রবিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১৩

একই কৌশল ভুজপুরেও | গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা, এরপর সহিংস তান্ডব

রমেন দাশগুপ্ত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
 ফটিকছড়ি থেকে ফিরে: একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশের পর যেভাবে চট্টগ্রামের বাঁশখালী-সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় গুজব ছড়িয়ে সহিংস তান্ডব চালানো হয়েছিল, একই কৌশলে গত বৃহস্পতিবার নৃশংসতা ঘটেছে ফটিকছড়ির ভুজপুরেও।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতার সুযোগে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া কিংবা বাঁশখালীর একাংশের মত ফটিকছড়ির ভুজপুরসহ আশপাশের এলাকাকে নিজেদের ‍সুরক্ষিত দুর্গ বানিয়ে ফেলেছে জামায়াত-শিবির। রাজনৈতিকভাবে সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা জামায়াত মনোভাবাপন্ন এবং স্থানীয় সাংসদ মানবতা বিরোধী অপরাধে কারাবন্দি বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীরও ঘোর সমর্থক।
আর পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া রাজনৈতিক কর্মসূচী নিয়ে জামায়াত-শিবিরের সেই দুর্গে প্রবেশ করতে গিয়েই রক্তক্ষয়ী ও বর্বর হামলার শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ।
শনিবার দিনভর ভুজপুরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
গত ১১ এপ্রিল ভুজপুরে গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে হরতাল বিরোধী মিছিলে সহিংস হামলায় তিনজন নিহত এবং কমপক্ষে দেড়’শ জন আহত হন। মিছিলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বহনকারী কমপক্ষে দু’শ মোটর সাইকেল, তিনটি প্রাইভেট কার ও তিনটি জিপ, একটি মাইক্রোবাস, ৫টি পিকআপ ভ্যান এবং একটি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়।
শনিবার ঘটনাস্থল গিয়ে দেখা গেছে, ফটিকছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ভুজপুর ইউনিয়নের প্রবেশপথের পর ফকিরহাটের শুরু থেকে কাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকায় এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ধ্বংসের চিহ্ন। মূল সড়কের মাঝে, জমিতে, রাস্তার পাশে পড়ে আছে পোড়া মোটর সাইকেল সহ ‍অন্যান্য গাড়িগুলো। রাস্তাজুড়ে থাকা কালো পোড়া ছাই উড়ছে বাতাসে।
ফটিকছড়ির ভুজপুর যেন কোন যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। কাজিরহাট বাজার, ফকিরহাট বাজারে দোকানপাট বন্ধ, মানুষজনের আনাগোণা নেই। সবার মধ্যে যেন চাপা আতংক। ঘটনার বিভীষিকা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি সাধারণ মানুষ।
জামায়াতের ভয়ে মিছিলে যাননি আ’লীগ নেতারা
আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল ভুজপুরে প্রবেশ করলেও এতে ছিলেন না স্থানীয় কোন নেতাকর্মী। ভুজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অরুণ কান্তি শীল বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কেউ মিছিলে যায়নি। আমাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা আছে। আমাদের মধ্যে একটা ভয় কাজ করেছে। সেজন্য আমরা কেউ মিছিলে যেতে পারিনি।’
তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের একই কমিটি কাজ করছে। নতুন করে সম্মেলন নেই, কমিটি ঘষামাঝা নেই। সাংগঠনিক দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।’
ভুজপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুবুল আলম জানালেন, এটিএম পেয়ারুল ইসলাম মিছিল নিয়ে ভুজপুরে যাবার কথা তাকে জানাননি। তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না বলে ঘটনার সময় তিন কিলোমিটার দূরে বাড়িতে ছিলেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের না জানিয়ে ভুজপুরে মিছিল নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের পুরো কমিটি অনেকদিন ধরে নিস্ক্রিয়। সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অসুস্থ। তাই তাদের সেভাবে জানানো হয়নি।’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের বিবদমান দু’টি গ্রুপ আছে। একটি ধারার নেতৃত্বে এটিএম পেয়ারুল ইসলাম থাকলেও আরেকটি অংশের নেতৃত্বে আছেন প্রয়াত সাবেক সাংসদ রফিকুল আনোয়ারের পরিবারের সদস্যরা। গত নির্বাচনের পর থেকে শুরু হওয়া এ কোন্দলই মূলত ফটিকছেড়িতে জামায়াতকে শক্তিশালী করছে বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমরা খবর নিয়ে দেখেছি আওয়ামী লীগের মিছিলে ভুজপুরের স্থানীয় কোন নেতাকর্মী ছিলেন না। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সবাই বাইরের লোক হওয়ায় হামলার সময় তারা স্থানীয়দের কোন সহানুভূতিও পাননি।’
প্রশিক্ষিত বাহিনীর কায়দায় হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবির
আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল কাজিরহাট বাজারে পৌঁছানোর পর কিছুটা ‌উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ সুযোগে কাজিরহাট বাজার জামে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেয়‍া হয়, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মসজিদে হামলা চালাতে এসেছে, সবাই দা, কিরিচসহ যার যা কিছু আছে তা নিয়ে বাজারে আসুন।
কাজিরহাট বাজার এলাকার বাসিন্দা সত্তরোর্ধ আবুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমি তো ঘটনার শেষদিকে এসেছি। আমি শুনেছি, ‍ছাত্রলীগের ছেলেরা মিছিল থেকে মসজিদে ইট মেরে জানালা ভেঙ্গে ফেলেছে। আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব (জামায়াতের শফিউল আলম নূরী) এসে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।’
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে জানান, কাজিরহাট মসজিদ থেকে মসজিদে হামলার ঘোষণ‍ার পর ইউনিয়নের অধিকাংশ মসজিদ থেকে একযোগে হামলার পাশাপাশি বড় হুজুরকে (স্থানীয় মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম) তুলে নেয়া হচ্ছে বলে গুজব রটিয়ে দেয়া হয়।
তান্ডবের সময় বিজিবি সদস্যদের নিয়ে ঘটনাস্থলে থাকা ফটিকছড়ি উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) এটিএম আজহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ হাজার গ্রামের নারীপুরুষ, যুবক হামলায় অংশ নিয়েছে। সবার হাতে ছিল দা, কিরিচসহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র। কিছু যুবককে দেখেছি, যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মত ক্রলিং করে জমির উপর দিয়ে ঘটনাস্থলে এসে হামলা চালিয়েছে। কোন প্রশিক্ষিত লোক ছাড়া এভাবে ঘটনাস্থলে আসা সম্ভব না।’
উল্লেখ্য সাঈদীর রায় ঘোষণার পরও সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এবং বাঁশখালীতে বিভিন্ন ধর্মীয় গুজব ছড়ানো হয়েছিল। এরপরই সাধারণ মানুষ সেই গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে জড়িয়ে পড়ে তান্ডবে। একই ধরনের গুজব ছড়িয়ে তান্ডবের পর পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে, জামায়াত-শিবিরই পূর্বপরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে মিছিলে হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। কারণ, উত্তেজিত লোকজন শুধুমাত্র মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের উপরই হামলা করেছে। বাজারে কোন দোকান কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় মন্দির, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি কোথাও একটি ঢিলও পড়েনি।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘হামলার জন্য জামায়াত-শিবিরের পূর্ব প্রস্তুতি ছিল। তারা ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে ব্যবহার করে পরিস্থিতিকে পরিকল্পিতভাবে অস্থিতিশীল করেছে। মসজিদে ঘোষণা দেয়ার সঙ্গে আমরা দু’জনের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছি। তাদের বিষয়ে যাচাইবাছাই হচ্ছে।’
ফটিকছড়ি উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা অঞ্জনা খান মজলিশ বাংলানিউজকে বলেন, ‘পূর্ব পরিকল্পিত হামলার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছেনা। আসলে মসজিদ থেকে মাইকিংটাই এ ঘটনার নেপথ্যের মূল কারন।’
আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘জামায়াত-শিবির, সালাহউদ্দিন কাদেরের ক্যাডার বাহিনী এবং হেফাজতের ক্ষুদ্র একটি অংশ হামলা চালিয়েছে।’
জামায়াত নেতা ভুজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিউল আলম নূরী নিজে মাইকে ঘোষণা দিয়ে হামলায় উসকানি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। অবশ্য চেয়ারম্যান নূরীকে বৃহস্পতিবার রাতে পুলিশ আটক করেছে।
হামলা হতে পারে ভাবেননি পুলিশ কর্মকর্তারাও
জামায়াত-শিবিরের দুর্গ হিসেবে খ্যাত ফটিকছড়ির ভুজপুরে মিছিল করার কথা ভুজপুর থানার ওসিকে জানিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম। কিন্তু হরতালের বাড়তি ফোর্স ছাড়া মিছিলে নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত কোন পুলিশ মোতায়েন করেননি ওসি সামসুদ্দিন ভূঁইয়া। তবে মিছিলে নিরাপত্তার জন্য তিনি নিজে ফোর্স নিয়ে কাজিরহাট বাজারে উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) ফরিদ উদ্দিন বাংলানিউজকে জানান, মিছিল এবং হরতাল উপলক্ষে থানা থেকে ৩৬ জন এবং আরও ২০ জন অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। হাটহাজারী সার্কেলের এএসপি আফম নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বেও একটি ফোর্স মিছিলের সঙ্গে ছিল।
আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ভুজপুর থানার ওসি সামসুদ্দিন ভূঁইয়া এবং এস আই নূরুন্নবী এ হামলার ঘটনার জন দায়ি। তাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও তারা নিরাপত্তার জন্য দায়সারা পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অঞ্জনা খান মজলিশ বাংলানিউজকে বলেন, ‘পেয়ারু সাহেব মিছিলের বিষয়টি আমাকে জানানোর পর আমি ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছেন ভুজপুর থেকে হেঁয়াকো পর্যন্ত সড়ক একেবারে ক্লিয়ার আছে। একটি ব্রিজ একটু ভাঙ্গা ছিল, সেটিও ঠিক কর‍া হয়েছে। আসলে এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটবে, সেটি কারও মাথায় ছিলনা।’
উল্লেখ্য ওসি সামিসুদ্দিন ভূঁইয়াকে শনিবার বিকেলে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন