শুক্রবার, ১০ মে, ২০১৩

শহীদ মিনার থেকে প্রজন্ম চত্বর

আবু হাসান শাহরিয়ার
শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরের তারুণ্যসৃষ্ট গণজাগরণে সাড়া দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী বিল’ এনেছে জাতীয় সংসদ এবং তা কণ্ঠভোটে পাসও হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সে-বিল অনুমোদন করায় দীর্ঘ ৪২ বছরের একটি অমীমাংসিত বিষয়— একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার— নতুন করে বেগবান হয়েছে। বাংলাদেশে কোনও গণদাবির দ্রুততম সংসদীয় প্রতিফলন বোধকরি এটাই।


দুই.
উপর্যুক্ত সংশোধনী বিলটি উত্থাপন এবং পাসকালে জাতীয় সংসদের তিনটি স্মরণযোগ্য চিত্র— ১. আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সংসদ সদস্যদের কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়েছে। ওই জোটের একজন বাম সদস্যের প্রস্তাবে যুদ্ধাপরাধের জন্য শুধু ব্যক্তির নয়, দল বা সংগঠনের বিচারের পথও প্রশস্ত হয়েছে। ২. বিল উত্থাপন এবং পাস হওয়ার সময় সংসদে বিএনপি বা জামায়াতের কোনও সংসদ সদস্য উপস্থিত ছিলেন না। ৩. মহাজোট সরকারের শরিকদল জাপার চেয়ারম্যান এরশাদও ঐতিহাসিক এ দিনটিতে সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন।

তিন.
বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে তো বটেই বাঙালির রাজনৈতিক ইতিহাসেও ওপরের ঘটনাটি একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে। এ অধ্যায়ের কেন্দ্রে আছেন কয়েকজন তরুণ ব্লগার, যারা চুনোপুঁটি যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির রায়ের পর ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার সামান্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায়ে ক্ষুব্ধ ও ব্যথিত হয়ে ৫ ফেব্রুয়ারি বিন্দুসম একটি প্রতিবাদ সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন শাহবাগস্থ জাতীয় জাদুঘরের সামনে। ব্লগে-ফেসবুকে সমমনাদের সেই সমাবেশে শামিল হওয়ার ডাক দিয়েছিলেন তারা। সেই ডাকেই শাহবাগ রূপান্তরিত হয় গণসমুদ্রে। সেই ডাকেই দেশজুড়ে মহাগণজাগরণ। সেই ডাকেই সংসদে ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী বিল পাস। জাতি যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল ডাকটি শোনার জন্য। শোনামাত্রই সাড়া দিয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত। যারা সাড়া দিয়েছেন, সংখ্যার হিসাবে তারাই বৃহত্তর। বৃহত্তর বললে কম বলা হয়— তারাই বৃহত্তম। একাত্তরের মিত্র তারা। ভাষাশহীদের রক্তে রচিত বায়ান্নোরও মিত্র তারা। তাহলে গণজাগরণের ডাকে যারা সাড়া দেননি অথবা তা নিয়ে উস্কানি বা বিদ্বেষমূলক কথা ছড়াচ্ছেন, তারা কী? সময় এসেছে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। প্রজন্ম চত্বরের একজন তরুণ ব্লগারকে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করার পর তাকে নিয়ে কুত্সা রটনা করছে একদল মানুষ ও গুটিকয় মিডিয়া। এ প্রকার অপপ্রচারে একজন বিচারপতিরও জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি। অতএব সময় এসেছে, বায়ান্নো-একাত্তরের শত্রুমিত্র বিভাজন রেখাটিকে স্পষ্টতর করারও।      

চার.
এক কথায় শাহবাগের গণজাগরণ হচ্ছে— বিন্দু থেকে বিশাল পরিধির এক বৃত্তরচনা। নারী-পুরুষ-বয়স নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের সংহতিপ্রকাশই এই বৃত্তের ব্যাস। জ্যামিতি মতে— ব্যাস যত দীর্ঘ, বৃত্ত তত বড় এবং পরিধিও তত বিশাল। সেই অর্থে এ গণজাগরণ বিশাল পরিধির এক মানববৃত্ত, যার হূিপণ্ড হচ্ছে জনমনে রচিত এক সুদীর্ঘ ব্যাস। সংসদে  ট্রাইব্যুনাল সংশোধনী বিল এনে ও পাস করে মহাজোট সরকার সেই ব্যাসকে আইনগতভাবে সম্প্রসারিত করেছে। এ কৃতিত্বের বড় দাবিদার  মহাজোটের নেতৃত্বে থাকা আওয়ামী লীগ ও তার বাম জোটবন্ধুরা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধেও দলগুলোর ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। আওয়ামী লীগ তো নেতৃত্বই দিয়েছে সে-জনযুদ্ধের। তবে, যা না বললেই নয়— ভোটের রাজনীতির স্বার্থে এ দলটিও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে-সরে এসেছে একাধিকবার। রাষ্ট্রকে সুন্নতে খত্না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চার মূলনীতিকে নতুন সংস্করণে আড়াল করতেও বাদ রাখেনি। তারপরও একাত্তরের চেতনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধারণের কৃতিত্ব আওয়ামী লীগেরই সবচেয়ে বেশি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কৃতিত্বটিও।     
    
পাঁচ.
তারুণ্যখচিত গণজাগরণকালে মহাজোটের আরেক শরিক দল জাপার ভূমিকা কিঞ্চিত সুবিধাবাদী। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে দলটির সর্বেসর্বা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের একমাত্র রাজনীতি হচ্ছে— দুই নৌকায় পা রেখে ভোটের হিসাব কষা। সংসদে ট্রাইব্যুনাল বিল পাসকালেও একই চিত্র দেখতে পেয়েছে জনগণ। ওইদিন জাপার গুটিকয় সদস্য সংসদে উপস্থিত থাকলেও এরশাদ ছিলেন বিদেশে। অর্থাত্ দুই নৌকায় পা রেখেই এরশাদ এই গণজাগরণকাল পাড়ি দিতে চাইছেন। উল্লেখ্য, একাত্তরে তিনি হানাদার বাহিনীর পোশাকে পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দখলিকৃত ক্ষমতাকালে এরশাদ যুদ্ধাপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসক জেনারেল জিয়াউল হকের অনুসরণে মুক্তিযুদ্ধের অসামপ্রদায়িক চেতনার মূলোত্পাটন করতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামও সংযোজন করেছেন সংবিধানে।

ছয়.
যেহেতু জামায়াতের শীর্ষ নেতারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত, গণজাগরণ-বৃত্তের ব্যাস-সম্প্রসারণে দলটির ভূমিকা রাখার প্রশ্ন ওঠে না। বিল পাসের দিন এ দলের সংসদ সদস্যদের কেউ সংসদে ছিলেনও না। তার আগে জাতি এ-ও দেখেছে, যুদ্ধাপরাধের  বিচার-বানচালে জামায়াত তার ছাত্রসংগঠন শিবিরকে নিয়ে দেশজুড়ে নৈরাজ্য-নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে। বিল পাসের দিন সংসদে দলটির অনুপস্থিতি এর ধারাবাহিকতা মাত্র। দলটি এখন বড় ধরনের জঙ্গি-নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও গোয়েন্দাসূত্রে প্রতিদিন খবর আসছে। অতএব বায়ান্নো বা একাত্তরের প্রশ্নে জামায়াতের নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে কোনও সংশয়ই নেই জনমনে।

সাত.
যত সংশয় বর্তমান জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ দলের নেতা-নেত্রীরা ধোঁয়াটে সব বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছেন। সেই সব বক্তব্যে তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দুটি মাত্র কথা বলছেন— ১. একাত্তরের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার তারাও চান, তবে এ যাবত্কালে দেশে সংঘটিত সব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার শর্তে। ২. আওয়ামী লীগেও যুদ্ধাপরাধী আছে, তাদেরও বিচার করতে হবে। অর্থাত্ শর্তসাপেক্ষে দলটি যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, যা না-চাওয়ারই শামিল। পার্শ্ববর্তী কিছু ঘটনাও এ সাক্ষ্যই দেয়। জামায়াতকে নিয়ে ভোটের জোটই শুধু রক্ষা করছে না বিএনপি, যুদ্ধাপরাধের বিচারবানচালে জামায়াত-শিবিরসৃষ্ট নৈরাজ্য-নাশকতাকে ‘নৈতিক সমর্থন’ও দিয়ে আসছে জোরগলায়। কেনই বা দেবে না? স্বাধীন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীর দল জামায়াতকে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা দিয়েছে বিএনপি। এই ‘পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ই পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, যার বিতর্কিত নায়ক দলটির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া। সামরিক পোশাকে ক্ষমতাদখল করেই তিনি দালাল আইন রদ করেছিলেন। পরবর্তীকালে তার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছে বিএনপি। এর সর্বশেষ উদাহরণ জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্য-নাশকতাকে ‘নৈতিক সমর্থন’ দেওয়া এবং শাহবাগসৃষ্ট গণজাগরণের পরও যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ত্যাগ না করা।

দালাল আইন রদ থেকে শুরু করে ‘নৈতিক সমর্থন’ কালখণ্ডে একটি উদাহরণও বিএনপি দিতে পারবে না, যা প্রমাণ করে, দলটি যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়। বরং উল্টো সাক্ষ্যই দেয় ইতিহাস। ক্ষমতাকালে ভয়াল যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া, যুদ্ধাপরাধের বিচারে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সৃষ্ট গণজোয়ারকে রুখে দিতে মাইক্রোফোন ছিনিয়ে নেওয়া, প্রতীকি গণআদালতের ২৪ উদ্যোক্তার নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়েরসহ ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যায়, যা সাক্ষ্য দেয়— কান টানলে যেমন মাথা, জামায়াত টানলে তেমন বিএনপি আসে। সঙ্গত কারণেই তারুণ্যসৃষ্ট সামপ্রতিক গণজাগরণের ব্যাস-সম্প্রসারণে কোনও ভূমিকাই রাখেনি বিএনপি। গণপরিধির মধ্যেই তো ঢুকতে পারেনি দলটি। ধরতেই তো পারেনি জনমন। উল্লেখ্য, একাত্তরে দলটির কোনও অস্তিত্বই ছিল না। ছিল না বলেই হয়তো ওই হিরণ্ময় সময়টিকে এ দলের অনেক নেতা-কর্মী ‘গণ্ডগোলের সময়’ বলে থাকেন।
প্রজন্ম চত্বরসৃষ্ট গণজাগরণ সম্পর্কেও একইরকম উল্টো-পাল্টা বক্তব্য দিয়ে চলেছেন বিএনপির নেতা-নেত্রীরা। নিহত ব্লগার রাজীবকে নিয়েও কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ছাড়াও আরও কী কী দাবি তুলতে পারতেন প্রজন্ম চত্বরের তরুণরা, কদিন আগে সেই মর্মে হাস্যকর একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়েছিল দলটির পক্ষ থেকে। এ বিবৃতির খুব সুন্দর একটি জবাব দিয়েছেন প্রজন্ম চত্বরের এক তরুণ— ‘আমরা যখন বাংলা পরীক্ষা দিই, তখন বাংলাই দিই; পরীক্ষার খাতায় অঙ্ক কষি না। এখন আমরা বাংলা পরীক্ষা দিচ্ছি। অঙ্ক পরীক্ষার দিন অঙ্ক কষব।’ 
পাদটীকা

আজ ভাষাশহীদদের স্মৃতিবিজড়িত ২১ ফেব্রুয়ারি। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনও ছিল তরুণদের অর্জন। সেই বিবেচনা থেকেই প্রজন্ম চত্বরের তরুণরা আজ মহাসমাবেশ ডেকেছেন। গতকাল বেলুন উড়িয়ে একাত্তরের শহীদদের উদ্দেশে প্রতীকি চিঠিও লিখেছেন তারা। চত্বরটি রচনা করার পর থেকে প্রতিদিনই ওই তরুণরা যে-শৈল্পিক প্রতিবাদ করছেন, তা কবিতাকেও হার মানায়। বায়ান্নোর আর আজকের তারুণ্য আজ প্রতিবাদের এক মোহনায় মিলবে। শহীদ মিনার থেকে প্রজন্ম চত্বর সেই মোহনা। ওই মোহনাই বাংলাদেশ। যারা মোহনাটিতে মিলতে পারবেন না, তারাই বায়ান্নো-একাত্তরের শত্রু। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির শত্রু।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন