বুধবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৩

সন্ত্রাস দমনে সন্ধির সময় শেষ হয়ে গেছে

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
যে ৬ এপ্রিলের ঢাকা সমাবেশ নিয়ে অনেকের মনেই ভয়ানক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছিল, প্রমাণিত হয়েছে তা গোঁদা পায়ের লাথি। দেশের এক ধরনের মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে ধর্মের নামে ও বিপুল অর্থ ছড়িয়ে ‘ক্রাউড’ সংগ্রহ করে কিছু মধ্যযুগীয় দাবি পেশ করলেই যে সফল আন্দোলন করা যায় না, মতিঝিল-সমাবেশ তার প্রমাণ। এই সমাবেশ ঘটানোর পেছনেও কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ঢালা হয়েছে, তার একটা দীর্ঘ বিবরণ ছেপেছে মঙ্গলবারের (৯ এপ্রিল) ‘আমাদের অর্থনীতি’ পত্রিকাটি। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে সংগৃহীত তথ্যভিত্তিক বিবরণটি।
অনেকের কাছে খবরটি নতুন কিছু নয়। আগে থেকেই জানাজানি হয়ে গিয়েছিল যে, এই সমাবেশ উপলক্ষ করে কিছু আলেম নামধারী ব্যক্তি অঢেল অর্থের অধিকারী হয়েছেন এবং ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে তাদের এই ‘সমাবেশ-বাণিজ্যে’ গরিব মাদ্রাসাছাত্র, শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম এবং মোয়াজ্জিনদের ব্যবহার করেছেন। এই মাদ্রাসাছাত্র ও শিক্ষকদের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে একদিন-দু’দিনের জন্য সমাবেশে জড়ো করা যায়, কিন্তু দীর্ঘকালের জন্য কোন আন্দোলনে ধরে রাখা যায় না।
কারণ এদের মধ্যে ধর্মীয় ফ্যানাটিসিজম ছাড়া কোন রাজনৈতিক আন্দোলনের মোটিভেশন সৃষ্টি করা হয়নি বা সৃষ্টি করা যায়নি। বাংলাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য মাদ্রাসা গজিয়ে উঠেছে, তার অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই যে শিক্ষাদান করা হয় তা আধুনিক সামাজিক অথবা রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের সহায়ক নয়। ফলে ধর্মের জন্য জান দেয়ার ডাক দিয়ে এদের কোন সমাবেশে জড়ো করা গেলেও তার দায়িত্ব একদিন-দু’দিনের বেশি হতে পারে না। কী জন্য তারা লড়াই করবে তার কোন স্পষ্ট ধারণা তাদের মধ্যে নেই। ফলে ধর্মান্ধতার অস্থির উন্মাদনা বুদ্বুদের মতো মিলিয়ে গেলেই এরা দ্রুত সমাবেশ ছাড়তে শুরু করে। ৬ এপ্রিল ঢাকার মতিঝিল সমাবেশেও তাই ঘটেছে।
নইলে বিএনপি-জামায়াতের ইচ্ছা ছিল শাহবাগ চত্বরের গণসমাবেশের মতো মতিঝিল সমাবেশকেও কিছুদিন টিকিয়ে রাখা এবং দেশের রাজধানীতে বড় রকমের অরাজকতা সৃষ্টি করে প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল করে দেয়া। প্রশাসন সম্পূর্ণ অচল হলে দেশের সামরিক অথবা অসামরিক কোন শক্তিকে নৈরাজ্য থেকে দেশ উদ্ধার করার জন্য অবশ্যই এগিয়ে আসতে হতো। তাতে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় যেতে না পারলেও আওয়ামী সরকারের হয়ত ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হতো না। তাতেই বিএনপি-জামায়াত খুশি হতো। তাদের আশা, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় না থাকলে আর কিছু না হোক, ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্থগিত অথবা বাতিল করা যাবে এবং বিভিন্ন দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের দায়ে অভিযুক্ত পলাতক তারেক রহমানকেও বীরেরবেশে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রথমে দলীয়প্রধান, পরে সরকারপ্রধান করা যাবে। বেগম জিয়া তখন দেশের নিয়মতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজমাতা হয়ে থাকবেন।
মতিঝিল-সমাবেশ নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের এই আশা পূর্ণ হয়নি। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সূক্ষ্ম চালটি কিছুটা সফল হয়েছে বলে মনে হয়। তিনি হেফাজতীদের সঙ্গে প্রথমেই কনফন্টেশনে যাননি। তাদের সমাবেশ অনুষ্ঠানে কিছুটা বাধা সৃষ্টি করলেও সমাবেশটি হতে দিয়েছেন। কিন্তু কোন কনসেশন দেননি। তাঁর কোন কোন মন্ত্রী যা-ই বলুন, বিবিসিকে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাতকারের বক্তব্য অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। যদিও তিনি বলেছেন, মতিঝিলের ১৩ দফা দাবির মধ্যে যুক্তিপূর্ণ কোন দাবি থাকলে তিনি তা বিবেচনা করতে পারেন। কিন্তু কোন নতুন আইন করতে যাবেন না। দেশের প্রচলিত আইন দ্বারাই সব কিছু সম্পর্কে ব্যবস্থা নেয়া হবে। অর্থাৎ অত্যন্ত পোলাইটলি তিনি মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। আওয়ামী লীগকে দেশের গোটা ধর্মীয় সমাজের সঙ্গে কনফ্রন্টেশনে নামানোর বিএনপি ও জামায়াতী চালটি এখানে ব্যর্থ হয়ে গেছে।
আমার ভয় ছিল, হেফাজতীদের সঙ্গে তাদের সমাবেশপূর্ব নেগোসিয়েশনে আওয়ামী লীগ সরকার এমন বড় ছাড় দেবে, যা দেশের গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। আওয়ামী লীগের ভেতর একটি সুবিধাবাদী অংশ আছে, যাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ছাড় দেওয়ার, আপোস করার একটা প্রবণতা আছে। অনেকেরই শঙ্কা ছিল, হেফাজতিদের ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের এই সুবিধাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অংশটিই জয়ী হবে। আকস্মিকভাবে শাহবাগের জাগরণ মঞ্চের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্ব সৃষ্টি, হেফাজতের দাবি মেনে শাহবাগের সাহসী তরুণ ব্লগারদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা ও রিমান্ডে পাঠানো আমার মতো অনেকের মনেই এই আশঙ্কা সৃষ্টি করেছিল।
মনে হয়েছিল, আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তিত নীতি হচ্ছে ‘বরের ঘরের পিসি এবং কনের ঘরের মাসি সাজা।’ সরকার শাহবাগ-আন্দোলন থেকে দূরে সরে যাবে এবং হেফাজতীদের এমন একটা মেসেজ দেবে যে, তাদের ঢাকা সমাবেশ শান্তিপূর্ণ হলে তাদের দাবিদাওয়া সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেÑ যে কথাটি সমাবেশ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উচ্চারণ করতে দ্বিধা করেননি।
বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা বলেছেন তা হেফাজতীদের সঙ্গে সরকারের সন্ধি সম্পর্কিত শঙ্কা থেকে আমাদের মুক্ত করেছে; কিন্তু সম্পূর্ণ মুক্ত করতে পারেনি। হেফাজত তাদের ঢাকা সমাবেশ মোটামুটি শান্তিপূর্ণ রাখলেও (শাহবাগ-মঞ্চে হামলা ছাড়া) পরবর্তীতে হরতাল ডেকে এবং সন্ত্রাসী রাজনীতিতে নেমে প্রমাণ করেছে, বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে হেফাজতীদের দূরে সরিয়ে নেয়ার নীতিতে সরকার সম্পূর্ণ সফল হয়নি। হেফাজতের নাম ভাঙ্গিয়েই বিএনপি-জামায়াত নতুনভাবে ভাংচুর, জ্বালাওপোড়াওয়ের সন্ত্রাসে নেমেছে এবং হরতালের পর হরতাল ডাকছে।
বিএনপি-জামায়াতের এই নীতি দেশের শান্তি-সমৃদ্ধি নষ্ট করছে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশের মানুষকে এই সন্ত্রাসী তৎপরতার কাছে জিম্মি করে ফেলেছে। দেশের মানুষের বিশেষ করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের নাগরিকদের এই জিম্মি অবস্থা অনির্দিষ্টকাল ধরে চলতে পারে না। সরকার এই সফটি সফটি নীতি চালিয়ে হয়ত এই সন্ত্রাস দমনে একদিন সফল হবে, কিন্তু ততদিনে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা গুরুতরভাবে ব্যাহত হবে।
বিএনপি-জামায়াত দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়ার এই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক তৎপরতা জেনেশুনেই করছে। হেফাজতে ইসলাম তাদের নতুন খোলস। তারা জানে, এই বিধ্বংসী তৎপরতা চালিয়ে তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে না। কিন্তু এই নাশকতা যদি দিনের পর দিন চলতে থাকে তাহলে দেশের মানুষ ভাববে এই সরকার তাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দানে, অর্থনৈতিক উন্নতি ধরে রাখতে অক্ষম। সুতরাং এই সরকারের পরিবর্তন দরকার। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা ভাববে এই সরকার তাদের বিনিয়োগকে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দিতে পারবে না। সুতরাং তারা দলে দলে দেশ ছাড়বে।
অন্যদিকে দেশের মানুষের সরকার সম্পর্কিত মনের বিরাগ ভাব টের পেলে দেশেরই কিছু অপেক্ষা করে থাকা গণবিরোধী চক্র ক্ষমতা দখলের জন্য প্রকাশ্যে তৎপর হতে পারে। যদি তাদের তৎপরতা সফল হয়, তাহলেই বিএনপি-জামায়াতের আশা সফল হবে বলে দল দু’টি হয়ত মনে করে। তারা নিজেরা ক্ষমতায় যেতে পারল না বটে কিন্তু দেশের কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে ধ্বংস করল, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাল। এখন ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার স্থগিত বা বাতিল করার উদ্দেশ্য পূরণেও তাদের আর দেরি হবে না। পরে ধীরেসুস্থে ক্ষমতায় যাওয়ার পরিকল্পনা আঁটা যাবে।
আওয়ামী লীগ কেবল প্রশাসনিক শক্তি দ্বারা এই ষড়যন্ত্র এবং ষড়যন্ত্রকারীদের ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাস দমন করতে পারবে না। নিজেদের সাংগঠনিক ক্ষমতা অতিদ্রুত পুনর্গঠন করে শাহবাগের জনতার মঞ্চকে পূর্ণ সাহায্য ও সহযোগিতা দান করে দুর্বার গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার। হেফাজতীদের মধ্যযুগীয় কা-কারখানার (নারী সাংবাদিককে প্রহারসহ) ফলে দেশের নারী সমাজ জেগেছে। এই নারী সমাজকে পূর্ণ সহযোগিতা দিয়ে রাজপথে আন্দোলন গড়ার সুযোগ দিলে মৌলবাদী সন্ত্রাসের মোকাবেলায় তা হবে এক বিশাল ও শক্তিশালী প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধটি এখনই গড়ে তোলা দরকার।
বর্তমান সন্ত্রাসের পেছনে আসল শক্তি জামায়াত। দেশের মানুষের এক বিশাল অংশ দাবি তুলেছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক। আমি অবশ্য কোন রাজনৈতিক দলকেই নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী নই। কিন্তু দেশদ্রোহী ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা চলে। এখানে একটি কথা, জামায়াতকে কেবল নিষিদ্ধ করলেই এই রাক্ষসকে বধ করা যাবে না। এর আছে বিশাল অর্থের উৎস। জামায়াত পরিচালিত ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, এনজিও ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান বাজেয়াফ্ত করতে হবে। জামায়াত যাতে একই আদর্শ-উদ্দেশ্য নিয়ে নতুন নামে দল গঠন করতে না পারে সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে।
এক কথায় ’৭১ সালে আওয়ামী লীগকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যুদ্ধে নামতে হয়েছিল, বর্তমানে সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধে নামতে হবে। তার কনফ্রন্টেশন এড়িয়ে চলার সময় শেষ হয়ে গেছে। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসের হাতে জিম্মি দেশবাসীকে মুক্ত করার জন্য তাকে এখন আপোসহীন কঠোর নীতি গ্রহণ করতে হবে। নইলে সর্বনাশ শুধু তার দলের হবে না, দেশেরও হবে।
লন্ডন, ৯ এপ্রিল, মঙ্গলবার, ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন