং তাদের চাপের মুখে হরতাল না ডেকে বিএনপির উপায় নেই।
দুই, ২৭ মার্চ ঢাকায় এক দীর্ঘ ফ্লাইওভারের দ্বার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এই উড়াল সেতুটি মিরপুর থেকে বনানী হয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেছে। তাতে ঢাকা থেকে বিমানবন্দরে যেতে যানজটের জন্য যে ছ’সাত ঘণ্টা লাগে, তা কমে ৪৫-৫০ মিনিটে দাঁড়াতে পারে। বর্তমান সরকার রাজধানীতে আরও ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে এবং ভয়াবহ যানজট সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে নগরীর পানি, বিদ্যুত সমস্যা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও সরকার সাফল্যের পরিচয় দেখাচ্ছে। বিএনপির ‘ব্যর্থ সরকারের’ সেøাগান এখন আর হালে পানি পাচ্ছে না। সুতরাং ডেসপারেট বিএনপি নেত্রী এই নতুন ফ্লাইওভারের উদ্বোধনের দিনটি বানচাল করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন। কিন্তু নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে তিনি পারবেন কি? বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের অনেক চেষ্টা করেও তিনি বাঁচাতে পারেননি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তিনি বাঁচাতে পারবেন কি?
বগুড়ায় ২৪ মার্চ রবিবার খালেদা জিয়া তঁাঁর বক্তৃতায় যেসব কথা বলেছেন, তা যে চরম রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তব্য এবং এজন্য তঁাঁর বিচার ও দ- হওয়া উচিত এ কথা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য তিনি দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রকাশ্যে উস্কানি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাদের সামরিক বাহিনী বসে থাকবে না। দেশে অশান্তির আগুন জ্বলছে। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সময় মতো এগিয়ে আসবে। বিদেশে শান্তি রক্ষায় তারা যদি ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে দেশে শান্তি রক্ষায় তারা এগিয়ে আসবে না কেন?’
প্রথম কথা বিদেশে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষায় জাতিসংঘ দ্বারা আমন্ত্রিত ও নিযুক্ত হয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে খালেদা জিয়া এবং তাঁর মিত্র জামায়াত যে অশান্তি সৃষ্টি করেছে তা দমনের জন্য একমাত্র সরকারই সেনাবাহিনী নিযুক্ত করতে পারে। খালেদা জিয়া পারেন না। শান্তি প্রতিষ্ঠার অযুুহাতে দেশের সেনাবাহিনীকে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা বলা তো রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহ। তিনি এবং তাঁর দল দেশে অশান্তি সৃষ্টি করবে আর সেই অশান্তি দমনের নামে দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চাইবেন, এটা ঘোরতর রাষ্ট্রদ্রোহী ভূমিকা। এটা নিজে গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি করে গৃহস্থের বিরুদ্ধেই পুলিশ লাগানোর চেষ্টা করার মতো।
বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপি যুক্তভাবে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করছে এবং দেশবাসীর ধনপ্রাণের নিরাপত্তা বিঘিœত ও বিপন্ন করছে, তাতে অনেকেই মনে করেন সরকারের উচিত ছিল বহু আগে সামরিক বাহিনী তলব করা ও কঠোর হাতে এই সন্ত্রাস ও অশান্তি দমন করা। হাসিনা সরকার জনসমর্থনের বলে বর্তমানে এতটাই বলীয়ান যে, দেশরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত সেনাবাহিনীকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনে ব্যবহার করা এখনো প্রয়োজন মনে করেনি। যখন তখন সেনাবাহিনীকে ডাকা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্রও নয়।
বরং বেগম জিয়াই যে জনসমর্থনে বলীয়ান হয়ে এই সরকারের পতন ঘটাতে পারবেন এবং নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবেন এই সম্ভাবনা অদূরভবিষ্যতে নেই দেখে সম্পূর্ণ হতাশ হয়েই সেনাবাহিনীকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অপচেষ্টা করছেন। বগুড়া-ভাষণ তার প্রমাণ। এটা যে হতাশ মনের প্রলাপোক্তি এবং দেশ ও রাষ্ট্রবিরোধী উক্তি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেগম জিয়া এই অপরাধমূলক কাজটি আজ নতুন করছেন তা নয়। অতীতে বার বার করেছেন। তিনি পুলিশ ও সরকারী অফিসার এবং কর্মচারীদের বার বার ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘এই সরকারের হুকুম মানবেন না। যাঁরা মানছেন, তাঁদের নামের তালিকা আমরা করছি। যথাসময়ে (ক্ষমতায় এসে) তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের এভাবে হুমকি প্রদান এবং সরকারের নির্দেশনা না মানার জন্য উস্কানি প্রদান যে ‘ট্রিজনের’ সমতুল্য অপরাধ তার প্রমাণ উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোতেও রয়েছে। বেগম জিয়া কি তা জানেন না অথবা তার উপদেষ্টারা তাঁকে তা জানাননি?
অথচ খালেদা জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত তাঁর অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে যেসব সরকারী কর্মচারী ‘জনতার মঞ্চ’ গড়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেবার দেশপ্রেমিক সরকারী কর্মচারীরা জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে জনতার পক্ষ নিয়েছিলেন। তাতে তাঁরা যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে থাকেন তাহলে বর্তমানে একটি নির্বাচিত ও বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী ও সেনাবাহিনীকে উস্কানি প্রদান কি প্রকাশ্য দেশদ্রোহিতা নয়? তার কি বিচার হওয়া উচিত নয়?
বেগম জিয়ার এই ধরনের পৌনঃপুনিক রাষ্ট্রদ্রোহমূলক উক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে হাসিনা সরকারের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা কিসের লক্ষণ তা আমি জানি না। এটা কি সরকারের কৌশলগত দুর্বলতা, না উদারতা? যদি কৌশলগত দুর্বলতা হয় তাহলে বলব, এই কৌশল পরিবর্তনের সময় এসেছে। আর উদারতা হলে বলব, স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার হানাদারদের কোলাবরেটর ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুর রহিম এবং আরও অনেকের প্রতি উদারতা দেখিয়ে যে প্রতিদান পেয়েছে, হাসিনা সরকার যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটায়। খালেদা জিয়া যদি গণতান্ত্রিক পন্থায় গণতান্ত্রিক বিরোধিতার রাজনীতি না করতে চান, তাহলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁকে সংযত ও নিবৃত্ত করার এটাই উপযুক্ত সময়।
লন্ডন, ২৬ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৩
রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যু উপলক্ষ করে বিএনপি ও জামায়াতের মতিগতি কিছু ফিরেছে বলে মনে হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপনের জন্য বেগম জিয়ার বঙ্গভবনে গমন, সাবেক রাষ্ট্রপতির জানাজায় বিএনপি নেতাদের যোগদান, পূর্বঘোষিত একদিনের হরতাল প্রত্যাহার এসব কিছু দেখে মনে হয়েছিল, সর্বঅমঙ্গলের মধ্যে যেমন কিছু মঙ্গলালোক থাকে, তেমনি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর গভীর সন্তাপের মধ্যেও হয়ত কিছুু সান্ত¡না আছে। সেই সান্ত¡নাটি হলো দেশের সংঘাতময় রাজনীতিতে সমঝোতার আভাস।
বিএনপি ও বিএনপি নেত্রীর গত কয়েক দিনের আচার-আচরণ দেখে মনে হয়েছিল, শত হোক তাঁরা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল, বেগম জিয়া নিজে প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী। সুতরাং নেত্রী এবং তাঁর দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক শুভ চেতনা হয়ত ফিরে এসেছে। তাঁরা সংঘাত ও সন্ত্রাসের পথ ত্যাগ করে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ফিরে আসবেন। সংসদে যোগ দিয়ে একজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেবেন, প্রয়োজনে তাঁদের মনোনীত একজন যোগ্য ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দাঁড় করাবেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবিতে সংসদের ভেতরে ও বাইরে জনমত গড়ে তোলার জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলবেন। সর্বাগ্রে সন্ত্রাসী মৌলবাদী জামায়াতের সঙ্গে সংস্র্রব ছিন্ন করবেন এবং ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত দ-দানের দেশব্যাপী দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবেন।
দেশের মানুষের সঙ্গে আমাদের এই প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি। সাবেক রাষ্ট্রপতির কবরের মাটি শুকিয়ে না উঠতেই বিএনপি ও জামায়াত তাদের উই ও ইঁদুরের পূর্ব চরিত্রে ফিরে গেছে। জামায়াত ফিরে যাবে এমন একটা সম্ভাবনা সকলেরই মনে ছিল। কারণ গত চার দশকের বেশি সময় ধরে জামায়াত একটি ঘাতক এবং স্বাধীনতাবিরোধী দল। বর্তমানে তাদের শীর্ষ নেতাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের বিচার হচ্ছে। দু’জন অভিযুক্তকে ইতোমধ্যেই বিচারে মৃত্যুদ-াদেশ এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়েছে। পালের গোদা গোলাম আযম এবং আরেকজন অপরাধী কামারুজ্জামানেরও বিচারের রায় ঘোষিত হতে যাচ্ছে। এ সময় জামায়াতের পক্ষে স্বভাব ত্যাগ ও সন্ত্রাস বর্জন সম্ভব নয়। দেশ জাতি রসাতলে যাক। তারা দল ও দলের ঘাতক সর্দারদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এই ব্যাপারে জামায়াতকে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য বিএনপির একেবারে কোমরে আঁচল বেঁধে একই সন্ত্রাসী রাজনীতিতে নামার দরকারটা কী ছিল? বিএনপি নেত্রী মুখে বলবেন, আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, কাজে সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নানা অজুহাতে ভ-ুল করার জন্য জামায়াতীদের সঙ্গে কাঁধ মেলাবেন তা তো হতে পারে না। কেউ কেউ বলছেন, জামায়াতীদের সমর্থন ও সহযোগিতা না পেলে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারবে না, এই বিশ্বাস থেকে বেগম জিয়া সব নীতিনৈতিকতা ভুলে জামায়াতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছেন। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ দাবির বিরুদ্ধে জামায়াতী সন্ত্রাসে শামিল হয়েছেন।
এটা যে ভুল স্ট্র্যাটেজি তা নেত্রীকে বোঝানোর জন্য একজন সুস্থ মস্তিষ্কের উপদেষ্টাও কি তাঁর পাশে নেই? দেশের গত সাধারণ নির্বাচনগুলোর প্যাটার্ন দেখলেই বোঝা যায়, নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন পেলেই সংসদে জামায়াতের আসন সংখ্যা বেড়ে যায়। নইলে প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে যায়। বিএনপি ভোট লাভের ক্ষেত্রে জামায়াতের ওপর ততটা নির্ভরশীল নয়।
যদি ধরে নেয়া যায় মার্জিনাল সিটগুলোতে কোন কোন কেন্দ্রে তারা জামায়াতী ভোটের ওপর নির্ভরশীল, তাহলেও দেখা যাবে, জামায়াতের ঘৃণ্য সংস্র্রব ত্যাগ করলে দেশের জামায়াতবিরোধী যে ভোটদাতারা বিএনপিকে ভোট দিতে দেরি করছে না, তাদের সংখ্যা জামায়াতী ভোটের চাইতে অনেক বেশি। বিএনপি একটি বিকল্প গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেকে পুনর্গঠিত করতে পারলে আওয়ামী লীগের জন্য প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কখনও সামরিক বাহিনীর একাংশের সঙ্গে, কখনও জামায়াতের দেশদ্রোহী ভূমিকার সঙ্গে সন্ধি করে, তাদের সহযোগী সেজে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে শামিল হতে হবে না।
সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের প্রয়াণের পর অনেকের মতো আমারও মনে হয়েছিল, বিএনপি ও বিএনপি নেত্রীর মতিগতি বুঝি ফিরেছে। তিনি চক্রান্ত, সন্ত্রাস এবং দেশবিরোধী জামায়াতী তা-বের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দেশময় এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে অথবা নির্বাচন ছাড়াই ক্ষমতায় যাওয়ার এবং দুর্নীতিবাজ ও পলাতক পুত্রকে দেশে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা না চালিয়ে গণতান্ত্রিক পন্থায় দেশবাসীর ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন সংগঠিত করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু গত রবিবার (২৪ মার্চ) তিনি বগুড়ায় জনসভায় যে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং পরদিন (২৫ মার্চ) তাঁর দল দেশে ২৭ ও ২৮ মার্চ তাঁদের কর্মসূচী হিসেবে যে হরতাল ডেকেছেন, তাতে আমাদের এই ধারণাটি শুধু পাল্টায়নি, মনে হয়েছে উই আর ইঁদুর তাঁদের পূর্ব স্বভাবে আবার অতিদ্রুত ফিরে গেছে। বেগম জিয়া জামায়াত এবং পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা চক্রের চাপের কাছে আবার নতিস্বীকার করেছেন।
বগুড়ায় বেগম জিয়া যেসব কথা বলেছেন, তা রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহের পর্যায়ে পড়ে। সে সম্পর্কে আলোচনায় আমি পরে আসছি। আগে ২৭ ও ২৮ মার্চ বিএনপি কোন প্রকৃত ইস্যু ছাড়াই তড়িঘড়ি কেন হরতালের ডাক দিল সে সম্পর্কে আমার ধারণাটা বলি। বিএনপি জানে, দেশের মানুষ আর হরতাল পছন্দ করে না। বিএনপির ডাকে হরতাল এখন আর হয় না। যা হয় তাহলো তাদের সন্ত্রাসের ভয়ে মানুষ গাড়িঘোড়া বেশি রাজপথে নামায় না। হরতালের নামে বিএনপি ও জামায়াত যা করে তাহলো পকেট সন্ত্রাস সৃষ্টি। মফস্বলে যেখানে পুলিশের সংখ্যাশক্তি অথবা উপস্থিত কম, সেখানে ব্যাপকভাবে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ঘটানো এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধদের বাড়িঘর লুট করা ও তাদের ওপর নির্যাতন চালানো বিএনপি-জামায়াতের অঘোষিত কর্মসূচী।
এই পকেট সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘু নির্যাতন দ্বারা যে সরকারের পতন ঘটানো যাবে না এটা জেনেও বিএনপির এত শীঘ্র হরতাল ডাকার কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছেÑ এক. গোলাম আযমের বিচার শেষ হয়েছে এবং তার মামলার রায়দানের দিনটি খুবই নিকটে ঘনিয়ে এসেছে। এ সময় জামায়াতের মরিয়া হয়ে চেষ্টার সঙ্গে যুক্ত না হয়ে এবং তাদের চাপের মুখে হরতাল না ডেকে বিএনপির উপায় নেই।
দুই, ২৭ মার্চ ঢাকায় এক দীর্ঘ ফ্লাইওভারের দ্বার উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এই উড়াল সেতুটি মিরপুর থেকে বনানী হয়ে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত গেছে। তাতে ঢাকা থেকে বিমানবন্দরে যেতে যানজটের জন্য যে ছ’সাত ঘণ্টা লাগে, তা কমে ৪৫-৫০ মিনিটে দাঁড়াতে পারে। বর্তমান সরকার রাজধানীতে আরও ফ্লাইওভার নির্মাণ করেছে এবং ভয়াবহ যানজট সমস্যা নিরসনের চেষ্টা চালাচ্ছে। একই সঙ্গে নগরীর পানি, বিদ্যুত সমস্যা কমিয়ে আনার ব্যাপারেও সরকার সাফল্যের পরিচয় দেখাচ্ছে। বিএনপির ‘ব্যর্থ সরকারের’ সেøাগান এখন আর হালে পানি পাচ্ছে না। সুতরাং ডেসপারেট বিএনপি নেত্রী এই নতুন ফ্লাইওভারের উদ্বোধনের দিনটি বানচাল করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়েছেন। কিন্তু নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করতে তিনি পারবেন কি? বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের অনেক চেষ্টা করেও তিনি বাঁচাতে পারেননি। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের তিনি বাঁচাতে পারবেন কি?
বগুড়ায় ২৪ মার্চ রবিবার খালেদা জিয়া তঁাঁর বক্তৃতায় যেসব কথা বলেছেন, তা যে চরম রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বক্তব্য এবং এজন্য তঁাঁর বিচার ও দ- হওয়া উচিত এ কথা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই। একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার জন্য তিনি দেশের সামরিক বাহিনীকে প্রকাশ্যে উস্কানি দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আমাদের সামরিক বাহিনী বসে থাকবে না। দেশে অশান্তির আগুন জ্বলছে। তারা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সময় মতো এগিয়ে আসবে। বিদেশে শান্তি রক্ষায় তারা যদি ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে দেশে শান্তি রক্ষায় তারা এগিয়ে আসবে না কেন?’
প্রথম কথা বিদেশে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষায় জাতিসংঘ দ্বারা আমন্ত্রিত ও নিযুক্ত হয়ে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশে খালেদা জিয়া এবং তাঁর মিত্র জামায়াত যে অশান্তি সৃষ্টি করেছে তা দমনের জন্য একমাত্র সরকারই সেনাবাহিনী নিযুক্ত করতে পারে। খালেদা জিয়া পারেন না। শান্তি প্রতিষ্ঠার অযুুহাতে দেশের সেনাবাহিনীকে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কথা বলা তো রীতিমতো রাষ্ট্রদ্রোহ। তিনি এবং তাঁর দল দেশে অশান্তি সৃষ্টি করবে আর সেই অশান্তি দমনের নামে দেশের সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে চাইবেন, এটা ঘোরতর রাষ্ট্রদ্রোহী ভূমিকা। এটা নিজে গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাতি করে গৃহস্থের বিরুদ্ধেই পুলিশ লাগানোর চেষ্টা করার মতো।
বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপি যুক্তভাবে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করছে এবং দেশবাসীর ধনপ্রাণের নিরাপত্তা বিঘিœত ও বিপন্ন করছে, তাতে অনেকেই মনে করেন সরকারের উচিত ছিল বহু আগে সামরিক বাহিনী তলব করা ও কঠোর হাতে এই সন্ত্রাস ও অশান্তি দমন করা। হাসিনা সরকার জনসমর্থনের বলে বর্তমানে এতটাই বলীয়ান যে, দেশরক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত সেনাবাহিনীকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনে ব্যবহার করা এখনো প্রয়োজন মনে করেনি। যখন তখন সেনাবাহিনীকে ডাকা একটি গণতান্ত্রিক সরকারের চরিত্রও নয়।
বরং বেগম জিয়াই যে জনসমর্থনে বলীয়ান হয়ে এই সরকারের পতন ঘটাতে পারবেন এবং নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় যাবেন এই সম্ভাবনা অদূরভবিষ্যতে নেই দেখে সম্পূর্ণ হতাশ হয়েই সেনাবাহিনীকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহারের অপচেষ্টা করছেন। বগুড়া-ভাষণ তার প্রমাণ। এটা যে হতাশ মনের প্রলাপোক্তি এবং দেশ ও রাষ্ট্রবিরোধী উক্তি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বেগম জিয়া এই অপরাধমূলক কাজটি আজ নতুন করছেন তা নয়। অতীতে বার বার করেছেন। তিনি পুলিশ ও সরকারী অফিসার এবং কর্মচারীদের বার বার ধমক দিয়ে বলেছেন, ‘এই সরকারের হুকুম মানবেন না। যাঁরা মানছেন, তাঁদের নামের তালিকা আমরা করছি। যথাসময়ে (ক্ষমতায় এসে) তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের এভাবে হুমকি প্রদান এবং সরকারের নির্দেশনা না মানার জন্য উস্কানি প্রদান যে ‘ট্রিজনের’ সমতুল্য অপরাধ তার প্রমাণ উন্নত ইউরোপীয় দেশগুলোতেও রয়েছে। বেগম জিয়া কি তা জানেন না অথবা তার উপদেষ্টারা তাঁকে তা জানাননি?
অথচ খালেদা জিয়া ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত তাঁর অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে সমর্থন জানিয়ে যেসব সরকারী কর্মচারী ‘জনতার মঞ্চ’ গড়েছিলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। সেবার দেশপ্রেমিক সরকারী কর্মচারীরা জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে জনতার পক্ষ নিয়েছিলেন। তাতে তাঁরা যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে থাকেন তাহলে বর্তমানে একটি নির্বাচিত ও বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী ও সেনাবাহিনীকে উস্কানি প্রদান কি প্রকাশ্য দেশদ্রোহিতা নয়? তার কি বিচার হওয়া উচিত নয়?
বেগম জিয়ার এই ধরনের পৌনঃপুনিক রাষ্ট্রদ্রোহমূলক উক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে হাসিনা সরকারের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা কিসের লক্ষণ তা আমি জানি না। এটা কি সরকারের কৌশলগত দুর্বলতা, না উদারতা? যদি কৌশলগত দুর্বলতা হয় তাহলে বলব, এই কৌশল পরিবর্তনের সময় এসেছে। আর উদারতা হলে বলব, স্বাধীনতার যুদ্ধে জয়লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার হানাদারদের কোলাবরেটর ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, জামায়াত নেতা মাওলানা আবদুর রহিম এবং আরও অনেকের প্রতি উদারতা দেখিয়ে যে প্রতিদান পেয়েছে, হাসিনা সরকার যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটায়। খালেদা জিয়া যদি গণতান্ত্রিক পন্থায় গণতান্ত্রিক বিরোধিতার রাজনীতি না করতে চান, তাহলে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁকে সংযত ও নিবৃত্ত করার এটাই উপযুক্ত সময়।
লন্ডন, ২৬ মার্চ, মঙ্গলবার, ২০১৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন