শনিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৩

জামায়াত-শিবির ’৭১-এর ভূমিকায় সাথী বিএনপি!

মমতাজ লতিফ
একটা বিষয় ’৭১ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষকে বিস্মিত করছে যে কোন একটি দল বা গোষ্ঠী ইতিহাসের কোন এক সময়ে ভুল করল অথচ পরে ১০ বছর, ২০ বছর, ৩০ বছর, ৪০ বছর পরেও সে ভুল শোধরায়না- একি করে সম্ভব? বাংলাদেশের জন্মের বিরুদ্ধে ’৭১-এর এপ্রিল থেকে জামায়াতের নেতা গোলাম আযম স্বেচ্ছায়, আগ বাড়িয়ে টিক্কা খানের সঙ্গে সভা করে পাকিস্তান রক্ষার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে স্বদেশ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে এক নারকীয় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের ও ধর্মান্তরকরণের উন্মত্ত অমানবিক খেলায় মেতে ওঠে। এমন কি তারা, জামায়াতের ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধী নেতা, গোলাম আযম, নিজামী মুজাহিদ, সাঈদী, কাদের মোল্লা, কামারুজ্জামান প্রমুখরা অবিরাম দ্বিতীয়, তৃতীয় প্রজন্মের জঙ্গী, খুনীর জন্ম দান করে চলেছে! অবশ্য শুরু থেকেই তাদের এই অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আদর্শ, স্বাধীন বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র, গণতন্ত্র, নারী স্বাধীনতাসহ আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যক্রম ধ্বংসের সব রকম অপতৎপরতার সহযোগী হিসেবে জামায়াত লাভ করেছে জিয়ার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, খালেদার দ্বারা জামায়াতী লক্ষ্য পূরণে পরিচালিত ‘বিএনপি’ নামের দলটির পূর্ণ সমর্থন! জিয়ার ‘বিএনপি’ আশি শতকের মেধাবী তরুণদের সন্ত্রাসের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছিল এবং বাঙালী পরিণত করল অস্ত্র, অর্থ, মোটরসাইকেল আরোহী রাজনৈতিক ময়দানে নীতিহীন পেশি ও অস্ত্রের ভাষায় দখলদার এক ‘ক্যাডার’ নামধারী শ্রেণী!

যুদ্ধাপরাধীর মিত্র না হলে ’৭৩ সালে শুরু হওয়া যুদ্ধাপরাধী, প্রথমে ৩৭,০০০, পরে সাধারণ ক্ষমার পর ১১,০০০ খুন, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযোগ ধর্মান্তরকরণ, ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাস ও ভিন্ন রাজনীতির কারণে হত্যা ও বাস্তুত্যাগে বাধ্য করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধীদের গ্রেফতার হয়ে এবং পলাতক অবস্থায় বঙ্গবন্ধু সরকার যে বিচার সারাদেশে ৭৮টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে পরিচালনা করছিল বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যার পর জিয়া ’৭৬ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেই তাদের সবাইকে মুক্তি দেয়? তাদের বিচার হচ্ছিল যে ‘দালাল আইন’ দ্বারা সেটি বাতিল করে? পুরো বিচারকাজ বন্ধ করে দেয়?

বাংলাদেশে বিচারহীনতার জন্ম দেয় কে? আইনের শাসনকে জংলী শাসন দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছিল কে? প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করে, ৭৮টি ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে, ’৭২-এর দালাল আইন বাতিল করে, সব যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি ও পুনর্বাসন করে এবং বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীদের জন্য ইনডেমনিটি বা বিচারের উর্ধে রাখার ব্যবস্থা থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে পরাজিত করার বাস্তব প্রক্রিয়া! বস্তুত এখন যে লড়াইটি শুরু হয়েছে, এটিও যুদ্ধাপরাধী ও মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে আদর্শে বিশ্বাসী দেশপ্রেমিকের মধ্যকার লড়াই যেটি ’৭৩-এ শুরু হয়েছিল কিন্তু বাঙালীর দুর্ভাগ্য ’৭৬-এ সেটি অসম্পন্ন শুধু নয়, ’৭৬ থেকে পুরো দেশ-জাতিকে উল্টো পাকিস্তানী মওদুদীবাদী জঙ্গী শরিয়াহ রাষ্ট্র পাকিস্তানে রূপান্তর করার পথে এগিয়ে নিয়ে যায় জিয়া, এরশাদ ও খালেদা-তারেক-নিজামী গং।

’৭১-এ জামায়াত যেমন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি, লেখক, শিক্ষক, আইনজীবী, চিকিৎসক ছাত্র, সাংবাদিক প্রভৃতি বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক দল ও দলের নেতা-নেত্রী, বাঙালী সংস্কৃতির ধারক হিন্দু ধর্ম গোষ্ঠী এবং পুলিশসহ সব নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস, শান্তি কমিটির দ্বারা হত্যা করেছিল, ঠিক ২০০১-২০০৬-এর খালেদা-নিজামীর বিএনপি-জামায়াতের জোট আমলে জামায়াতের পরিকল্পনায় খালেদার ও তারেকের সহযোগিতায় আবারও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, হিন্দু সম্প্রদায়, শিক্ষক-কবি প্রগতিশীল ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধপন্থী উদীচী, ছায়ানটের অনুষ্ঠান, যাত্রাপালা, নাটক, সিনেমা হল ইত্যাদিতে বোমা হামলা এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী সর্বহারা খুন পুলিশের থানা আক্রমণ-ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করবার জন্য গঠন করে জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, হিযবুত তাহ্রীর, আহ্লে হাদিস ইত্যাদি নানা নামে পঞ্চাশের অধিক খুনী জঙ্গী গোষ্ঠী যারা খুনের জন্য বোমা, গ্রেনেড হামলা শুরু করে ’৯৮ সাল থেকেই। অর্থাৎ জিয়ার পর খালেদা-তারেক ও বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধী দলটিকে মুক্তিযুদ্ধপন্থীদের নিঃশেষ করে দেবার জিয়া কর্তৃক সূচিত প্রক্রিয়াটি অব্যাহতভাবে চালিয়ে গেছে এবং এখনও বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সেই মিত্রতাকে রক্ষা করেই চলছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেটি তরুণ প্রজন্মের আকাক্সিক্ষত ছিল সেটিকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেত্রী ওই পুরনো খুনীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে এবং তরুণ প্রজন্মের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে! জামায়াত-শিবির এই ২০১৩-তে মাদ্রাসা নয়, ধনী উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু নৈতিকতা সম্বন্ধে ধারণাহীন, দেশপ্রেম বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শবর্জিত একটি হঠাৎ ধনী হওয়া মানুষের সন্তানদের ওই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে তাদের মধ্যে আবারও আলবদররূপী খুনী এবং শয়তানী বুদ্ধির প্রতারক সত্য-ধ্বংসকারীর জন্ম দিয়েছে। ব্লগার রাজীব হত্যাকারীরা উচ্চশিক্ষিত, ধনীপুত্র, তারা স্বহস্তে রাজীবকে হত্যা করেছে একথা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। সবাই ভেবেছিল পেশাদার ভাড়াটে খুনীকে দিয়ে জামায়াত-শিবিরের নেতারা এ খুনটি পরিকল্পিতভাবে করিয়েছে যাতে অন্য দেশপ্রেমিক ব্লগাররা ভীত হয়ে পড়ে। এছাড়াও তারা ’৭১-এর মতোই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতা, হিন্দু তরুণ, বৃদ্ধ হত্যা করেছে, তাদের বাড়ি ঘরে আগুন দিয়েছে, সম্পদ-ব্যবসা লুটপাট করেছে। এরা সবাই মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধী, তাদের স্বদেশ ও স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ধ্বংসাত্মক অপতৎপরতার বিচার এ মুহূর্তে করতে হবে। একই সাথে ধ্বংসাত্মক, জঙ্গী সহিংসতা-খুন, লুট, অগ্নিসংযোগের জন্য, নির্দিষ্টি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনীতি করার জন্য এবং ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসের জন্য খুন, লুট, অগ্নিসংযোগ করার কারণে এই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের ব্যবস্থা গ্রহণও করতে হবে এর আর কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি তাদের অর্থের উৎসগুলো ক্রমেই আইনানুযায়ী সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

খালেদার দ্বারা জামায়াত-শিবির-ছাত্রদলের তা-বের ফলে নিহত হওয়াকে ‘গণহত্যা’ নামে অভিহিত করা, যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি দাবি, জামায়াতের ডাকা হরতাল ভেঙ্গে ভারতের প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জির সাথে নির্দিষ্ট বৈঠক বাতিল করা প্রমাণ করে বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের অধীনতা মেনে নিয়েছে। জামায়াত অবশ্যই তা-বের মাধ্যমে, নাশকতার মাধ্যমে দেশ ও জাতির যত ক্ষতি করছে সেসবই খালেদার কাম্য- খালেদার শাসনকালে সব সময় জাতি দেখেছে খালেদা গণতন্ত্র ধ্বংসে সব সময় কাজ করেছে, সুষ্ঠু-নির্বাচনের ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত করেছে এবং নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেছে। এদের দু’জনের কর্মকা-ের লক্ষ্য ছিল এবং এখনও আছে-তা হচ্ছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে পাকিস্তানী শরিয়াহ রাষ্ট্র গঠন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধ্বংস করা, শিক্ষা-ক্রীড়া-তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নকে স্তব্ধ করে দেওয়া এবং এ দেশের শান্তি বিঘিœত করা। স্মরণ রাখতে হবে, ২০০৯-এ কারা বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটিত করেছিল এবং কেন? বিদ্রোহ সফল হলে কে বা কারা ক্ষমতা দখল করত? এসব ঘটনার কারণ বোঝা তরুণ প্রজন্মের জন্য কঠিন নয়। তরুণরা, শত্রু, মিত্র চিহ্নিত করে, জনগণকে শত্রুদের নানা ভুল প্রচারণার জবাব দাও, গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধগুলো বার বার জানাও, মিথ্যার স্বরূপ উদঘাটন করে দাও, স্থানীয় ইমাম-ছাত্র-রাজনীতিকদের নিয়ে ‘প্রচার সেল’ তৈরি করে সভায় ইন্টারনেটে সত্য প্রচার কর। সত্যের ছয় অবশ্যম্ভাবী, ষড়যন্ত্র সবসময় পরাজিত হয়।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন