বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৩

হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বে ‘নাস্তিক’ বিরোধিতার নামে সরকারবিরোধী ঐক্য?

 প্রথমআলো | সেলিম জাহিদ | তারিখ: ২০-০৩-২০১৩
ইসলামের কথিত অবমাননাকারী ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের শাস্তির দাবি সামনে রেখে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’-এর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের লক্ষ্যে সংগঠিত হচ্ছে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক বিভিন্ন দল ও সংগঠন। তাদের এই আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ নিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মঈনুদ্দীন রুহি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। এর সঙ্গে সরকার বা রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই। তবে, সরকার যদি নাস্তিকদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়, তাহলে এ আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে যাবে।’

এ আন্দোলনে শামিল আছেন প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটভুক্ত ও সমমনা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতারাও। সরকার-সমর্থক ধর্মভিত্তিক একাধিক দল বলছে, আন্দোলনটির নেপথ্যে বিএনপি আর জামায়াত সক্রিয় আছে। তবে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের দাবি, জামায়াতে ইসলামী তাঁদের সঙ্গে নেই।

ধর্মীয় বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর ঐক্যের সুবাদে তিন বছর পর মাঠে ফিরল হেফাজতে ইসলাম। কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধারার রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ওই ঘরানার প্রভাবশালী আলেমদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে সারা দেশে হেফাজতে ইসলামের কমিটি গঠন করার কাজ চলছে। চলতি মাসে একাধিক বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষে আগামী ৬ এপ্রিল সব জেলা থেকে ‘লংমার্চ’ করে ‘ঢাকা অবরোধ’ করার কর্মসূচি ঘোষণা করা আছে।

‘নাস্তিক’বিরোধী ঐক্যে সরকারবিরোধীরা: মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতা-বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের নেতাদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ দলটি নিষিদ্ধ করার দাবিতে দেশে চলমান আন্দোলনের একপর্যায়ে কথা ছড়ায় যে ঢাকার শাহবাগে সূচিত ওই আন্দোলনের সংগঠক ব্লগাররা আল্লাহ, মহানবী (সা.) ও ইসলামের অবমাননা করে ব্লগে লেখালেখি করছেন। এই অভিযোগেই হেফাজতের কর্মসূচিগুলো ঘোষণা করা হয়েছে।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় (দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম) ৯ মার্চ ওলামা-মাশায়েখদের এক সম্মেলনে হেফাজতে ইসলামের ছত্রচ্ছায়ায় এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হয়। হেফাজতের শীর্ষনেতা ওই মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ডাকে ওই সম্মেলনে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাসহ কওমি ধারার প্রায় দুই হাজার শীর্ষস্থানীয় আলেম অংশ নেন। আল্লামা শফী এই ধারার আলেমদের শ্রদ্ধাভাজন।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী একাধিক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ঐক্যবদ্ধ এ আন্দোলনের সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের শরিক কওমি ধারার দলগুলোর নেতারাও যুক্ত আছেন। এঁদের মধ্যে ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস, নেজামে ইসলাম পার্টি ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (একাংশ) নেতারা উল্লেখযোগ্য। রয়েছেন এঁদের সমমনা বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, উলামা কমিটি ও খেলাফতে ইসলামীর নেতারাও।

অবশ্য হাটহাজারী মাদ্রাসায় ওই সম্মেলনে চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও প্রয়াত শায়খুল হাদিস আজিজুল হকের প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নেতারাও অংশ নিয়েছিলেন। এই সংগঠন দুটির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কোনো ব্যক্তির সুসম্পর্ক রয়েছে বলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে প্রচার আছে।

১৬ মার্চ হেফাজতে ইসলামের যে ঢাকা মহানগর কমিটি গঠিত হয়েছে, সেটির সদস্যসচিব করা হয়েছে ১৮ দলীয় জোটের সমমনা খেলাফতে ইসলামীর নায়েবে আমির জুনায়েদ আল হাবিবকে। এ কমিটির আহ্বায়ক বারিধারা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ নূর হোসাইন কাসেমী। তিনি সদ্যগঠিত মোর্চা, ইমান ও দেশ রক্ষা আন্দোলনেরও আহ্বায়ক। কওমি ভাবধারার এই মোর্চা এবং সাতটি দলের আরেকটি মোর্চা ‘ইসলামী দলসমূহ’ এখন হেফাজতে ইসলামের ঐক্যে শামিল হয়েছে। মোর্চা দুটির অনেক শরিকের সঙ্গেও ১৮ দলীয় জোটভুক্ত কওমি ধারার দলগুলোর যোগসূত্র রয়েছে। এ দুটি মোর্চা গঠিত হয় শাহবাগ আন্দোলনের পর।

নেপথ্যে বিএনপি-জামায়াত?: হেফাজতে ইসলামের নেতারা প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, ধর্মীয় চিন্তাচেতনা-সংক্রান্ত আদর্শিক বিরোধের কারণে এ ঐক্যে জামায়াতে ইসলামীর কাউকে রাখা হয়নি।
কিন্তু সরকার-সমর্থক ধর্মভিত্তিক একাধিক দল অভিযোগ তুলেছে, এই ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের নেপথ্যে বিএনপি ও জামায়াতের মদদ রয়েছে। ১৬ মার্চ ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে একটি সংগঠন ব্লগারদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশের অন্যতম বর্ষীয়ান আলেম আল্লামা আহমদ শফী। এই বর্ষীয়ান আলেম হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবেন কি না, প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, ১৮ দলের নেতা ও ওলামারা চেষ্টা চালাচ্ছেন, হেফাজতকে সরকারবিরোধী আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিতে।’

ক্ষোভের ঐক্য: হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়েছিল ২০১০ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মঞ্চ হিসেবে। এত দিন পর আবার সংগঠনটি জোরেশোরে মাঠে নামল।

এমনিতে বর্তমান সরকারের সময়ে গঠিত কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাসনদবিষয়ক কমিশন নিয়ে অসন্তোষ আছে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডসংশ্লিষ্ট আলেমদের মধ্যে। এর বাইরে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ কথাটি বাদ দেওয়া, সংবিধানের শুরুতে থাকা ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’-এর ‘বিতর্কিত’ বঙ্গানুবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথাবার্তা এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ও নারীনীতির কিছু ধারা নিয়ে জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক প্রায় সব দলই ক্ষিপ্ত। সাম্প্রতিক সময়ে কথিত ‘নাস্তিক’ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্মের অবমাননার অভিযোগে শুরু হওয়া আন্দোলনে ধর্মভিত্তিক সব গোষ্ঠীকে একমঞ্চে আনার ক্ষেত্রে পুরোনো ওই সব ক্ষোভ সহায়ক হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন