বৃহস্পতিবার, ২১ মার্চ, ২০১৩

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদিবাসী সৈনিক

মিথুশিলাক মুরমু
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ ঢাকার মিরপুরের যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ৪২৯ অনুচ্ছেদের ১৩২ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করেন। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের রায় প্রত্যাশিত না হওয়ায় বস্নগার অ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের নেতৃত্বে যে গণজাগরণ চলমান রয়েছে, সেটিতে ঢাকায় পড়াশোনারত আমার পরিচিত আদিবাসী তরুণ-তরুণীরাও স্বতস্ফূর্তভাবে যোগ দিয়েছে। ঢাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী চাকরিজীবীরা শাহবাগ চত্বরে যোগদান করে সংহতি প্রকাশ করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আহূত গণজাগরণের সভাগুলোতেও আদিবাসীরা শামিল হবে এটি প্রত্যাশিত। আদিবাসী তরুণরা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বিরোধীরা যে ধ্বংসলীলা, বর্বর ও হিংস্র চেহারায় অবতীর্ণ হয়েছিল, সেটির পূর্ণ অবয়ব তারা দেখেছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে। স্বাধীনতাবিরোধীরা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যেভাবে নগ্ন হামলা চালাচ্ছে, একাবিংশ শতাব্দীতে এটি লজ্জাজনক। ভাষা আন্দোলনের ফসল শহীদ মিনার, স্বাধীনতার ফসল পতাকাকেও দ্বিখ-িত করা হয়েছে। দেশের মানুষকে শ্রেণীবিভক্ত করতে চাইছে। পক্ষ-বিপক্ষ দাঁড় করিয়ে অসমাপ্ত এজেন্ডার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে কিন্তু মুক্তচিন্তা-চেতনা, মুক্তবুদ্ধি, উদার ও ধর্মভীরুরা ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রুখে দাঁড়িয়েছে। চিহ্নিত ও প্রমাণিত যুদ্ধাপরাধীদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কোমর বেঁধে আন্দোলনে নেমেছে, গণজাগরণ সৃষ্টি করছে। ধর্মান্ধতা সঠিক আদর্শ নয়। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অহিংসমূলক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী। কোন সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শকে লালন করা হচ্ছে না। প্রতিটি মহাসমাবেশে দেশের মূলধারার ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এ অসাম্প্রদায়িকতাতে উজ্জীবিত হয়েছে।

আমরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে জেনেছি, তৎকালীন সময়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একত্রে একই হাঁড়ির ভাত খেয়েছে, ঘুমিয়েছে এবং দিনের পর দিন অতিবাহিত করেছে। হিন্দু-আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রিত হয়েছে মুসলিম পরিবারে, খ্রিস্টানরা গির্জার দুয়ার খুলে দিয়েছিল আপামর জনসাধারণের জন্য। খ্রিস্টান-হিন্দুরা আপন করে নিয়েছিল ইসলাম ধর্মাবলম্বী যোদ্ধাদের। এটি নতুন প্রজন্মের কাছে রূপকথার গল্পের মতোই মনে হয়। তাইতো স্বাধীনতার অমর নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংবিধানে সনি্নবেশিত করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিময় দেশের প্রস্তাবনায় লেখা হলো- '... আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা_ যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে...।'

দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে তরুণরা গণজাগরণ মঞ্চ এলাকাকে সেস্নাগানে সেস্নাগানে মুখরিত করে তুলেছে। সেস্নাগান উৎসাহ জুগিয়েছে, সেস্নাগান উদ্দীপনা জাগিয়েছে। কিন্তু 'তুমি কে, আমি কে? বাঙালি বাঙালি' এ সেস্নাগানটি আদিবাসী সৈনিকদের আহত করেছে, মনোকষ্টে ভুগেছে। দীর্ঘ ৪০ বছরে আমার দেশ এগিয়েছে শিক্ষায়, চিন্তায় ও মননে। তারপরও কেন একপেশে সেস্নাগান, এরূপ অভিযোগ অনেকে জানিয়েছে। জানিয়েছে নতুন প্রজন্মরা 'একটা একটা শিবির ধর...' ইত্যাদি সেস্নাগানকে গ্রহণ করতে পারেনি। অহিংস আন্দোলনে সহিংসতামূলক কোন কথাই থাকতে পারে না। যিশু জীবন দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন, 'তোমরা দুষ্টের প্রতিরোধ করিও না; বরং যে কেহ তোমার দক্ষিণ গালে চড় মারে, অন্য গাল তাহার দিকে ফিরাইয়া দেও'। আদিবাসী সৈনিকরা কি বাঙালি? আমরা আমাদের জাতীয় আন্দোলনগুলোকে কি বাঙালিকরণের চেষ্টা করতে চলেছি? মহান মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তীতে সরকারিভাবে রচিত ইতিহাসে আদিবাসীদের অবদানকে স্বল্পাকারে দেখানো হয়েছে। জাতি আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে ওয়াকিবহাল নন। বীর মুক্তিযোদ্ধা ইউকেচিং মারমা যে একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা, তা কয়জন জানেন? ইতিহাসবিদরা ঘোষণা করে থাকেন, ব্রিটিশবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহ, মু-া বিদ্রোহ, টংক, তেভাগা, হাজং বিদ্রোহ ইত্যাদির মধ্যেই স্বাধীনতা আন্দোলনের বীজ রোপিত ছিল। এ আন্দোলনের পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

আদিবাসী লড়াকু সৈনিকরা দেশকে ভালোবাসে, দেশের মানুষকে ভালোবাসে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে সর্বদাই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। পক্ষান্তরে তাদের জীবনে নেমে এসেছে নির্যাতন, অত্যাচার, দেশ ত্যাগের হুঁশিয়ারি। '৭১-এ অনেক আদিবাসী চিরদিনের জন্য দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে ভারতে। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছে, আদিবাসীরাও আক্রান্ত হবে নানা অজুহাতে। তবে সেই ভয়ে ভীত নয় আদিবাসী সৈনিকরা। দেশমাতৃকার ডাকে, মায়ের সম্ভ্রম রক্ষায় '৭১-এ শহীদ হয়েছে অনেকে। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধেও শহীদ হতে পিছুপা হবে না অমিত সাহসী আদিবাসী যোদ্ধারা। '৭১-এ স্বীকৃতি মেলেনি, হয় তো দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে স্বীকৃতি মিলতেও পারে! অজানা কবির পঙ্ক্তি_

'চল চল এগিয়ে যাই জাতি ধর্ম ভুলে যায়

ইতিহাসের দায় শোধে এক কাতারে মিলে যায়

দেখতে দেখতে বেলা হলো আর কতকাল থাকবে বল

বিবেকহীন এই রঙ্গশালায়।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন