শনিবার, ১১ মে, ২০১৩

৬ দফা বনাম ১৩ দফা

কালাম আজাদ : জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় প্রত্যাখ্যান করে তার সর্বোচ্চ সাঁজার দাবিতে গত ৫ ফেব্র“য়ারি শাহবাগে আন্দোলন শুরু করেন ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টরা। ওই আন্দোলন থেকে দাবি আসে সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসিসহ জামায়াত নিষিদ্ধের। আন্দোলনের ষষ্ঠ দিনের মাথায় ১০ ফেব্র“য়ারি স্পিকারের কাছে পেশ করা হয় ৬ দফা। এদিকে শাহবাগের ওই আন্দোলন চলাকালেই এক রকম হঠাৎ করে মাঠে নামে হেফাজতে ইসলাম। নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ দাবি করা ওই সংগঠনটি গত ৬ এপ্রিল লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশে সরকারের প্রতি ১৩ দফা দাবি জানায়।


সূত্রমতে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ যখন যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে একাÍতা পোষণ করে, ঠিক তখনই জামায়াত-শিবির ওই আন্দোলন বানচালে দেশি ও আন্তর্জাতিক মহল ও মিডিয়াকে ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হয়নি। পরে ধুয়া তোলা হয় শাহবাগের আন্দোলনকারীদের ‘নাস্তিক’ ব্লগার বলে। আর তাতে সাহায্য করে দেশি কিছু মিডিয়া। বলা হয়Ñ শাহবাগে আন্দোলনকারীরা ইসলামবিদ্বেষী ‘নাস্তিক’। এরই মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা এবং জামায়াত নিষিদ্ধসহ আরও কিছু দাবিতে কয়েকটি সমাবেশ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং মোমবাতি প্রজ্বালনসহ আরও বেশকিছু কর্মসূচি পালন করে গণজাগরণ মঞ্চ। এসব কর্মসূচিতে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সাড়া মেলে। এদিকে শাহবাগের ওই আন্দোলন চলাকালেই জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। এতে দেশজুড়ে সহিংস তাণ্ডব চালায় জামায়াত-শিবির। ঘটে অনেক হতাহতের ঘটনা।

জানা যায়, প্রজš§ চত্বরের ৬ দফা ও প্রজš§ চত্বরের আন্দোলনের বিরোধিতা করেই মূলত হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি দেওয়া হয়। গণজাগরণ মঞ্চের ৬ দফা এবং হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে মনে-মগজে ধারণ করে কলঙ্কমুক্ত রাষ্ট্র চেয়েই দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে প্রজš§ চত্বর। অপরপক্ষে প্রজš§ চত্বরের আন্দোলনকে বানচাল এবং মানবতাবিরোধীদের রক্ষা করতেই দেওয়া হয় ১৩ দফা। প্রজš§ চত্বর থেকেও অবশ্য একই ধরনের অভিযোগ করা হয়। বলা হয়Ñ ১৩ দফা দাবি হেফাজতে ইসলামের নয়। এগুলো মূলত জামায়াতে ইসলামের দাবি ও নীলনকশা তবে এই অভিযোগের ব্যাপারে মুখ খোলেনি জামায়াত।

সূত্র জানায়, মূলত শাহবাগের আন্দোলনকে মোকাবিলা করতেই হেফাজতে ইসলামকে মাঠে নামায় বিএনপি-জামায়াত। কারণ প্রজš§ চত্বরের আন্দোলন ও দাবিগুলো জামায়াতের জন্য হয়ে উঠেছিল গলার কাঁটা। উল্লেখ্য, গত ১০ ফেব্র“য়ারি স্পিকারের কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে যে ৬ দফা দাবির কথা বলা হয়, সেগুলো হলোÑ অবিলম্বে কাদের মোল্লাসহ একাত্তরের ঘাতক-দালাল সকল যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে বিবাদিপক্ষের মতো রাষ্ট্রপক্ষেরও আপিল করার সুযোগ থাকতে হবে। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে এবং দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়ে জামায়াত-শিবির যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ করেছে, ভিডিও ফুটেজ ও সংবাদপত্রের ছবি দেখে তাদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও কঠোরতম শাস্তি দিতে হবে। যেসব রাজনৈতিক দল, শক্তি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার চেষ্টা করছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধিতা করছে এবং তাদের সঙ্গে আঁতাত করছে, তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। পঁচাত্তরের পরে সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন যেসব যুদ্ধাপরাধী রাজাকার আলবদরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে তাদের সকলকে পুনরায় গ্রেপ্তার করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিভিন্ন ব্যবসায়ী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধ করতে হবে, তাদের দেশি-বিদেশি সকল প্রকার আয়ের উৎস খুঁজে বের করে তা বন্ধ করে দিতে হবে এবং যুদ্ধাপরাধীদের গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিতে হবে।

সূত্রমতে, গণজাগরণ মঞ্চ থেকে যখন ৬ দফা দাবি আসে এবং তার বাস্তবায়ন শুরু হয়, তখন নিজেরা সামনে না থেকে দ্বিতীয় শক্তিকে মাঠে নামায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপি। তবে হেফাজতের পক্ষ থেকে এই অভিযোগের ব্যাপারে বলা হয়Ñ তাদেরকে বিএনপি-জামায়াত বা অন্য কেউ সহযোগিতা করছে না। এদিকে যুদ্ধাপরাধ এবং সহিংসতার কারণে যখন জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ার মুখে পড়ে, তখন অন্য একটি শক্তি খুবই প্রয়োজন ছিল। আর শাহবাগের প্রজš§ চত্বরের আন্দোলনের বিপরীতে দাঁড় করাতে এবং আন্দোলনকারী ও দাবিগুলোর বিরুদ্ধাচরণ করতেই মূলত মাঠে নামে হেফাজত। আর গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে পরোক্ষভাবে জামায়াত নেতাদের মুক্তি ও জামায়াত-শিবিরের গ্রেপ্তার হওয়া নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে পরোক্ষভাবে গত ৬ এপ্রিল ১৩ দফা দাবি পেশ করে হেফাজতে ইসলাম। লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশে হেফাজতে ওইদিন ঘোষিত ১৩ দফা দাবিগুলো ছিলÑ সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনর্স্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা। আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস। কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা। ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা। ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা। মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘেœ নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা। রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজšে§র মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা। রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদী জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা। সারাদেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধামকি, ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা। গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদী জনতাকে অবিলম্বে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেনÑ মূলত গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন বন্ধ, আন্দোলনকারীদের বিচার, ওই আন্দোলনের যাতে আর কোনো দফা বাস্তবায়ন না হয় সেই চেষ্টা, সরকারের পতন, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা এবং কৌশলীভাবে জামায়াত নিজেদের রক্ষা করতেই হেফাজতে ইসলামের মাধ্যমে ওই ১৩ দফা দাবি পেশ করা হয়। আর যেখানে ৬ দফা দাবির উদ্দেশ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক ও কলঙ্কমুক্ত রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা। সেখানে হেফাজতের ১৩ দফার উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করে দেশকে মধ্যযুগে নিয়ে যাওয়া।
সূত্রঃ http://www.amaderorthoneeti.com/content/2013/05/11/news0084.htm

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন