শুক্রবার, ১৫ মার্চ, ২০১৩

শাহবাগে শান্তির দূতের অনুপস্থিতি

মোজাম্মেল খান
এটা ছিল ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ। এক বাঙালী যুবক, তখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেটের জন্য অধ্যয়নরত ছিলেন, যিনি তার দেশের ঘটনাবলির দিকে তীক্ষè নজর রাখছিলেন। দুপুরের দিকে তিনি তাঁর রেডিও অন করলেন ঢাকার খবর নেয়ার জন্য। ঢাকা সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত খবর ছিল যেটাতে বলা হলো, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনের জন্য অভিযান শুরু করেছে। আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পালিয়ে গেছেন।’
এক ঘণ্টার ভেতর ওই এলাকায় বসবাসরত পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত যে ৫ জন বাঙালী ছিলেন তারা একটা বাড়িতে একত্রিত হলেন ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য। তাদের কাছে সংবাদটা অত্যন্ত পরিষ্কার ছিল আর সেটা হলো, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালীদের চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিতে চায়।’
উপস্থিত সবাই ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোন সর্বসম্মত উপলব্ধিতে আসা সম্ভব হচ্ছিল না। ওই বাঙালী যুবকের ভাষায়, ‘আমাদের ভেতর একজন জামায়াতী সমর্থক ছিলেন’, যিনি বারবার বলছিলেন, আসল ঘটনা আমরা জানি না। চলুন আমরা অপেক্ষা করি আরও বিস্তারিত না জানা অবধি।’ এর উত্তরে উত্তেজিত বাঙালী যুবক, তাঁর নিজস্ব ভাষায়, ‘আমাদের যতটুকু জানা দরকার তার সবটাই আমরা জানি। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। এ মুহূর্তে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা সেই নতুন দেশের নাগরিক কি না। প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখেন। আমি বাংলাদেশের প্রতি আমার আনুগত্য ঘোষণা করছি। যদি কেউ আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত পোষণ করেন সেটাকে আমি স্বাগত জানাব। যারা আমার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে না তাদের আমি পাকিস্তানী হিসেবে গণ্য করব এবং তারা বাংলাদেশের শত্রু।

২৭ মার্চ তারা যখন খবর পেলেন শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁর নিজের ভাষায়, ‘সংবাদটা পেয়ে আমাদের সবারই চোখে জল এসে গেল। এর আগ পর্যন্ত আমরা সবধরনের সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা করছিলাম যে, শেখ হয়ত কোন আন্ডারগ্রাউন্ড বাংকার থেকে জাতিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। জাতির জন্য প্রয়োজন ছিল রেডিও থেকে তার জীবন্ত কণ্ঠ। তাঁর বজ্রকণ্ঠের কাছে পাকিস্তানীদের আধুনিক ট্যাংকেরও অনিবার্য পরাজয় ঘটতো।’
পরবর্তী নয় মাস এ বাঙালী যুবক আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ঘুড়েছেন, তাঁর নিজের নতুন দেশের জন্য সমর্থন আদায়ে যার মধ্যে ছিল : বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক স্বীকৃতি, পাকিস্তানীদের সামরিক সাহায্য বন্ধ, বাংলাদেশের গণহত্যা বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তি।
পরবর্তীতে এ বাঙালী যুবকটি দেশে ফিরে আসবেন তাঁর নিজের নতুন দেশের পুনর্গঠনে। সেদেশেই তিনি তাঁর নিজের চিন্তার ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন একটা ভিন্নধর্মী আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেটা তাঁকে সমস্ত দুনিয়ায় পরিচিতি এনে দেবে এবং পরবর্তীতে এনে দেবে এক বিরল সম্মান : শান্তিতে নোবেল পুরস্কার।

৪২ বছর পর জাতির দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে আর এক ক্রান্তিলগ্ন। এবারে অবশ্য এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে নতুন প্রজন্মের তরুণেরা যাদের বেশির ভাগেরই জন্ম হয়নি যখন ওই বাঙালী যুবক দূর থেকে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন। নতুন প্রজন্মের এ যুদ্ধ, যাকে অভিহিত করা হচ্ছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে, অনেক দিক দিয়েই প্রথম মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদা। এ যুদ্ধে যে অস্ত্রসমূহ ব্যবহার করা হচ্ছে সেটা কোন মারণাস্ত্র নয়, এটা কাউকে হত্যা করে না বা কারোরই কোন ক্ষতি করে না; তা সত্ত্বেও এগুলো পৃথিবীর সর্বাধনিক মারণাস্ত্র থেকে বেশি শক্তিশালী। কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ প্রমাণ করেছে- দেশের একপ্রান্ত থেকে আর একপ্রান্ত অবধি লাখো কোটি মানুষের তিন মিনিটের স্বতঃস্ফূর্ত নীরবতা সবচেয়ে শব্দময় আগ্নেয়াস্ত্র থেকে বেশি শব্দময়, লাখো প্রজ্বলিত মোমবাতির আলো পূর্ণিমার চন্দ্রের থেকেও শুভ্র ও আলোকময়। নিযুত কণ্ঠে গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ শ্রুত হয়েছে শুধু দেশের ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই নয়, শ্রুত এবং গীত হয়েছে কেপটাউন থেকে কানাডা অবধি। সমালোচকদের ঘৃণা নয়- ভালবাসা উদ্রেকের আহ্বানের জবাবে আন্দোলনের নেতার যথাযোগ্য জবাব, ‘আামদের হৃদয়ে ভালবাসার কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু আমাদের সে ভালবাসা আমাদের দেশের জন্য, মক্তিযুদ্ধের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।’

