শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

এ কোন বাংলাদেশ!

আলী হাবিব
কবির সঙ্গে হঠাৎ করেই দেখা। রাস্তায় হাঁটছিলেন অন্যমনস্কভাবে। পথ আগলে দাঁড়াতেই মুখ তুলে তাকালেন কবি। কেমন যেন অচেনা মনে হলো তাঁকে। এমনিতেই আমরা তাঁকে ব্যর্থ কবি বলি। সহাস্য বদনে তিনি আমাদের এ অভিধা মেনে নেন। পকেট থেকে কাগজ বের করে শুনিয়ে দেন সদ্য লেখা কোনো পদ্য। আজ আর কবি কোনো কবিতা বের করলেন না। কেমন মন খারাপ করা দৃষ্টি তাঁর। না, কবির এই চেহারা তো আমরা আগে কখনো দেখিনি! কবি বিষণ্ন হলে চলবে কেমন করে? চিন্তা হয়। কবি কি কোনো সমস্যায় পড়েছেন? বাংলাদেশে তো সমস্যার অন্ত নেই। বাসভাড়া বাড়ছে। স্বাস্থ্যরক্ষার দোহাই দিয়ে মানুষ না হয় হেঁটেই যাতায়াত করল; কিন্তু বাসাভাড়া বাড়লে তো বাস করাই মুশকিল হয়ে যায়। আগে কোনো ভাড়াটিয়া বাসা ছাড়ার নোটিশ দিলে বাড়িঅলারা চিন্তিত হতেন।
আজকাল নাকি খুশি হন। নতুন ভাড়াটিয়া আসা মানেই বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়া। কবির কাছে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই তিনি মাথা নেড়ে জানালেন, তেমন কোনো কিছুই ঘটেনি তাঁর। তাহলে কবির মুখে হাসি নেই কেন? নতুন কবিতা কি লেখা হচ্ছে না! আজ দেখা হতেই কেন তাঁর পকেট থেকে একটি কবিতা বের হলো না? এমন প্রশ্নের জবাবে কবি অনুচ্চ স্বরে যা বললেন, তাতে বুঝতে পারা গেল, খুবই মন খারাপ তাঁর। মাথা কাজ করছে না। ব্যর্থ কবি বলি তাঁকে। কিন্তু আজ নিজেকেই ব্যর্থ মনে হচ্ছে।

আমাদের চিরচেনা কবিকে সত্যিই অচেনা মনে হলো। বাড়িতে চাল বাড়ন্ত, খৰহস্ত স্ত্রী- তবু আমরা কবির মুখের হাসি উধাও হতে দেখিনি। বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, টিকে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা যখন, তখনো কবির কলম সচল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং কেড়ে নিতে পারেনি তাঁর মুখের হাসি। ছন্দের বারান্দায় তাঁর নিরলস পদচারণা বিঘ্নিত করেনি যাপিত জীবনের কোনো জটিলতা। সব সংকটে তিনি অবিচল থেকেছেন। আমাদের এহেন প্রাণময় কবির মুখের হাসি কেড়ে নিল কে?

ভালো থাকার আর কোনো উপায় নেই, জানালেন কবি। রাস্তায় হাঁটছেন, কিন্তু মন ভালো করার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি- সরাসরি এটাও জানিয়ে দিলেন। কেন তাঁর মন খারাপ? তাঁর মুখের হাসি কেন উধাও হলো? খবরের কাগজ পড়ল তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। টেলিভিশন দেখতে বসলে তাঁর মন খারাপ হয়ে যায়। আবার কাগজ না পড়েও থাকতে পারেন না তিনি। সময় করে গভীর রাত পর্যন্ত চোখ রাখেন টেলিভিশনের পর্দায়। এসব কী দেখছেন তিনি? কী শুনছেন? এসব কী খবর ছাপা হচ্ছে পত্রিকায় পাতায়? যে দেশটিকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে আজ তুমুল আলোচনা। এত ছোট একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও যে দেশটি আগামী দিনের বিশ্বঅর্থনীতিতে তুমুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। কিছু দিন আগেও যে দেশ সম্পর্কে লেখা হতো 'মারি ও মড়ক হানা দেয় বারবার', সেই দেশটি আগামী দিনে উদাহরণ হতে পারে- এমন অমিত সম্ভাবনার দেশটিকে কোনদিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?

কবিকে জানাই, বিশ্বব্যাংকের টাকায় না হলেও এ দেশে পদ্মা সেতু হবে। এ দেশ উন্নতির শিখরে যাবেই। স্বাধীনতার এই মাসে মন খারাপ করে থাকার কোনো কারণ নেই, এমন কথা জানাতেই কবি যা বললেন, সংক্ষেপে তা তুলে ধরা যাক।

গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশে যা ঘটছে তাতে কবির মন খারাপ। কবি বলতে চাইলেন, এমন দেশ তিনি চাননি। কোনো দুঃস্বপ্নেও তিনি দেশের এমন চেহারা দেখেননি। নিজের বাড়ির আঙিনায় বাবার মৃত্যুদৃশ্য দেখছেন তরুণী কন্যা, এমন দৃশ্য কল্পনাও করতে পারে না আমাদের কবি। তা-ও যদি সে মৃত্যু স্বাভাবিক হতো! মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে দয়াল হরি শীলকে প্রাণ দিতে হয়েছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে যা ঘটেছে, সভ্য সমাজে তা কল্পনারও অতীত। শুধু কি বাঁশখালী? সাতক্ষীরা, নোয়াখালী- সর্বত্রই আক্রমণের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। একাত্তরেও তো এমন ঘটনা ঘটেনি। ভিন্ন ধর্মের মানুষের উপাসনালয়ে আগুন দেওয়া কেন? তাদের আরাধ্য দেব-দেবীর মূর্তি ভেঙে কী সুখ গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী ধর্মান্ধ মানুষের? একাত্তরের পর ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশে একবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর এভাবে অত্যাচার শুরু হয়েছিল। এই দেশের জন্যই কি ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিল এ দেশের মানুষ? কবির প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা ছাড়া উপায় নেই। কী জবাব দেব কবির এ প্রশ্নের? এবার যে সহিংসতা শুরু হয়েছে, তার তুলনা কিসের সঙ্গে হতে পারে। এবার তো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রক্ষা পাননি। পাষণ্ড নব্যরাজাকারদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে তাঁদের। জীবনের তাগিদেই পুলিশ বাহিনীতে নাম লিখিয়েছিলেন, দেশের জন্য কিছু একটা করার অঙ্গীকার ছিল যাঁদের, তাঁদের প্রাণহরণেও পিছপা হয়নি নরঘাতক চক্র। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কুপিয়ে হত্যা করেছে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে আসা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের। ছোট ছোট শিশুকে করেছে পিতৃহীন। হায়, যে শিশুটি কোনো দিন তার বাবাকে আর বাবা বলে ডাকতে পারবে না, সেই শিশুর অন্তরের বেদনা ছুঁয়ে যায় না কোন পাষাণ হৃদয়!

প্রকৌশলী তৌহিদ তো শিবগঞ্জে গিয়েছিলেন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে। আক্রান্ত হওয়ার পর শেষ কথা বলেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। জানিয়েছিলেন, আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। বেঁচে থাকার আশা নেই। দোয়া করতে বলেছিলেন স্ত্রীকে। তাঁর মোবাইল ফোনটি অন করা ছিল। স্ত্রী শুনতে পাচ্ছিলেন সব কথা। বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন প্রকৌশলী তৌহিদ। বাঁচতে পারেননি তিনি। চারতলা থেকে তাঁকে নিচে ফেলে দেওয়ার পর পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে? এই নৃশংসতায় মেতে ওঠা মানুষগুলো কি মানুষ ছিল? বাংলার আলো-হাওয়ায় কি বড় হয়েছে? নারায়ণগঞ্জের রাফিউর রাব্বী শুধু নারায়ণগঞ্জে নন, রাজধানীতেও অনেকের কাছের মানুষ। এক সময় লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কী দোষ ছিল তাঁর কিশোর ছেলেটির? পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ নম্বর পাওয়া এমন অসামান্য মেধাবী একটি সন্তান আবার কবে উপহার দিতে পারবে বাংলাদেশ? যে মায়ের সঙ্গে তাঁর নিকট-বন্ধুতা, কেমন কাটছে সেই মায়ের দিন ও রাত? এই জীবন্মৃত নারী কি কোনো দিন ভুলতে পারবেন প্রিয় সন্তানের অভাব? অ্যালবামের ছবি কি কোনো দিন মা বলে ডাকতে পারবে তাঁকে? সন্তানের মৃতদেহের চেয়ে ভারী কোনো বোঝা নেই। সেই ভার কেমন করে সইলেন রাফিউর রাব্বী?

কেন প্রাণ দিতে হলো মিরাজ আহমেদকে? তাঁর ভাই মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাক্ষী বলে? ছোট ভাইটি আর কোনো দিন কোনো আবদার নিয়ে সামনে দাঁড়াবে না, এই কষ্ট ভুলতে পারছেন না মিরাজ আহমেদের বড় বোন। এভাবে মায়ের বুক খালি করে যারা, পিতৃস্নেহ বঞ্চিত করে সন্তানকে, বোনকে করে ভাইহারা, তারা কি এই মাটির সন্তান? স্বাধীনতার চার দশক পরও এ মাটিতে এমন নৃশংস ঘটনা ঘটে, এই কি আমাদের চিরচেনা বাংলাদেশ? বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য যে বাংলাদেশের খ্যাতি, যে দেশের মানুষ সুরে সুরে গায়, 'বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলিম, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান/আমরা সবাই বাঙালি', সেই দেশে আজ এ কোন পাতকের পদধ্বনি শোনা যায়?

কথা বলতে বলতে থামেন কবি। তাঁর দুচোখে তখন জলের ধারা। নির্বাক তাকিয়ে থাকি তাঁর মুখের দিকে। নিজেকে এতটা সামলে নিয়ে কবি বুক পকেট থেকে বের করেন একটি রুল টানা কাগজ। পূর্বানুমতির প্রয়োজন নেই। কবি পড়ে যান তাঁর নতুন লেখা কবিতা : 'এ রকম দেশ কোথাও পাবে না/তাবৎ পৃথিবী ঢুঁড়ে/এখানে জীবন নিশ্চিত নয়/ঘাতক বেড়ায় ঘুরে।/পাতক ও ঘাতকে দারুণ সখ্য/দেখা যায় তার রেশ/আগুনে পুড়ছে সম্প্রীতি আজ/এ কোন বাংলাদেশ!/এখানে গুপ্ত-ঘাতকেরা তৎপর/পুড়ছে বসতি, পড়ছে সহসা লাশ/আমাদের চাওয়া ছিল কি এমন দেশ?/কোন দেশে আজ আমাদের বসবাস!'
কবির এই প্রশ্নের জবাব কি জানা আছে আমাদের কারো?
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন