বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের সহকারী
সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে
মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের-২ রায়ে জামায়াতের
মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। জামায়াতের নানিবিধ অপকর্ম
তুলে ধরে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, “জামায়াত পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তার
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে।”
বৃহস্পতিবার দেওয়া ২১৫ পৃষ্ঠার রায়ের মোট ৬৫১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮৫ পৃষ্ঠায় ৫৭৪ নম্বর অনুচ্ছেদে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে জামায়াতের ভূমিকা উল্লেখ করা হয়।
এ রায়ে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগগুলোর মধ্যে ১, ২, ৩, ৪ ও ৭ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত এবং ৫ ও ৬নং অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
এর মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এ দু’টি অভিযোগ করা হয়েছে যথাক্রমে সোহাগপুর গণহত্যা ও মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে। ১ (বদিউজ্জামান হত্যা) ও ৭ নম্বর অভিযোগে (দারাসহ ছয় হত্যা ) যাবজ্জীবন এবং ২ নম্বর অভিযোগে (অধ্যক্ষ আব্দুল হান্নানকে নির্যাতন) ১০ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আর প্রমাণিত না হওয়া অন্য দুই অভিযোগ থেকে কামারুজ্জামানকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ১, ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগের ক্ষেত্রে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।
জামায়াত প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল বলেন, “তৎকালীন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামের নেতা গোলাম আযম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। পাকিস্তান রক্ষার নামে তারা বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চেয়েছিল।”
“পরে জামায়াত সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। তারা নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে প্রধানত আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়।”
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ ঢাকা ১৯৭১’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে রায়ে বলা হয়, “মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা প্রসঙ্গে এ বইয়ে বলা হয়, প্রথমে জামায়াত তাদের সমমনা-ধর্মান্ধ ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে শান্তি বাহিনী গঠন করে। পরে পাকিস্তানি বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ সহায়তার লক্ষ্যে সশস্ত্র রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে। এক পর্যাযে তারা আধা সামরিক এই বাহিনীর জন্য সরকারের স্বীকৃতি আদায়েও সমর্থ হয়।”
“সশস্ত্র এ বাহিনী দু’টি পাকিস্তানি সৈন্যদের সহায়তায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। এছাড়া তারা বাড়িঘরে আগুন, লুণ্ঠন, ধর্ষন, অপহরণ এবং সর্বশেষে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।”
রায়ে আরও বলা হয়েছে, “জামায়াতের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ সংখ্যার বরাতে জানা যায়, জামায়াতের একটি দল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে। জামায়াতের সে সময়ের আমির গোলাম আযমসহ শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় নেতারা টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।”
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছেন, “সূত্রের বরাত দিয়ে হুসাইন হাক্কানি তার ‘পাকিস্তান বিটুইন মস্ক অ্যাণ্ড মিলিশিয়ারি’ গ্রন্থে জানান, আওয়ামী লীগের কাছে নির্বাচনে ধরাশায়ী নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ এবং জামিয়াত উলেমা পাকিস্তান নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। থানা, জেলায় এবং গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত শান্তি কমিটি বিস্তৃত ছিল।”
“এ দলগুলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হয়ে গোয়েন্দাবৃত্তির কাজ করত। আর এই শান্তি কমিটি গঠনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে জামায়াত। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে একত্রিত হয়ে তারা বাংলাদেশকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চেয়েছিল।”
রায়ে আরও বলা হয়েছে, “দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ২০ এপ্রিল, ১৯৭১ সংখ্যার খবরে জানা যায়, পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে তৎকালীন জামায়াত প্রধান গোলাম আযম এক সংবাদ সম্মেলন করে পাকিস্তান সরকারকে সামরিক বাহিনীর প্রতি আনুগত্য আছে এমন বাহিনী এবং তাদের মতাদর্শের লোকদের কাছে অস্ত্র দেওয়ার আহ্বান জানান। তাদের ভাষায় ‘দুষ্কৃতিকারী’ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য তিনি অস্ত্র দেওয়ার আহ্বান জানান।”
এছাড়া নিউইয়র্ক টাইমসের তৎকালীন দিল্লি প্রতিনিধি সিডনি এইচ. স্যান্ডবার্গের এক প্রতিবেদনও উদ্ধৃত করেছেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়েছে, “ওই প্রতিবেদনে স্যান্ডবার্গ উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের অনুগতদের বিশেষ করে শান্তি কমিটির সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়। এছাড়া অবাঙালিদের মধ্যে যেসব বিহারি ও উর্দু ভাষাভাষি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সমর্থন করেছেন তাদেরও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। (সূত্র: সিডনি এইচ স্যান্ড বার্গ, জুলাই ১৪, ১৯৭১)। পরে অবশ্য সিডনি এইচ স্যান্ডবার্গকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বহিষ্কার করা হয়।”
“এছাড়া আরো ওই সময়ের আরো কয়েকটি পত্রিকা ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইয়ে জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের দফায় দফায় বৈঠক ও পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আনুগত্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
ট্রাইব্যুনাল তার রায়ের এ অনুচ্ছেদে সবশেষে মন্তব্য করেছেন, “এভাবেই জামায়াতে ইসলাম পাকিস্তানি বাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী কাজ করে।”
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন