শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

এ লড়াই ছিল অবশ্যম্ভাবী

ডা. নুজহাত চৌধুরী
এই মুহূর্তে দেশ এক ভয়ংকর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সবাই চিন্তিত, আতঙ্কিত, বিস্মিত। এ কি হচ্ছে? এখন রাতগুলোও যেন হরতালের কালো থাবার নিচে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না । কিন্তু কেন? এমন যে ঘটবে সে কথা কি আমরা জানতাম না? ৪২ বছর ধরে এই আশঙ্কার কথা কি প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক সুধীজন বলে আসছিলেন না?


১৯৭১ এ ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ করার পরও দোষীদের বিচার বা শাস্তি হয়নি। বরং তারা জনসমর্থনহীন সেনাছাউনি থেকে আগত নেতাদের দল গঠনের প্রচেষ্টায় সেসব ভুঁইফোড় দলে আশ্রয় পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে আসীন হয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পুষ্ট হয়েছে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনীতিবিদরা তাদের এ বিকাশ ও পুষ্টিকে বাধা তো দেয়ইনি বরং সমর্থন যুগিয়েছে। আজ ৭১’র পরাজিত শক্তি, চারাগাছ থেকে একটি পরিপুষ্ট বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এ বিষবৃক্ষের যে বিষাক্ত ফল সবাই ভক্ষণ করেছি তার বিষক্রিয়ায় নীল হয়ে উঠেছে সমগ্র দেশের শরীর। সে বিষাক্ত ফল খাবার সময় তো এর পরিণাম আমরা চিন্তা করিনি। ইবনে সিনায় রক্ত পরীক্ষা বা চিকিৎসা করানোর সময়, ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখার সময়, কেন এ চিন্তা করা হয়নি যে এর লাভ দিয়েই এদেশের ছেলেদের বুকে গুলি করার বন্দুক তারা কিনবে? মানারত স্কুলে যে মেয়েকে পড়িয়ে, রেটিনাতে কোচিং করালেন ডাক্তার বানানোর আশায়- তখন কি একবারও মনে পড়েনি যে আপনার টাকা দিয়েই পুষ্ট হয়ে আপনারই মেয়ের ডাক্তার হবার স্বপ্নকে ওরা গুড়িয়ে দিবে একদিন।

আমি চিন্তিত হলেও বিস্মিত নই। দুধ কলা দিয়ে যে ধর্মান্ধ সাপ আমরা পুষেছি তা আজ ফণা তুলে দাড়িয়েছে। এখন দৌড়ে পালাতে পারবেন না। সাপের সাথে দৌড়ে জেতা যায় না। এবার হয় সে আপনাকে ছোবল দিবে না হয় আপনি তার টুটি চেপে বিষদাঁত গুড়িয়ে দেবেন। ৪২ বছরে প্রতিটি ক্ষণে এ আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হয়েছে সচেতন গুনীজনের মুখে। শুধু মুখেই বলেছি, সত্যি একদিন এদেশীয় তালেবানীরা হুঙ্কার দিয়ে দাড়াবে তা হয়ত অনেকেই বাস্তবিক সমস্যা বলে মনে করেন নি।

ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতার মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান তা বোঝার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন আছে। গভীরভাবে ধার্মিক একজন ব্যক্তিও ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে নাস্তিকতা নয়। যারা নাস্তিক তারা স্রষ্টার অস্তিত্বেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ একজন ব্যক্তি ধর্মবিশ্বাসী, জীবনাচরণে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলা ধার্মিক ব্যক্তি হতে পারেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে, ধর্ম ব্যক্তিগত পবিত্র বিশ্বাস, যাকে নিয়ে রাজনীতি করা চলে না। এরা বিশ্বাস করেন ধর্মের নামে অপর ধর্মে বিশ্বাসী কারো উপর খড়গ তোলা যায় না। একটি সুন্দর পৃথিবী যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী কোন কিছুই মানুষের বিবেচ্য নয়, মানবতাই সকলের প্রেরণা হবে। সকলে সকলকে ভালবাসবে, সম্মান করবে, একজনের অধিকার কোন যুক্তিতেই অন্যজন খর্ব করবে না – এটাই কি সকল ধর্মের শান্তির বাণী নয়? জামাত যে সহিংসতা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে এ দেশের মানুষের উপর তা কি ইসলামের শান্তির বাণীর পরিপন্থী নয়? ইসলামের এই ব্যবহারে কেন মুসলমান হিসেবে আমাদের ক্ষোভ হবে না? একি আমাদের ঈমানের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয় যে আমরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চকন্ঠে বলতে পারছি না যে – না, আমাদের নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলার অধিকার কারো নেই। আমরাও মুসলমান। ইসলাম আমারও ধর্ম। আমাকে অন্য কোন মুসলমান কোন স্পর্ধায় নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলবে? একমাত্র মহান আল্লাহতাআলা জানেন তাঁর বিচারে কে মুমিন মুসলমান। এ বিচারের অধিকার আর কারো নেই। কে নাস্তিক, কে কাফের, কে মুরতাদ এ নির্ধারণের সোল এজেন্সি জামাত ও এর সহযোগী দলগুলোকে কে দিয়েছে? তারা আমাদের ঈমানের বিচার করার কে? ঈমানের বিচার করার মালিক একমাত্র আল্লাহতাআলা।
কেন আমরা স্পষ্ট করে বলছি না যে, ইসলামকে যারা ভোটের রাজনীতির জন্য ব্যবহার করে তারা ইসলামের পবিত্রতা বিনষ্ট করেছে। তারা ক্ষমতায় আসার সিঁড়ি হিসেবে ইসলামকে ব্যবহার করছে। এটা পবিত্র ধর্ম ইসলামের অবমাননা। মুসলমান হিসাবে তা কি আমাদের বাধা দেয়া উচিত নয়? পাশাপাশি নিজের দেশের লোকের বিরুদ্ধে, অন্য মুসলমানের বিরুদ্ধে তুলছে অস্ত্র।

ইসলাম কি তা সমর্থন করে? আফসোস এই যে, সহস্র বছরে বাংলায় যে উদার ধর্ম চর্চার ধারা প্রোথিত হয়েছে, সুফীবাদ ও অহিংসার যে শান্তিময় ইসলামের প্রতিচ্ছবি বাংলার ঐতিহ্য- তাকে হিংসাত্বক তালেবানি, জঙ্গী এ চেহারা দিয়ে দিল জামাত।
৪২ বছর ধরে আমাদের নষ্ট রাজনীতির ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে ’৭১ এর পরাজিত, হত্যা ধর্ষণকারী ধর্মান্ধ এ গোষ্ঠী। আজ তারা এত শক্তিশালী যে সারা দেশে তারা নারকীয় তান্ডব করছে, সরকারের পুলিশবাহিনীকে মেরে মাথা থেঁতলে দিচ্ছে – কিন্তু তাদেরকে থামানো যাচ্ছে না। আজ তারা অর্থে, বিত্তে, অস্ত্রে, বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগে, বহির্বিশ্বের ভাড়াটে লবিষ্ট ও আইনজীবিদের আস্ফালনে অনেক শক্তিশালী। আজ সমগ্র দেশ তাদের তান্ডবলীলায় ভীত কম্পিত। ভয়ের কারণ আছে বটে। কিন্তু তাই বলে কি আমরা তাদের মোকাবিলা করব না? জীবনের ভয়ে ’৭১এর পরাজিত এ অপশক্তির কাছে বিনা যুদ্ধে দেশমাতৃকাকে তুলে দিব? তাহলে কেমন সন্তান আমরা? চোখ কান বুজে থাকলে কি এ ঝড় থেমে যাবে? গোপন আঁতাত করে, পিঠে হাত বুলিয়ে কি তাদের শক্তি প্রদর্শন থেকে বিরত রাখা যাবে? যাবে না। কখনই না। তারা আজ ক্ষমতার লিপ্সায়, রক্তের নেশায় মাতোয়ারা। আফগানিস্তান, পাকিস্তান তাদের সামনে দৃষ্টান্ত। ওখানে তাদের ভাইদের সফলতায় তারা জেহাদী জোশে মাতোয়ারা। তাদের আকাঙ্খা, গন্তব্য স্পষ্ট। প্রশ্ন হল আমরা কি চাই? আমরা কি করব? এদেশকে আরেকটি আফগানিস্তান, পাকিস্তান হতে দিব। যদি দিতে না চাই তবে লড়াই ছাড়া পথ নাই।

দেশের এ অবস্থায় যারা ভাবছেন দেশ ছেড়ে চলে যাবেন- চলে যান – মায়ের খেয়ে বড় হওয়া বিদেশী তাবেদার ছেলে না থাকলেই মায়ের শান্তি। যারা আপোষ করতে চান- রাস্তা খোলা আছে- মীরজাফরের মতো আপনাদের নামও ঘৃণাভরে বিস্মৃত হবে সবাই। যারা ভীত হয়ে ঘরে বসে থাকতে চান, আত্মরক্ষার অধিকার আপনার আছে। শুধু একটু ভেবে দেখুন-সময়ের পরীক্ষা বারবার আসে না। আপন আয়নায় যদি মাথা হেঁট হয়ে যায়, তবে সে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার সার্থকতা আছে কি? সময়ের এ পরীক্ষায় পাশ করলেই শুধু মাথা উচুঁ করে বাঁচা সম্ভব। আর মায়ের যে গুটিকয়েক ছেলে রাস্তায় নেমে, বুক পেতে, মাকে রক্ষার জন্য লড়াই করতে চান- আপনাদের সালাম- আপনারা এগিয়ে আসুন- মা আপনাদেরই মুখ চেয়ে আছেন। আসুন রাজপথে, গর্বিত দৃপ্তপদে। আপনাদের মতো ছেলে আজ বাংলা মায়ের বড়ই প্রয়োজন।

বাংলা মায়ের আজ সংকটকাল, ক্রান্তিলগ্ন। একে অস্বীকার করবার অথবা এড়িয়ে যাবার উপায় আর নেই। কোন সংলাপ কোন আপষেই এ সংকট কাটবে না। কেবল অযথা হবে কালক্ষেপণ। সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। বালিতে মুখ গুঁজে থাকলেই কি ধুলিঝড় থেমে যায়? বালি থেকে মুখ বের করুন। চোখ খুলুন, দেখুন ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব কিভাবে লন্ডভন্ড করে দিতে চাচ্ছে আমাদের প্রিয় দেশ, আমাদের সকল অর্জন। আজ পিছু হটবার সুযোগ নেই। বরং এই ভালো। এবারই হয়ে যাক এসপার ওসপার। ৪২ বছর দেরী হয়ে গেছে; ৪২ বছরে এদেশের শত্রুরা শক্তিতে বেড়েছে শতগুণ। আর কালক্ষেপণ করলে তারা আরো পুষ্ট হবে, আরো হিংস্র হবে। তখন আমাদের সন্তানদের করতে হবে এই লড়াই। নয়ত আত্মসমর্পন করতে হবে মাথা হেঁট করে। যদি ঝড়তেই হয় ঝড়ুক আমাদের রক্ত। তবু বসবাসযোগ্য করে দিয়ে যাবো এ দেশ আমার মেয়ের জন্য, আমার ছেলের জন্য। এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বসূরী ৩০ লক্ষ শহীদ।


ডা: নুজহাত চৌধুরী : শহীদ ডাঃ আব্দুল আলীম চেীধুরীর সন্তান
Source: http://bangla.bdnews24.com/opinion_bn/article610473.bdnews

1 টি মন্তব্য:

  1. দালাল সাম্রাজ্যবাদি ফ্যাসিস্ট
    অবৈধ মারপ্যাছে
    গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে এঁরাই বানায় আফগান , ইরাক
    আর মাতাব্বরি ফলায়ে ধংশ করে যে কোন জাতিকে ।
    রাস্টীয় সম্পদ লুটতরাজে , করে স্বাধীনতা হরন
    হে ঘুম প্রিয় বাঙালী জেগে উটার এখনি সময়
    আর সুযোগ না দিয়ে এক হওয়া চাই
    ভেঙ্গে বাধা ভয়

    উত্তরমুছুন