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এ গণজাগরণের অভিনব অহিংসা এবং এর উদ্দেশ্যের সুস্পষ্টতা অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে স্থান করে নিয়েছে, বিশেষ করে যে সমাজে হিংসা নিত্যদিনের সঙ্গী। যুক্তরাজ্যের Independent 'the war Bangladesh can never forget'’ হেডলাইনে লিখেছে, ‘বন্দুক স্তব্ধ হয়েছে ৪০ বছর আগে, কিন্তু বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত, রক্তাক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষত আজও জ্বলছে। কিন্তু এটা এমন একটা দেশ যার জন্মের যন্ত্রণা দূর করার প্রচেষ্টা অতীতে করা হয়নি। যে প্রতিবাদ আজ চলছে জাতীয় জাদুঘরের বাইরে সেটা শুধু অভিনব প্রকৃতিরই নয়, এর বিরাটত্ব নজিরবিহীন।’

CNN 'The spirit of `71 Rises at Shahbag Square in Dhaka’ হেডলাইনে লিখেছে, ‘সব শ্রেণীর নারী-পুরুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা, ধর্ম, পেশার মানুষ নির্বিশেষে জমায়েত হয়েছে শাহবাগ স্কয়ারে, শুধু একটা দাবির জন্য, যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝোলাও।’

দুর্ভাগ্যক্রমে, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের মতো আগের দুই ক্রান্তিলগ্নেও আমাদের যেমন শত্রু ছিল, আজকের এ ক্রান্তিলগ্নেও আমাদের তেমনি শত্রু রয়েছে বিভিন্ন পরিচিতিতে, যারা মিথ্যার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টায়। ভাষা আন্দোলনের সময় প্রপাগান্ডা করা হয়েছিল সীমান্তের ওপার থেকে আন্দোলনকারীরা এসেছে এবং আমাদের মহান [RTF bookmark start: }_GoBack[RTF bookmark end: }_GoBack সন্তানেরা সর্বোচ্চ আত্মবলিদানের মাধ্যমে প্রমাণ করল ওই প্রপাগান্ডা কতটা প্রতরণাপূর্ণ ছিল। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা সবাই ছিলাম ‘ভারতীয় দুষ্কৃতকারী এবং দালাল’ যারা এই ‘পবিত্র ভূমিকে ভারতের অংশ বানাতে চায়’। বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে, যেখানে প্রথম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আবার প্রজ্বলিত হয়েছে, সে নজিরবিহীন অহিংস আন্দোলনকে ইসলামের বিরুদ্ধে আন্দোলন বলে অপপ্রচার চালিয়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে উস্কে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে এবং ভারত নাকি এটাকে ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ করছে।

এ ধরনের ভিত্তিহীন এবং যুক্তিহীন অপপ্রচারের বিপরীতে দেশে-বিদেশের সব বিবেকবান বাঙালী যারা ’৭১-এর চেতনার পুনঃপ্রজ্বলনে আশার আলো খুঁজে পেয়েছেন, তারা সবাই এ ঐতিহাসিক আন্দোলনের সঙ্গে নিরলসভাবে একাত্মতা জানিয়ে চলেছেন এ আন্দোলনের যোদ্ধাদের নৈতিক বল বৃদ্ধির মানসে। এ ক্রান্তিলগ্নে জাতির বর্তমান সময়ের সবচেয়ে সুপরিচিত সন্তান, যিনি এ প্রজন্মের সন্তানদের রোল মডেল হিসেবে বিবেচিত, তার দৈহিক অনুপস্থিতি বা আশীর্বাদের অনুপস্থিতি যে যৌক্তিক প্রশ্নের উদ্রেক করবে সেটাই স্বাভাবিক। অথচ এ তরুণ যোদ্ধাই বিনা অস্ত্রে ৪২ বছর আগে যে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন সেটার অসমাপ্ত অধ্যায় শেষ করার মানসে এক অভিনব অহিংস আন্দোলন দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৭১ সালে মাত্র মুহূর্তের মাঝে তিনি তাঁর ভবিষ্যত করণীয় স্থির করেছিলেন, তার বিপরীতে বিগত এক মাসেও জাতি জানতে পারেনি বর্তমান আন্দোলন সম্পর্কে তার ভাবনা, যদিও ৪২ বছর আগে তার অংশ নেয়া সংঘটিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধের এটা এক অবিচ্ছেদ্য পরিপূরক। উপরন্তু এ অহিংস আন্দোলনের বিপরীতে এর বিরোধীরা দেশব্যাপী অশান্তি হিংসার যে তা-বলীলা শুরু করেছেন তার বিপরীতে শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নীরবতাতে সাধু নোবেলের দেয়া দায়বদ্ধতাকে কি তিনি সম্মান জানাতে পেরেছেন? এর বাইরে এ নতুন প্রজন্মের আকাক্সক্ষার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের ব্যর্থতায় ভবিষ্যতে তাদের কোন উপদেশ দেয়ার নৈতিক অধিকার কি তিনি হারিয়ে ফেলছেন না?

লেখক : কানাডা প্রবাসী অধ্যাপক
Source: http://www.dailyjanakantha.com/news_view.php?nc=13&dd=2013-03-12&ni=128446

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন