মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০১৩

রাজাকার-আলবদররা নিজামীকে নেতা বলে জানান

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
ঢাকা: ‘‘ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার ও নির্যাতন ক্যাম্পে আর্মির পিকআপে করে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও গোলাম আজম সেন্টারে আসেন। রাজাকার-আলবদররা তাদেরকে নেতা বলে জানান। সেখানে তারা এক দেড় ঘণ্টা আলাপ করেন। পরবর্তীতে একাধিকবার ওই তিন নেতা এই ট্রেনিং ক্যাম্পে আসেন বলে শুনেছি।’’

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে এসে এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন রোস্তম আলী মোল্লা। তিনি নিজামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের তৃতীয় সাক্ষী। তিনি মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ।

সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য নিজামীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তার উপস্থিতিতেই সাক্ষী রোস্তম নিজামীকে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এবং রাজাকার-আলবদরদের নেতা হিসেবে অভিযুক্ত করেন। সাক্ষ্য শেষে তিনি আসামির কাঠগড়ায় আসামি নিজামীকে সনাক্তও করেন।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর মীর ইকবাল এই সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। হরতালের কারণ দেখিয়ে নিজামীর সিনিয়র আইনজীবীরা অনুপস্থিত থাকায় একজন জুনিয়র আইনজীবী সাক্ষীকে জেরা শুরু করেছেন। জেরা অসমাপ্ত অবস্থায় ৩১ মার্চ পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

বর্তমানে ৬৭ বছর বয়সী রোস্তম আলী মোল্লা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী (নিরাপত্তারক্ষী)। তিনি এর আগে গত বছরের ১৩ নভেম্বর যু্দ্ধাপরাধে অপর অভিযুক্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধেও ৫ম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন ট্রাইব্যুনাল-২ এ।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালেও রোস্তম আলী মোল্লা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার এলাকায় থাকতেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এই সাক্ষী বলেন, ‘‘ঢাকার মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর ট্রেনিং সেন্টার ও নির্যাতন ক্যাম্প চালু হওয়ার পর একদিন আমি বাজারে যাওয়ার জন্য কলেজ গেটে আসি। সেখানে দেখতে পাই, আর্মির পিকআপে করে মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও গোলাম আজম সাহেব ওই ট্রেনিং সেন্টারে আসেন।’’

‘‘ওই সময় ট্রেনিং ক্যাম্পের কর্তব্যরত রাজাকার-আলবদররা তাদেরকে (নিজামী, মুজাহিদ, গোলাম আযম) নেতা বলে জানান। সেদিনই আমি তাদের প্রথম দেখি এবং চিনি। সেখানে তারা এক দেড় ঘণ্টা আলাপ করেন। পরবর্তীতে একাধিকবার ওই তিন নেতা এই ট্রেনিং ক্যাম্পে আসেন বলে শুনেছি।’’

সাক্ষী বলেন, ‘‘দেশ স্বাধীন হওয়ার ১০ দিন আগে পাকিস্তানি আর্মি, আলবদর ও রাজাকাররা কিছু বাঙালি আর্মি বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী ও বাঙালি মেয়েসহ ২ থেকে আড়াইশ’ জনকে ধরে আনে। ঘরের সিড়ির সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিযে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হাত-পা ভেঙ্গে দেয় তাদের।’’

‘‘পরে ক্যাম্পের নিচতলার ডাইনিং রুমে নিয়ে হত্যা করা হয় তাদের। হত্যার পর তাদের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ফেলে দিয়ে আসে।’’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে সাক্ষী বলেন, ‘‘দেশ স্বাধীনের পরের দিন ওই ক্যাম্প থেকে ৯টি কাটা মাথা উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছু জালালকে দেই এবং রহিম ব্যাপারির খাল ও ব্রিকফিল্ড থেকে এক দেড়শ’ মানুষের চোখ উদ্ধার করে দেই।’’

ওই ট্রেনিং ক্যাম্প নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে রোস্তম আলী মোল্লা বলেন, ‘‘স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার ২ থেকে ৩ মাস পর পাকিস্তানি আর্মিরা বাঙালি মেয়েদের ধরে এনে এই ক্যাম্পে ধর্ষণ করতো। অনেককে আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।’’
বিচ্ছু জালাল নামে পরিচিত নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন নিজামীর আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট তারিকুল ইসলাম।

গত বছরের ২৬ আগস্ট শুরুর পর এ পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের আরও দু’জন সাক্ষী নিজামীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হচ্ছেন, বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাউর রহমান চৌধুরী ও মুক্তিযুদ্ধকালে বিচ্ছু বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গেরিলা যোদ্ধা জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল। আসামিপক্ষ তাদের জেরা সম্পন্ন করেছেন।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৮ মে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৬টি অভিযোগ এনে নিজামীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের ৩(২)(এ), ৩(২)(সি), ৩(২)(জি), ৩(২)(এইচ), ৪(১), ৪(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, উস্কানি ও সহায়তা, পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্র এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ মোট ১৬টি ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগের মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুন মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে একই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়।

২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এতে তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হত্যা, খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগ আনা হয়।

এ বিষয়ে প্রসিকিউশন ৩৩৬ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে। আর আনুষঙ্গিক কাগজপত্রসহ প্রায় আড়াই থেকে ৩ হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট তৈরি করা হয়।

গত বছরের ৯ জানুয়ারি নিজামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এতে মোট ১৫টি অভিযোগ ছিল। অভিযোগ গঠনকালে বুদ্ধিজীবী হত্যা যোগ হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন