শুক্রবার, ১০ মে, ২০১৩

জ্বালাও-পোড়াও সন্ত্রাসী কাজ ইসলামের নয়

মাহমুদ আহমদ সুমন
জ্বালানো-পোড়ানো এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। যারা ধর্মের নামে এসব গর্হিত কাজে লিপ্ত তারা কখনো শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী হতে পারে না। তথাকথিত হেফাজতে ইসলাম যে আসলেই সন্ত্রাসী জামাত-শিবিরেরই আরেক রূপ তা দেশবাসীর কাছে তারা নিজেরাই স্পষ্ট করেছেন। তারা যে কতো ভয়াবহ তা-ব চালাতে পারে তাও সকলে গত রোববার প্রত্যক্ষ করেছে। বিক্ষুব্ধ হেফাজত কর্মীরা এ সময় বেপরোয়া গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে মেতে ওঠে। এরা পল্টনে ট্রাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার দক্ষিণের কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ সময় তারা সেখানে দায়িত্বরত চার পুলিশ সদস্যের কাছে থাকা শটগান ও চাইনিজ রাইফেল ছিনিয়ে নেয়। বায়তুল মোকাররম ও বিজয়নগর এলাকায় ফুটপাতে থাকা বিভিন্ন দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। আগুন ধরিয়ে দেয় পল্টনে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন ভবন, বাম রাজনৈতিক দলের কার্যালয় মুক্তি ভবন, র‌্যাংগস ভবনের নিচতলায় একটি ফাস্টফুডের দোকান ছাড়াও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ গেটের ফুটপাতে থাকা শতাধিক দোকানে।
এসব দোকানের মধ্যে পবিত্র কুরআন, হাদিস, ধর্মীয় বই, জায়নামাজ ও তসবিহর দোকানও রয়েছে। সন্ধ্যার পর বিক্ষোভকারীরা হাউস বিল্ডিংয়ের সামনে একটি ট্রান্সফরমারে আগুন ধরিয়ে দিলে বিকট শব্দে তা বিস্ফারিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। হেফাজত কর্মীদের দেয়া আগুনে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনের নিচতলায় থাকা অর্ধ শতাধিক গাড়ি এ সময় ভস্মীভূত হয়। একটু ভেবে দেখুন, এরা নাকি ইসলামের হেফাজতকারী?

যাদের হাত থেকে পবিত্র কুরআন পর্যন্ত রক্ষা পায়নি, যাদের কাছে কুরআনের কোনো মূল্য নেই তারা আবার কিভাবে ইসলামের কথা মুখে উচ্চারণ করে? এরা নিঃসন্দেহে ধর্মীয় সন্ত্রাসী, এরা কখনো মুসলমান হতে পারে না। এ ধরনের সন্ত্রাসীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বেগম জিয়া কী এটা প্রমাণ করলেন না যে, এরাই এসব ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের মূল হোতা। তথাকথিত হেফাজতিরা পবিত্র কুরআনের অবমূল্যায়ন করে সমগ্র মুসলমানের হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সরকারের উচিত হবে যারা এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং যাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যের কারণে এই হীন কাজটি তারা করেছে তাদের প্রত্যেকের ব্যাপারে সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ইসলাম ধর্মের কোনো ক্ষতি করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। যেভাবে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম। আর আমি ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্মরূপে মনোনীত করলাম’ (সুরা মায়েদা : ৩)। পবিত্র কুরআনের ব্যাপারেও আল্লাহতায়ালার ঘোষণা হলো ‘নিশ্চয় আমি এ কুরআন অবতীর্ণ করেছি এবং নিশ্চয় আমিই এর সুরক্ষাকারী’ (সুরা হিজর:৯)। এই আয়াতে কুরআন করিমকে অবিকলরূপে সংরক্ষণ করার যে প্রতিশ্রুতি আছে তা এমন সুস্পষ্টরূপে পূর্ণতা লাভ করেছে যে, অন্য কোনো প্রমাণ যদি নাও থাকতো তবু এই সত্যই কুরআনের এলাহী উৎস প্রমাণের জন্য যথেষ্ট হতো। এই সুরা মক্কাতে অবতীর্ণ হয়েছিল এমন এক সময়ে যখন মহানবী (সাঃ) এবং তার সাহাবাগণের (রাঃ) জীবন চরম বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে ছিল এবং শত্রুপক্ষ নতুন ধর্মমতকে সহজেই নিষ্পেষণ করে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতো। এরূপ এক অবস্থার মধ্যে কাফেরদের তাদের চরম অপচেষ্টা দ্বারা একে ধ্বংস করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতার আহ্বান জানানো হয়েছিল এবং এই সঙ্গে তাদের সাবধানও করে দেয়া হয়েছিল যে তাদের সকল ষড়যন্ত্র আল্লাহতায়ালা ব্যর্থ করে দেবেন। কারণ তিনি আল্লাহ স্বয়ং এর হেফাজতকারী। এই দাবি ছিল দ্ব্যর্থহীন ও খোলাখুলি এবং শত্রুপক্ষ ছিল শক্তিশালী ও নির্মম। তথাপি কুরআন যাবতীয় বিকৃতি, প্রক্ষেপ ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে নিরাপদ থেকে অব্যাহতভাবে স্বীয় নিরাপত্তার বিজয় ঘোষণা করে চলেছে। আল্লাহতায়ালা মহানবীকে (সাঃ) কুরআন শরিফের সুরক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা এক স্থায়ী প্রতিশ্রুতি। পবিত্র কুরআনের এসব আয়াত থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, ইসলাম ও কুরআনের হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ স্বয়ং নিয়েছেন আর এর হেফাজতও তিনি সঠিকভাবেই করছেন। ইসলাম সম্পর্কে যার সামান্যতম জ্ঞান আছে সেও তো চাইবে না যে কাজ আল্লাহর জন্য নির্ধারিত সেই কাজে হাত দেয়। তাহলে কিভাবে তারা হেফাজতে ইসলাম নামে একটি সংগঠন করে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন? এরা এই কাজ করে ইসলাম ও রসুলের অবমাননা কি করছেন না?

এদেশে অগণিত ধর্মভিত্তিক জঙ্গি দল রয়েছে। যদি খতিয়ে দেখা হয় তাহলে দেখা যাবে এসব দলের মূল একটাই আর তাহলো জামাতে ইসলামী। এরাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে মাঠে নেমে ইসলামের কথা বলে সহজ-সরল লোকদের ধোঁকা দেয় আর জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করে। এই ধর্মান্ধ দুর্ভাগারা ইসলাম ও রসুল (সাঃ) অবমাননার সচিত্র উদাহরণ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার করছে। গোপনে কিছু হতভাগা নোংরা ভাষা ব্যবহার করেছিল তাও জনসমক্ষে এই মৌলবাদীরা তুলে ধরছে এবং পুনরাবৃত্তি করছে অবলীলায়। ব্লগার রাজীব হত্যার পরপরই তার সম্পর্কে যে তথ্য ছড়ানো হয়েছিল তাতে উল্লেখ করা হয়েছে এই ধৃষ্টতা আজকের নয়, ২০১০ সালের জুলাই মাসের। প্রশ্ন হলো, বছরের পর বছর এসব অপবাদ-অভিযোগ যথাযথভাবে খ-ন না করে তারা এগুলোকে আগলে রেখেছিল কেন? ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য, তাই না? ‘আল্লামা’ হিসেবে কি এসব কটূক্তির যৌক্তিক ও অকাট্য জবাব দেয়া হেফজত নেতাদের দায়িত্ব ছিল না? সমাজের ক’জনই বা এই অবমাননা সম্পর্কে জানতো? আর আজ আপনারা হেফাজতিরা সেই অপমানটারই প্রচার সম্পূর্ণ করে দিলেন! অতএব আপনারাও আজ সমানভাবে রসুল (সাঃ) অবমাননাকারী! তারা যদি হয় নির্বোধ অপরাধী, আপনারা হলেন জ্ঞান-পাপী। আড়াই বছর ধরে রসুল (সাঃ) অবমাননা সহ্য হয়, কিন্তু গণহত্যাকারী যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ বিচারের দাবি সহ্য হয় না আপনাদের। এখন নিজেদের বাঁচানোর জন্য আন্দোলনের মোড় ভিন্ন খাতে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।

যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করছে তাদের আপনারা সহ্য করতে পারছেন না। আপনারা যদি প্রকৃত ইসলামেরই অনুসারী হতেন তাহলে তো এই দাবির সঙ্গে আপনাদেরও ঐকমত্য থাকার কথা ছিল। কেননা নিরীহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার বদলে মৃত্যুদ-ের বিধান চাওয়া কি ইসলাম বিরোধী? ইসলামে তো ‘কিসাস’ বলতে কিছু আছে। তাহলে কেন আপনারা ইসলামের হেফাজতের কথা বলে ইসলাম বিরোধী কাজ করছেন? ধর্ম-ব্যবসায়ীদের মুখোশ খসে পড়ার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে হঠাৎ করেই আপনাদের ইসলাম হেফাজতের দায়িত্বের কথা মনে পড়লো?

কারা খোদাদ্রোহী? যারা শান্তিপূর্ণভাবে বৈধ দাবি জানিয়ে আন্দোলন করে তারা, নাকি যারা ইসলামের শিক্ষার বিপক্ষে কাজ করে তারা? বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদকে (সাঃ) কাফেররা কতোই না অত্যাচার করেছে, কতোই না গালিগালাজ করেছে এর উত্তরে কি তিনি কখনো রাগান্বিত হয়ে কিছু করেছেন? যদি আজকে কেউ ইসলামের অবমাননা করে থাকে তাকে সুন্দরভাবে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ সম্পর্কে বুঝানো উচিত। তাকে না বুঝিয়ে তার মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করে ফেলার নামতো ইসলাম নয়। কেউ যদি ইসলামের বদনাম করে তাহলে ইসলামের শিক্ষা হলো ধৈর্য ধারণ করা এবং উত্তমভাবে এসব কথাকে পরিহার করে চলা।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ হজরত মুহাম্মদকে (সাঃ) উদ্দেশ্য করে বলছেন, ‘কাফেররা যা বলে, তজ্জন্যে আপনি সবুর করুন এবং সুন্দরভাবে তাদের পরিহার করে চলুন’ (সুরা মুজাম্মেল: ১০)। এখানে আল্লাহ কি এটা বলতে পারতেন না যে, যারা আপনাকে অপমান করে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু কী বলা হয়েছে, বলা হয়েছে সবুর করুন আর সুন্দরভাবে তাদের পরিহার করুন। কাফেররা সব সময়ই হজরত রসুল করিমকে (সাঃ) কষ্ট দিতেন এবং অবমাননাকর কথাবার্তা বলতেন। কিন্তু কখনই তিনি রুষ্ট হতেন না। হজরত রসুলপাক (সাঃ) অবিশ্বাসীদের বিদ্রƒপের কারণে কখনই ব্যথিত ছিলেন না বরং তিনি ব্যথিত থাকতেন একটি কারণে আর তা ছিল আল্লাহর সঙ্গে অন্যান্য দেব-দেবীর শরিক করার কারণে। তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে এই প্রার্থনাই করতেন হে আল্লাহ তুমি এদেরকে ক্ষমা করো কারণ এরা বুঝে না। আজকে যারা হেফাজতে ইসলামের নামে বা অন্যান্য নামে ইসলাম রক্ষার কাজে রত তারা কি বুকে হাত দিয়ে এই কথা বলতে পারবেন যারা ইসলামের অবমাননা করছে বলে আপনারা ধারণা করেন তাদের সংশোধনের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া কামনা করেছেন? হাদিসে পাওয়া যায় কারো দোষ দেখলে তার জন্য কমপক্ষে চল্লিশ দিন দোয়া করা উচিত এটা কি আপনারা কেউ করেছেন? আপনারা যদি ইসলামের অনুসারী হয়েই থাকেন তাহলে ইসলামী পন্থায় আপনাদের আন্দোলন হবে আর সেই আন্দোলন মিছিল-মিটিং আর জ্বালাও-পোড়াওয়ের মাধ্যমে বরং নয় দোয়ার মাধ্যমে। যেহেতু তথাকথিত হেফাজতের আসল চেহারা স্পষ্ট হয়ে গেছে ইতোমধ্যে, তাই হেফাজতিদের সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে এবং ধর্মের নামে তাদের এসব ভ-ামি রোধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপও নিতে হবে।

মাহমুদ আহমদ সুমন : লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন