জনকণ্ঠ, স্টাফ রিপোর্টার ॥ গণমানুষের আন্দোলন-সংগ্রাম কিংবা আশা-আকাক্সক্ষার
শিল্পিত রূপ গণসঙ্গীত। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে এদেশের
প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গণমানুষের শিল্পের হাতিয়ার হয়েছে গণসঙ্গীত। এ
প্রেক্ষাপটেই সম্প্রতি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলার প্রতিবাদে শুরু হলো দুই দিনব্যাপী
গণসঙ্গীত অনুষ্ঠান। একইসঙ্গে গণমানুষের এ গানের আসরে যুক্ত হয়েছে
যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার সম্পন্ন ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবি।
মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে শুরু
হওয়া এ সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজক গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদ। উদ্বোধনী দিনে গানের
সুরে, কবিতার ছন্দমালা ও কথায় উঠে আসে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী প্রতিবাদ ও
একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের অপতৎপরতা প্রতিরোধের বাণী।
বসন্তের রোদমাখা বিকেলে শুরু হয় অনুষ্ঠান। প্রথমেই গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীত। এরপর পরিবেশিত হয় শাহবাগের গণজাগরণের চেতনায় রচিত গান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে কণ্ঠশিল্পী ইমতিয়াজ গেয়ে শোনান ‘বলো বলো জয় বাংলা/রক্তে জয় বাংলা/নিঃশ্বাসে জয় বাংলা’। গান শেষে শুরু হয় আলোচনা। পরিষদের সভাপতি গণসঙ্গীত শিল্পী ফকির আলমগীরের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহ-সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ ও সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল ঝুনা চৌধুরী এবং পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মিজান চৌধুরী। সভা সঞ্চালনা করেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সহ-সভাপতি হাবিবুল আলম।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোন ঠাঁই নেই। কিন্তু একাত্তরের ঘাতক-দালাল জামায়াত ও তাদের শিষ্য শিবির পুরনো কায়দায় আবারও দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও উপাসনালয়ে তা-বলীলা চালাচ্ছে। জাতীয় পতাকা থেকে শুরু করে জাতির চেতনার প্রতীক শহীদ মিনার পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে এই বর্বরদের হামলায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে শাহবাগের গণজাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত লাখ লাখ মানুষকে নাস্তিকতার মোড়কে অভিযুক্ত করছে। আর জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে এই মিথ্যা প্রচারণায় যুক্ত হয়েছেন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। তবে গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ গণদাবির কাছে সব অপতৎপরতাই ভেসে যাবে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে আজ শিল্পী, কবি, সংস্কৃতিকর্মী ও সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ এক মঞ্চে দাঁড়িয়েছে। একাত্তরের পাপী কাদের মোল্লার বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে শাহবাগে সৃষ্ট গণজাগরণ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি প্রান্তে। বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোন শক্তিই রাজনীতি করার অধিকার রাখে না। একাত্তরের শহীদদের প্রতি অবমাননা মেনে নেবে না স্বাধীন বাংলার মানুষ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর হওয়ার পর তাদের লাশ বাড়িতে পৌঁছার পরই শহীদদের উত্তরসূরি হিসেবে জাতির ঋণ শোধের দায়ভার শেষ হবে। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতির ঐক্যবদ্ধতার শক্তিকে ধারণ করে আগামী নির্বাচনে কোনো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না।
কথা শেষে মঞ্চজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে গণসঙ্গীতের প্রতিবাদী সুর। একাত্তরের পাপী ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের ধিক্কার জানিয়ে উদীচীর শিল্পীরা গেয়ে শোনায় ‘একাত্তরের ছিল যারা খুনী রাজাকার/আজকে তারা ধর্মের ব্যবসায় সাজেন পরহেজগার’ ও ‘জীবন মোদের দুর্বিষহ কুইরা তুলছে রাজাকার’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিকতা উঠে আসে স্বাধিকারের শিল্পীদের গানের সুরে। অনেক কণ্ঠ এক সুরে গেয়ে যায় ‘খুনের বিচার চাইলে ভাই/দোষের কোন বালাই নাই’। এ দলের পরিবেশিত আরও তিনটি গান ছিল ‘আমার জন্মভূমি’, ‘ব্যাঙের আবার নাকে সর্দি’ ও ‘আর দেরি নয়/আর দেরি নয় নওজোয়ান’। সংগ্রামের পথচলা ও যুদ্ধাপরাধীদের ধিক্কার জানিয়ে সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী পরিবেশন করে ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবেই’, ‘সোনায় মোড়ানো বাংলা মোদের শ্মশান করেছে কে’ ও ‘একাত্তরের শকুনগুলো উড়ছে আবার দেশজুড়ে’। সংগ্রামের চেতনা ধারণ করে পঞ্চভাস্কর পরিবেশন করে ‘পুতুল খেলবার দিন নয় অদ্য’ ও ‘লাঞ্ছিত-নিপীড়িত জনতার জয়’। এ ছাড়াও দলীয়ভাবে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে বহ্নিশিখা ও মংলু শিল্পীগোষ্ঠী। একক কণ্ঠে গণসঙ্গীত গেয়ে শোনান আবদুল জব্বার, ফকির আলমগীর, স্বর্ণময়ী ম-ল, ইফফাত আরা নার্গিস, মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না, খন্দ্রেনাথ সরকার প্রমুখ। দলীয় আবৃত্তি পরিবেশন করে কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র। একক কণ্ঠে আবৃত্তি করেন দেবাশীষ রূপন ও অনন্যা লাবনী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন