এ কে এম শাহনাওয়াজ
বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছে স্পষ্টভাবে তেমন মনোভাবও দেখায়নি জামায়াত। উপরন্তু ধর্মের নাম ভাঙিয়ে জঙ্গি রাজনীতির মদদ দিয়ে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। এ কারণেই দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে চারদিক থেকে
চটপটে সতেজ তরুণ ছেলেটি আমার এক ছাত্রের বন্ধু। ধরি, ওর
নাম আহমদ ফয়সাল। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। মাঝে মধ্যে আমার
সঙ্গে দেখা হয়। কথাবার্তায় বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। ধার্মিকও বটে। সাভার অঞ্চলে
ওর বাড়ি। ছুটিতে বাড়ি এলে মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ইতিহাসের
নানা বিষয়ে ফয়সালের কৌতূহল। জানার অনেক আগ্রহ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলে।
বিশেষ করে বাংলায় ইসলাম ধর্ম বিস্তারের খুঁটিনাটি বিষয় জানার আগ্রহ ওর বেশি। জানায়-আমার কলাম ও পড়ে এবং বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ে। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম ফয়সাল ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একটু অবাক হলাম এ জন্য যে, আমার ধারণা ছিল মুক্তচিন্তায় লেখা কলাম রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের সাধারণত পছন্দ হয় না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত- সবারই সমালোচনার পাত্র হতে হয়। এক ঘরানার পাঠক ভাবে আমি ওই দলের সমর্থক, আর অন্য পক্ষ ভাবে এই দলের। এসব দলীয় মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ইন্টারনেটে পড়ে আমি অভ্যস্ত। সম্প্রতি জামায়াতের অপরাজনীতি এবং এদের স্বার্থবাদী অমানবিকতা নিয়ে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছি। তাতে জামায়াত-শিবির ভাবাদর্শের মানুষদের বকাঝকার শব্দবাণে বিদ্ধ হয়েছি অনেক। ব্যতিক্রমী চিঠিও যে পাইনি তেমন নয়। এ পর্যন্ত আমি যতজন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ দেখেছি এবং কথা বলেছি, তাতে ওদের বেশ একরোখা ও বদ্ধ-বুদ্ধির মনে হয়েছে। ধর্ম নিয়ে কথা বলেছে কিন্তু তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেনি। ইসলাম ধর্মকে যে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে আমার মনে হয়নি। বা উপলব্ধি করলেও কাজে তার প্রতিফলন ঘটানোর চিন্তা করে বলে মনে হয় না। ধর্মবণিক সুবিধাবাদী নেতাদের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মচিন্তাই ওদের মাথায় কাজ করে। সেটুকু পুঁজি নিয়েই জিহাদি মনোভাব পোষণ করে। অজ্ঞতার কারণে যে আচরণ করে তাতে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধর্ম। ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য ওদের আচরণের কারণে কালিমালিপ্ত হয়।
বিশেষ করে বাংলায় ইসলাম ধর্ম বিস্তারের খুঁটিনাটি বিষয় জানার আগ্রহ ওর বেশি। জানায়-আমার কলাম ও পড়ে এবং বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ে। কিছুদিন আগে জানতে পারলাম ফয়সাল ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একটু অবাক হলাম এ জন্য যে, আমার ধারণা ছিল মুক্তচিন্তায় লেখা কলাম রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের সাধারণত পছন্দ হয় না। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত- সবারই সমালোচনার পাত্র হতে হয়। এক ঘরানার পাঠক ভাবে আমি ওই দলের সমর্থক, আর অন্য পক্ষ ভাবে এই দলের। এসব দলীয় মানুষের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ইন্টারনেটে পড়ে আমি অভ্যস্ত। সম্প্রতি জামায়াতের অপরাজনীতি এবং এদের স্বার্থবাদী অমানবিকতা নিয়ে কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে লিখেছি। তাতে জামায়াত-শিবির ভাবাদর্শের মানুষদের বকাঝকার শব্দবাণে বিদ্ধ হয়েছি অনেক। ব্যতিক্রমী চিঠিও যে পাইনি তেমন নয়। এ পর্যন্ত আমি যতজন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ দেখেছি এবং কথা বলেছি, তাতে ওদের বেশ একরোখা ও বদ্ধ-বুদ্ধির মনে হয়েছে। ধর্ম নিয়ে কথা বলেছে কিন্তু তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে কোনো ধারণা দিতে পারেনি। ইসলাম ধর্মকে যে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে আমার মনে হয়নি। বা উপলব্ধি করলেও কাজে তার প্রতিফলন ঘটানোর চিন্তা করে বলে মনে হয় না। ধর্মবণিক সুবিধাবাদী নেতাদের চাপিয়ে দেওয়া ধর্মচিন্তাই ওদের মাথায় কাজ করে। সেটুকু পুঁজি নিয়েই জিহাদি মনোভাব পোষণ করে। অজ্ঞতার কারণে যে আচরণ করে তাতে বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয় ধর্ম। ইসলাম ধর্মের সৌন্দর্য ওদের আচরণের কারণে কালিমালিপ্ত হয়।
দিন দুই আগে ফয়সাল এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল ওকে। বলল, স্যার আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি শিবিরের কর্মী বলে কোনো নেতিবাচক ধারণা নিয়ে আমাকে বিচার করবেন না। সংখ্যায় কম হলেও আমার মতো অনেক শিবিরকর্মী আছে যারা ইসলাম ধর্মকে সমুন্নত রাখতে চায় ইসলামের শান্তির পথ ধরেই। জামায়াতে ইসলামীর ভেতর তেমন আদর্শ আছে বিশ্বাস করেই আমরা শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরের প্রজন্ম। একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। এটি সে সময়ে জামায়াতের রাজনৈতিক দর্শন ছিল। বিশ্বাসের স্বাধীনতা থাকতেই পারে। একে আমরা খুব অন্যায় বলে মনে করি না। তবে অবশ্যই সে সময়ের জামায়াতের মানবতাবিরোধী অপরাধের সমর্থক আমরা নই। এ কারণে আমার মতো ভাবনার জামায়াত-শিবিরকর্মীরা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ঘৃণা করে। তাদের বিচারে আমাদের সমর্থন রয়েছে। তবে নানা বাস্তবতায় আমরা তা প্রকাশ করতে পারি না। একই কারণে শিবিরের জঙ্গিবাদী অমানবিক কাজেও আমাদের সমর্থন নেই। আসলে স্বার্থবাদী নেতারা আমাদের ভুল পথে চালাচ্ছেন। তবে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর প্রতি আমাদের ভালোবাসা আছে। একাত্তরের কালিমা থেকে মুক্ত হয়ে একুশ শতকের নতুন জামায়াতে ইসলামীকে আমরা পেতে চাই। এ কারণে অন্যায়কারী নেতাদের দায় আমরা নিতে চাই না।
একটু দম নিল ফয়সাল। আমি আগ্রহভরে ওর কথা শুনছিলাম। সম্প্রতি সাঈদীর রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ জুড়ে জামায়াতের তাণ্ডব ফয়সালকে ব্যথিত ও লজ্জিত করেছে। কথায় বেশ বুঝতে পারছি ফয়সাল ধর্মান্ধ নয়-একজন ধার্মিক ছেলে। কারও আচরণে ইসলামের সৌন্দর্য কালিমালিপ্ত হোক তা সে সহ্য করতে পারছে না। ফয়সাল কয়েকটি বিষয়ে জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত। এই ধার্মিক ছেলেটির বিচারে ওরা জেনে-শুনে ইসলাম-বিরুদ্ধ কাজ করছে। যেমন জামায়াতের এখনকার ভারপ্রাপ্ত আমির (?) রফিকুল ইসলাম গত ৪ ফেব্রুয়ারি শাপলা চত্বরের জনসভায় কাদের মোল্লাকে বাঁচাতে জেনে-বুঝে মিথ্যা কথা বলেছিলেন। বলেছেন, মিরপুরের কসাই কাদের আর কাদের মোল্লা এক ব্যক্তি নন। ঠিক একইভাবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আদালতে মিথ্যা জবানী দিয়ে বলেছিলেন, দেলোয়ার শিকদার বা দেল্যা রাজাকার আর তিনি এক ব্যক্তি নন। একজন সাচ্চা মুসলমান এভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারেন না।
আদালতে বিচার প্রক্রিয়া চলমান থাকার পরও সাঈদীকে বাঁচাতে এবং বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে সারাদেশে জামায়াতের তাণ্ডব চলছে। হাজার হাজার সরল মুসলমানকে ভুল বুঝিয়ে ধর্মবিরোধী অমানবিক কাজে লিপ্ত করাকে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ফয়সাল। ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু উপলব্ধি হয়েছে তাতে ফয়সাল বিশ্বাস করে ধর্ম রক্ষা নয়, কতিপয় মানবতাবিরোধী অপরাধীকে রক্ষা করার জন্য সাধারণ মানুষের ঘরে আগুন দেওয়া, সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা করা, গাড়ি-ট্রেনে আগুন দেওয়া, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা, কর্তব্য পালনরত পুলিশ হত্যা করা এসব ধর্মের দৃষ্টিতে গর্হিত অপরাধ। তবে ফয়সাল সরকার এবং সরকারি দলেরও সমালোচনা করেছে। ওর ভাষায় অনেক জায়গায় প্রতিবাদী নারী ও শিশু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে মারা গেছে। এ জন্য সরকারকেও অপরাধী হতে হবে।
আমি প্রাথমিকভাবে ফয়সালের সঙ্গে কিছুটা সহমত পোষণ করে ইতিহাস থেকে একটি তথ্য ব্যাখ্যা করলাম। বললাম, দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর আদর্শের প্রতি তুমি অনুরাগী হতে পার। একে বাঁকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। তবে তুমি ইতিহাস ঘাঁটলে এই দলটিকে নেতারা যেভাবে ও যে উদ্দেশ্যে পরিচালনা করেছেন তাতে তেমন ধর্মনিষ্ঠতার পরিচয় পাবে না। ধর্মকে শুধু ব্যবহার করেছেন এসব ধর্মবণিক। ইতিহাসে দেখা যাবে সব ধর্মেই একদল স্বার্থবাদী মানুষ থাকে, যারা ধর্মের দোহাই দিয়ে সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং অত্যন্ত অমানবিকভাবে হলেও নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভ আদায় করতে চায়। ইউরোপের ইতিহাসের দিকে তাকালে এর একটি প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে। ১১ শতকের শেষদিকে অভিন্ন স্বার্থবাদী চিন্তায় অর্থাত্ রোমান পোপ তার হাতছাড়া হয়ে যাওয়া রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার জন্য এবং ইতালির বণিকরা ভূমধ্যসাগরের ওপর কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মের নামে ক্রুসেড বাধিয়ে দেয়। পরপর চারটি ক্রুসেডেও যখন মুসলমান শক্তিকে পরাস্ত করা গেল না তখন অমানবিক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১২১২ খ্রিস্টাব্দে যে ক্রুসেড সংঘটিত হয় ইতিহাসে তা ‘শিশু ক্রুসেড’ নামে পরিচিত। এটি ছিল সবচেয়ে মর্মস্পর্শী ক্রুসেড। ধর্ম-উন্মাদ পোপ নিয়ন্ত্রিত ক্রুসেড আয়োজক খ্রিস্টানরা ইউরোপ থেকে কয়েক হাজার শিশু সংগ্রহ করে। উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে শিশুদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও ক্লান্তিতে পথিমধ্যে অনেক শিশু মারা যায়।
একই পথে হাঁটছেন এখন বাংলাদেশের জামায়াত নেতারা। তারা গাড়ি, বসতবাড়ি, অফিস-আদালতে আগুন লাগাতে বা পুলিশের ওপর আক্রমণ চালাতে গ্রামবাসীদের উত্তেজিত করে পথে নামাচ্ছেন। সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। অত্যন্ত অমানবিকভাবে মিছিলের সামনে দিচ্ছেন স্কুল-মাদ্রাসায় পড়ুয়া কোমলমতি শিশুদের। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এ রকম কয়েকজন শিশু নিহত ও আহত হয়েছে।
এভাবে দীর্ঘ বক্তৃতার পর ফয়সালকে জিজ্ঞাসা করলাম, এমন বাস্তবতায় তুমি সরকারকে কতটুকু দায়ী করতে চাও? ফয়সাল কোনো কথা বলল না। অনেকক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।
আহমদ ফয়সালের সঙ্গে আলাপচারিতার পর ঘন অন্ধকারের মধ্যেও এক চিলতে আলো দেখতে পেলাম। ওদের মতো শিবিরকর্মীদের অবস্থান যদি বাড়ে তবে বদ্ধ-বুদ্ধির রাজনীতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে সন্দেহ নেই। তবে এখন যেসব ধর্মবণিক অমানবিক জামায়াতের নেতৃত্ব অনুগত তরুণদের বিভ্রান্ত করে খুনি বানানোর মতো মহাপাতকের কাজ করছে। গত ৪ মার্চ চট্টগ্রামে ধরা পড়েছে ৮ শিবিরকর্মী। তারা জামায়াত ও সাঈদীর সমালোচনাকারী ১০ ইসলামী চিন্তাবিদ আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। আমি জানি না ফয়সাল এসব শিবিরকর্মী সম্পর্কে কী ব্যাখ্যা দেবে। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নেতৃত্ব এখনও মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছে স্পষ্টভাবে তেমন মনোভাবও দেখায়নি। উপরন্তু ধর্মের নাম ভাঙিয়ে জঙ্গি রাজনীতির মদদ দিয়ে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করছে। এ কারণেই জামায়াতে ইসলামী দলটিকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠছে চারদিক থেকে।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Source: http://www.shokalerkhabor.net/details_news.php?id=128716&&%20page_id=%2067
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন