সৈয়দ জাকির আহমেদ রনি
একাত্তরে বাংলার তরুণ সমাজ হারেনি; এবারও হারবে না। একাত্তরের প্রেরণাতেই ২০১৩-তে আমরা জেগেছি নতুন প্রত্যয়ে। এ দেশের কোটি তরুণের হৃদয়ে এখন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। যুদ্ধাপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো আমারও আশা ছিল, ৩৪৪ জন খুন ও অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হবে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় শুনে। ফেসবুকের কোনো এক বন্ধু জানাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল করছে রায়ের বিরুদ্ধে। দেরি না করে রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
শাহবাগ মোড়ে পেঁৗছতেই শুনতে পেলাম রাজাকারের ফাঁসি চাই, কাদের মোল্লার
ফাঁসি চাই_ এ রকম অসংখ্য স্লোগান। সব ক্ষোভ নিয়ে আমিও যোগ দিলাম মিছিলে।
প্রতি মুহূর্তেই লোক বাড়ছিল মিছিলে। দু'একজন পরিচিতকেও পেয়ে গেলাম। পরিচিত,
অপরিচিত বিষয়টা ততক্ষণে অবশ্য গৌণ হয়ে গেছে। মূল বিষয়টা রায়ের বিরুদ্ধে
প্রতিবাদ। লক্ষ্য করলাম, দলে দলে মানুষ আসছে। নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ_ সবাই
ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, কিন্তু ক্ষোভ প্রকাশে সংযত। সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে
প্রতিবাদ জানানো হলো। সিদ্ধান্ত হলো মানবতাবিরোধী সব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর
ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আমরা অহিংস আন্দোলন চালিয়ে যাব
বল্গগার অ্যান্ড অনলাইন নেটওয়ার্কের ব্যানারে। প্রাইভেট স্যাটেলাইট
চ্যানেলের লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যেই ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে
পড়ল সারাদেশে। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ছাড়া সারাদেশের মানুষ সংহতি প্রকাশ করে
বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিজ নিজ জেলায় গঠন করল প্রতিবাদ মঞ্চ। একাত্তরে বাংলার তরুণ সমাজ হারেনি; এবারও হারবে না। একাত্তরের প্রেরণাতেই ২০১৩-তে আমরা জেগেছি নতুন প্রত্যয়ে। এ দেশের কোটি তরুণের হৃদয়ে এখন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। যুদ্ধাপরাধমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো আমারও আশা ছিল, ৩৪৪ জন খুন ও অসংখ্য মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় হবে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় শুনে। ফেসবুকের কোনো এক বন্ধু জানাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল করছে রায়ের বিরুদ্ধে। দেরি না করে রওনা দিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই হতবিহ্বলতা কাটিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদী সাধারণ মানুষের স্রোত বন্ধ করে দিল শাহবাগের চারদিকের রাস্তা। স্বতঃস্ফূর্ত সাধারণ মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে কেঁপে উঠল ঢাকা। একটাই দাবি চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান ও কার্যকর। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল মানুষের ক্ষোভ। তার বহিঃপ্রকাশ আর তাতে ঘি ঢালছিল লাকী, বর্ষা, শাওন, মাসুমের অগি্নঝরা স্লোগান 'জ্বালোরে জ্বালো আগুন জ্বালো', 'তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা', 'ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার, তুই রাজাকার', জাগরণী গান, কবিতা। আমরা গুটিকয়েক স্বেচ্ছাসেবী হলুদ কাপড়ের মাঝে লাল রঙের বাংলা হরফে লেখা 'বল্গগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক'-এর ব্যান্ড মাথায় বেঁধে তখন সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অহিংস উপায়ে, শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রেখে, সুসংগঠিতভাবে দাবি অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করছিলাম। বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম, নিয়ম না মানার দুর্নাম ঘুচিয়ে সবাই সারিবদ্ধভাবে বসে পড়ছে পিচঢালা রাস্তায়। বন্ধুর মতো পানি, খাবার ভাগ করে খাচ্ছে পাশের অপরিচিত মানুষের সঙ্গে। নিজেরাই নিশ্চিত করছে অহিংস, শান্তিপূর্ণ, ঐক্যবদ্ধ সহাবস্থান আর দৃপ্তকণ্ঠে গগনবিদারী আওয়াজে জানান দিচ্ছে 'আমার সোনার বাংলায় যুদ্ধাপরাধীর ঠাঁই নাই'। সাধারণ মানুষ উত্থাপন করল জামায়াতে ইসলামী নামে ধর্মের আড়ালে সন্ত্রাসী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী সংগঠন ও এর সহযোগী ছাত্র সংগঠন, ব্যবসায়িক, আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধের দাবি। সারারাত চলল প্রতিবাদ। মঞ্চের নাম রাখা হলো 'গণজাগরণ মঞ্চ'। স্থায়ী কোনো ভৌত অবকাঠামোর কথা আমলে না এনে সাধারণ মানুষের মঞ্চ সাধারণ মানুষের মাঝে রাখারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শুধু মহাসমাবেশের জন্য একটা অস্থায়ী মঞ্চের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আর তা প্রকাশের মাত্রা থেকে সমাবেশের আকার সম্পর্কে যে ধারণা আমরা করেছিলাম, ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টার মধ্যেই সে ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে লাখ লাখ মানুষ সমাবেশস্থলে সমবেত হতে শুরু করে। বিকেল ৩টায় সমাবেশ শুরুর সময় তিল ধারণের জায়গাও আর অবশিষ্ট ছিল না সমাবেশস্থলে। জাতীয় সঙ্গীত আর মুহুর্মুহু স্লোগানে এমন এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়, যা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। ছাত্রনেতাদের বক্তব্য শেষে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার সমবেত প্রতিবাদী মানুষের পক্ষে বিচারাধীন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি, মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার বাদী ও বিবাদীর উচ্চতর আদালতে আপিলের সমতা বিধান করে আইন সংশোধন, জামায়াতে ইসলামী নামে ধর্মের আড়ালে সন্ত্রাসী, বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী সংগঠন ও এর সহযোগী ছাত্র সংগঠন, ব্যবসায়িক, আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান নিষিদ্ধের দাবি সংবলিত ছয় দফা পেশ করেন। পরে গণজাগরণ মঞ্চের একটি প্রতিনিধি দল ছয় দফা দাবিনামা জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছেও পেশ করে।
আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় প্রাণ দিলেন ব্লগার রাজীব। মানুষের ঐক্যবদ্ধ দাবির মুখে জাতীয় সংসদে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার বাদী ও বিবাদীর উচ্চতর আদালতে আপিলের সমতা বিধান করে আইন সংশোধন করা হয়। এর মধ্যে ঘোষিত হয় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ। এ আদেশের বিরুদ্ধে জামায়াতের সন্ত্রাসীরা সারাদেশে জাতীয় পতাকায় আগুন, শহীদ মিনার ভাংচুর, খুন, উপাসনালয়ে অগি্নসংযোগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর হামলার পরও চলছে গণজাগরণ মঞ্চের অহিংস ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ এবং চলবে ওই স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির রায় বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত। একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারাও আমাদের আন্দোলনকে নাম দিয়েছেন দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ।
সৈয়দ জাকির আহমেদ রনি :গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন