বুধবার, ২০ মার্চ, ২০১৩

হেফাজতে ইসলাম ও গণজাগরণ মঞ্চ

মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন
একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে আইনের শাসন আছে এবং যে রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম তথা শান্তির ধর্মের অনুসারী; সেখানে আজ শান্তি যেন তিরোহিত। শান্তির কথা বলে শান্তি বিতাড়নের মহড়া চলছে প্রতিদিন। ইসলাম এমন একটি ধর্ম যেখানে অপরাপর সব ধর্মের অধিকার ও মর্যাদা স্বীকৃত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায় নির্বিশেষে ইসলাম ধর্মে রয়েছে অনুপম সহাবস্থান; রয়েছে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও পরমতসহিষ্ণুতার বিরল দৃষ্টান্ত। ইসলামের ইতিহাসে কখনও ইসলাম গ্রহণে ক্ষমতা প্রয়োগ বা জোর-জবরদস্তি ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি। আর তা গ্রহণযোগ্যও নয়।

হেফাজতে ইসলাম মানে ইসলামের সংরক্ষণ। কিন্তু আমাদের আলোচ্য 'হেফাজতে ইসলাম' বর্তমানে সমগ্র দেশে একটি সংগঠন হিসেবে যে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে আলোচিত হচ্ছে_ ইসলামপ্রিয় মানুষ হিসেবে তা আমাদের যথেষ্ট উদ্বেগের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
হেফাজতে ইসলাম বৃহত্তর চট্টগ্রামের বেসরকারি কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক ছাত্র-শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অরাজনৈতিক ধর্মীয় সংগঠন; যার আমির হিসেবে মূল নেতৃত্বে রয়েছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম ও বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হযরত শাহ আহমাদ শাফি। এমন একজন নেতাকে পেয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশে ইসলামের যে কোনো সংকটে, দুর্দিনে ও ধর্মের অপব্যাখ্যায় আলোকবর্তিকা হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু সে ভূমিকা কি পালন করতে পারছে?

আমরা জানি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের অভ্যন্তরে দুটি গ্রুপ পরস্পরবিরোধী অবস্থায় সক্রিয় ছিল। হোসাইন আহমাদ মাদানি ও তার অনুসারীদের একেবারে ঘোরতর বিরোধী অবস্থানে ছিল আবুল আলা মওদুদী ও তার অনুসারীরা। গোটা উপমহাদেশে আজ পর্যন্ত সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে। এমনকি খোদ বাংলাদেশে অজস্র আলেম রয়েছেন, যারা আবুল আলা মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে অপছন্দ করেন। হাক্কানি আলেমগণের কাছে জামায়াতবিরোধিতা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়েও অনেক বেশি ধর্মীয় ও নৈতিক। জামায়াতের কর্মকাণ্ড, কর্মসূচি, কর্মপদ্ধতি, ইমান-আমল ও আকিদা-বিশ্বাস ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় আকিদা-বিশ্বাসে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী একেবারেই সাংঘর্ষিক অবস্থানে। দেশের যে বিপুলসংখ্যক ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও আলেম-ওলামার সঙ্গে জামায়াতের অনৈক্য, অমিল ও দূরত্ব; তাদের মধ্যে হাটহাজারী মাদ্রাসার সর্বজন শ্রদ্ধেয় 'বড় হুজুর' ও তার অনুসারীরা অন্যতম। সে হিসেবে তাদের পরিচালিত সংগঠন হেফাজতে ইসলামও জামায়াতবিরোধী হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সম্প্রতি সারাদেশে জামায়াত যেভাবে হেফাজতে ইসলামের হেফাজতে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাচ্ছে তা কি হেফাজত নেতৃবৃন্দ দেখতে পাচ্ছেন না? এটি সবার কাছে আরও দৃশ্যমান হয়েছে ১৫ মার্চ শুক্রবার জুমা নামাজের পর চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহি মসজিদ থেকে শত-সহস্র জামায়াত সমর্থক হেফাজতের ব্যানার নিয়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত তাদের এক নেতার মুক্তি দাবি করার মধ্য দিয়ে। তাহলে কি জামায়াত তার পুরনো কৌশলে এবার হেফাজতে ইসলামকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে? হেফাজত নেতৃবৃন্দের কাছে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা, তারা কি প্রকৃত অর্থেই ইসলামের হেফাজত চান, নাকি জামায়াতের হেফাজত চান?

পরম করুণাময়ের অশেষ রহমতে যারা ইসলামের সোনালি পরশে ধন্য ও হেদায়াতের গৌরবোজ্জ্বল সম্পদ লাভে সক্ষম হয়েছে তারাও সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদার প্রতীক। সেই রকম একজন মুসলমানকে কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ব্যতিরেকে আমভাবে কাফের, মুরতাদ, বিধর্মী ও নাস্তিক বলে অভিহিত করা কোনোমতেই ইসলামসম্মত নয় বরং এটি সন্দেহাতীতভাবে অনৈতিক, মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন ও মহানবীর (সা.) পবিত্র বাণীর সঙ্গে পরিষ্কার সাংঘর্ষিক। হেফাজত নেতৃবৃন্দের কাছে অনুরোধ, গণহারে সবাইকে অপবাদ না দিয়ে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা সুনির্দিষ্ট আকারে উত্থাপন করুন। ইসলাম ও ইনসাফের দাবিও তাই।

গণজাগরণ মঞ্চ বাঙালির নবপ্রজন্মের নতুন ঠিকানা। ইতিমধ্যেই নতুন প্রজন্মের গর্ব ও অহঙ্কারের প্রতীক হয়ে গেছে এই মঞ্চ। ৫ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী বিষয়ক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া জামায়াতের এক নেতার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শাহবাগে গোড়াপত্তন হয় এই আন্দোলনের। সমাজের আরও নানা মতের, নানা পেশার অসংখ্য মানুষ একাত্মতা প্রকাশ ও সহমর্মিতা প্রদর্শনে সেখানে আসতে থাকেন। প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ শাশ্বত বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা অন্যায়ের কাছে মাথানত করি না, আমরা বহু ত্যাগ আর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল পুরোটাই পেতে চাই। যারা ত্রিশ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, যারা আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে, যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে_ তাদের সর্বোচ্চ বিচার চাই। বাংলাদেশের সহিংস রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপরীতে ন্যায়ভিত্তিক ও যৌক্তিক দাবি আদায়ের অহিংস পন্থা কেমন হতে পারে গণজাগরণ মঞ্চ তার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এ মঞ্চের কর্মী-সমর্থকরা গোটা দেশের কোথাও একটি ককটেল ছোড়েনি, কোনো গাড়িতে ঢিল মারেনি, কাউকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করেনি, কখনও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়নি। নিত্যদিন গণজাগরণ মঞ্চ তার অবস্থান ব্যাখ্যা করছে, স্পষ্ট করে তুলে ধরছে তার ঈপ্সিত লক্ষ্য। কোনো ধর্ম-দর্শন-মতবাদ বা কোনো আদর্শের বিপরীতে তাদের অবস্থান নয়, কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা তাদের কাজ নয়, নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে তারা কোনোমতেই ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। তার পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সব ধর্মের লোকজনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে তারা বিশ্বাসী। প্রতিটি সমাবেশ, মহাসমাবেশ পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু করছে, তারই সঙ্গে অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ থেকেও পাঠ করা হচ্ছে। আলেম-ওলামাও একাত্মতা প্রকাশ করেছেন, বক্তব্য রেখেছেন। জাতি হিসেবে আমাদের জীবনে এরকম সৃষ্টি খুব কম সময়ই এসেছে। তাই যারা দেশকে ভালোবাসি, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করি এবং সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যমুক্ত, সুখী, সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, তাদের সবার উচিত গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্ম হওয়া। 'হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান' অর্থাৎ দেশপ্রেম ইমানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা শুধু দেশপ্রেমের তাড়না থেকেই সমবেত হয়েছে এবং দেশের তরে যা সত্য, সুন্দর ও প্রত্যাশিত তারই আওয়াজ তুলছে। সুতরাং দেশপ্রেমিক সত্যবাদীদের সঙ্গে একাত্ম হওয়া ধর্মের মর্মবাণীর অনুসরণ করারই নামান্তর।

ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন :সহযোগী অধ্যাপক; ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন