শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

লংমার্চ হরতাল অবরোধ ॥ আওয়ামী কর্মী খুন

হেফাজতের তাণ্ডব, সারাদেশে টানটান উত্তেজনা
জনকণ্ঠ, স্টাফ রিপোর্টার ॥ আজ শনিবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠনের ডাকা হরতাল এবং একইদিনে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ করার ঘোষণাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম সমাবেশ সফল করার ঘোষণা দিয়েছে। বাধা দিলে আগামীকাল রবিবার থেকে সারাদেশে লাগাতার হরতাল অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণার হুমকি দিয়েছে তারা। আর হেফাজতে ইসলামের মঞ্চ দখল করার ঘোষণা দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। এদিকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও হেফাজতে ইসলামের তান্ডবকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও সরকার হেফাজতে ইসলামকে শর্তসাপেক্ষে সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের বহু নেতাকর্মী ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় পৌঁছেছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি আর হেফাজতে ইসলামের তা-বের মুখে সারাদেশেই অচলাবস্থা বিরাজ করছে। মূলত দুপুর থেকেই সারাদেশের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে খোদ রাজধানীতেই হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা এক ছাত্রলীগ নেতাকে দিনদুপুরে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যার পর সারাদেশে পুরোপুরি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। টান টান উত্তেজনা আর আতঙ্কের মধ্যে সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
গত বুধবার এক বিবৃতিতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, প্রগতিশীল পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে আগামীকাল ৬ এপ্রিল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সারাদেশে হরতাল আহ্বান করে। আর এমন হরতালে সংহতি জানায় বাম সংগঠনগুলো। তারা শুক্রবার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মশাল জ্বালিয়ে মিছিল করে। মিছিল থেকে সবাইকে হেফাজতে ইসলাম সর্ম্পকে সর্তক থাকতে বলা হয়। হেফাজতে ইসলাম যদি কোন তা-ব চালায় তাহলে তারা প্রতিবাদ করবে। সবাইকে লাঠিসোটা নিয়ে তা-ব মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
এদিকে হেফাজতে ইসলাম ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যায়িত করে তাদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের পর চট্টগ্রাম থেকে লংমার্চ শুরু করে। তারা রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয়। সংগঠনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, লংমার্চ কর্মসূচীকে বাধাগ্রস্ত করতেই শনিবার সরকার সর্মথিত কয়েকটি সংগঠন হরতলের ডাক দিয়েছে। সরকারের মদদে ডাকা এ হরতাল প্রত্যাহার করা না হলে আগামী ৭ এপ্রিল রবিবার থেকে সারাদেশে লাগাতার হরতাল অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে। হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের শনিবার সকাল ১০টার মধ্যে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানানো হয়। তাদের দাবি, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলন কোন রাজনৈতিক ব্যানার বা দলের নয়। কারও বিরুদ্ধে বা পক্ষে নয়, কাউকে ক্ষমতা বা গদিতে বসানোর জন্য নয়।
এদিকে চট্টগ্রামে শুক্রবার দুপুর ৩টা থেকেই হরতালের ডাক দেয়ায় বিপাকে পড়ে হেফাজতে ইসলাম। শুধু চট্টগ্রামে নয়, সারাদেশেই হরতালের কারণে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। লঞ্চ চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে, তাদের শুক্রবার ৫ হাজার বাস নিয়ে ঢাকায় যাত্রা করার কথা ছিল। এসব বাস জামায়াতের টাকায় ভাড়া করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও বিষয়টি হেফাজত নেতারা অস্বীকার করেছেন। হরতালের কারণে বাস ভাংচুরের আশঙ্কা থাকায় পরিবহন মালিকরা হেফাজতে ইসলামের কাছে ভাড়া দেয়া বাস শেষ পর্যন্ত আর হস্তান্তর করেননি। এমন অবস্থায় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা চট্টগ্রাম থেকে হেঁটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। রাস্তায় রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও হেফাজত নেতাকর্মীরা তা-ব চালিয়েছে। এমন অবস্থায় দেশের অনেক জায়গায় যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে।
পরিবহন মালিকরা গাড়ি না দেয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে কয়েক দফায় সংঘর্ষও হয়। অন্যদিকে জামালপুরে ট্রেনের লাইন থেকে গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় আতঙ্ক আরও বেড়ে যায়। হেফাজতের নেতারা দাবি করেছেন, তারা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, তা জেনেই আগেভাগেই বহু নেতাকর্মীকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঢাকায় এসব নেতাকর্মী জামায়াত-শিবিরের আশ্রয়ে রয়েছেন। হেফাজত নেতাকর্মীরা জায়নামাজ ও তসবিহ নিয়ে আল্লাহর জিকির করতে করতে ঢাকা অভিমুখে আসছেন। সেখানে বাধা বা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন সেখানেই তারা সমাবেশ করছেন।
এদিকে হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে তাদের দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে ৭ ব্লগারকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু এতেও তারা আপত্তি করেন। ইতোমধ্যেই অনেক সংগঠন ব্লগারকে গ্রেফতারের নিন্দা এবং তাঁদের মুক্তির দাবি করেছেন। ব্লগারদের মুক্তির দাবিকারীরাও নাস্তিক বলে হেফাজতে ইসলামী দাবি করেছে। হেফাজত নেতারা সারাদেশ অচল করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েই তা-ব শুরু করে।
বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকার লালবাগের একটি মাদ্রাসায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নির্দেশে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে আজকের হরতালের মধ্যেও সমাবেশ সফল করার ঘোষণা দেয়া হয়। হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ বলেন, সমাবেশ সফল করা হবে। প্রয়োজনে লাগাতার হরতাল আর অবরোধ কর্মসূচীর ডাক দেয়া হবে। শুক্রবার পবিত্র জুমার নামাজের পর রাজধানীর লালবাগের হাফেজ্জী হুজুরের মাদ্রাসা, আজিমপুর, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরার আজমপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।
এদিকে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে সরকার সর্মথিত বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। হেফাজত নেতাকর্মীরা কামরাঙ্গীরচরে হরতালের সমর্থনে মিছিলকারী ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল ইসলামকে কুপিয়ে ও গুলি করে এবং পিটিয়ে হত্যা করে। ছাত্রলীগ নেতা হত্যার প্রতিবাদে ফুঁসে উঠছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তি। তারা সম্মিলিতভাবে হেফাজতে ইসলামের তা-বকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকেও হেফাজতে ইসলামের তা-বকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তারা শনিবারে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে অবস্থান করার ঘোষণা দিয়েছে।
এমন অবস্থার মধ্যেই সরকার রাজধানীর মতিঝিল শাপলা চত্বরে আজ বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বেনজীর আহমেদ এ অনুমতি দেন। শাপলা চত্বর থেকে ফকিরাপুল পর্যন্ত এলাকায় সমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সমাবেশে মাইকও ব্যবহার করারও অনুমতি দেয়া হয়েছে।
একদিকে হরতাল, আরেক দিকে হরতালের মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ সফল করার ঘোষণায় সারাদেশে শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। তবে যেকোন ধরনের নাশকতামূলক কর্মকা-ের জন্য কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়ার আগ থেকেই পুরো এলাকার ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে নিরাপত্তা। মতিঝিলসহ পুরো এলাকায় থাকছে তিন স্তরের নিরাপত্তা। বহুতল ভবনের ছাদে বসানো হচ্ছে ওয়াচ টাওয়ার। থাকছে গোপন মুভি ক্যামেরা, আর্চওয়ে, মেটালডিটেক্টর, হ্যান্ড মেটাল ডিটেক্টর, বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, র‌্যাব, পুরো এলাকার চারদিকে বসানো হবে ব্যারিকেড। অতিরিক্ত পুলিশ ও র‌্যাব থাকছে নিরাপত্তার দায়িত্বে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলাম মূলত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মাঠে নেমেছে। আর একাজে তাদের মদদ যোগাচ্ছে জামায়াত। হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে সরকারবিরোধী নানা কর্মসূচী ঘোষণা করার চেষ্টা চলছে। ঘোষিত কর্মসূচীতে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে। আজকের কর্মসূচীকে পুঁজি করে মারাত্মক নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত-শিবির। যাতে বিএনপির কাছ থেকে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এজন্য জামায়াত-শিবির হেফাজতে ইসলামে কাঁধে চড়ে দেশকে অস্থিতিশীল করছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া লংমার্চে বাধা দিলে পরিমাণ ভাল হবে না বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন। এমন হুঁশিয়ারিতে হেফাজতের কাঁধে ভর করে জামায়াত-শিবির সরকার পতনের জন্য কফিনে শেষ পেরেক ঠুকতে মারাত্মক নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এদিকে সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেয়া হবে না। মানুষের জানমাল রক্ষা করতে সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। যে কোন ধরনের নাশকতার ঠেকাতে তাদের প্রস্তুতিও রয়েছে। কোন প্রকার নাশকতার ঘটনা ঘটলে তার দায়দায়িত্ব বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের কাঁধেই বর্তাবে। নিরাপত্তা জোরদার করতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় গোয়েন্দা নজরদারির পাপাপাশি অতিরিক্ত নিরাপত্তায় বাড়তি পুলিশ ও র‌্যাবকে সহায়তা করতে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যক বিজিবি সদস্যকে সর্তক অবস্থায় রাখা হয়েছে। আপৎকালীন মুহূর্ত মোকাবেলায় বিপুল সংখ্যক বিজিবি ছাড়াও অতিরিক্ত ফোর্স প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন