রমেন দাশগুপ্ত, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
চট্টগ্রাম: গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে
ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি এবং সহিংসতা ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর হচ্ছে প্রশাসন।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলার প্রশাসনিক
কর্মকর্তা এবং মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে জনসাধারণকে গুজবে বিভ্রান্ত না
হওয়ার বিষয়ে সচেতনা করা হবে।
এছাড়া ইমাম ছাড়া অন্য কারও মসজিদের মাইক ব্যবহারের বিষয়েও কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। এক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ যৌথভাবে চট্টগ্রামে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘আগে গ্রামে ডাকাত পড়লে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজন জড়ো করা হত। ঠিক একই কৌশলে এখন জামায়াত মসজিদগুলোকে ধর্মীয় বিভিন্ন গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যবহার করছে। এ বিষয়টিতে আমরা আর ছাড় না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সেক্ষেত্রে আমরা মোটিভেশন ও কন্ট্রোল পদ্ধতি গ্রহণ করব।’
পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের সূত্রে জানা গেছে, সোমবার জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এবং বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধি ও মসজিদের ইমামরা গুজব এবং ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর বিষয়ে করণীয় নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা এবং মসজিদের মাইক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে আসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
গত ২৮ ফেব্র“য়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ ঘোষণার পর চট্টগ্রামের জামায়াত অধ্যুষিত সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলায় এবং পার্শ্ববর্তী বাঁশখালী উপজেলায় সহিংস তান্ডব সৃষ্টি করে জামায়াত-শিবির। তান্ডবে নিহত হয় পুলিশ সদস্যসহ পাঁচজন। বহুসংখ্যক মানুষ আহতের ঘটনাও ঘটে। সহিংস তান্ডবে ধবংস¯তুপে পরিণত হয় সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও বাঁশখালী উপজেলার একাংশ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তান্ডব শুরুর আগে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে দেয়। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয় যা পরবর্তীতে উন্মাদনায় পরিণত হয়। বিভ্রান্তিতে পড়ে দলে দলে মানুষ অংশ নেয় সহিংস তান্ডবে যারা কোন ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
সম্প্রতি সরেজমিনে বাঁশখালীতে ঘুরে জানা গেছে, রায় ঘোষণার পর বাঁশখালীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াত-শিবির মোবাইল ফোনে, উঠান বৈঠক করে এবং বিভিন্ন কৌশলে বেশকিছু গুজব ছড়িয়ে দেয়। উপজেলার জলদি এলাকার দোকানদার সোলায়মান বাংলানিউজকে জানান, উপজেলার দক্ষিণে নাপোড়া, শেখেরখীল, বাংলাবাজার, টাইমবাজার, চাম্বল, গন্ডামারাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, সাঈদীর রায় ঘোষণার পর জনতা জেগে উঠেছে। শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতের বর্ডার পার হয়ে যাচ্ছেন। তাকে ধরতে হবে। এজন্য সবাইকে জলদি উপজেলা সদরে আসার আহ্বান জানানো হয়। অন্যদিকে উপজেলার উত্তরে পুকুরিয়া, কালীপুর, বৈলছড়ি, মিয়াবাজার, চেচুরিয়াসহ আরও কয়েকটি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, সাঈদীকে জলদি হাইস্কুল মাঠে ফাঁসি দেয়া হবে। এ ফাঁসি ঠেকানোর জন্য জনগণকে হাইস্কুল মাঠে আসার আহ্বান জানানো হয়।
এসব গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে বাঁশখালীর দু’টি কওমী-খারেজি মাদ্রাসা, একটি জামায়াত নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা এবং বিএনপির আধিপত্য আছে এমন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে উপজেলা সদরে তান্ডব শুরু করে। তান্ডবে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সের ছেলে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল বাংলানিউজকে বলেন, ‘মূলত ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ যারা করেছে তারা সবাই শিশু-কিশোর। সবার বয়স ১২ থেকে ১৪ বছর অথবা তার চেয়ে সামান্য কিছু বেশি হতে পারে। এদের মধ্যে এমন মোটিভ ছিল-যেন ভাংচুর করে, আগুন দিয়ে এরা উৎসব করছে। সবাই গুজবে উত্তেজিত হয়েই তান্ডবে অংশ নিয়েছে।’
এরপর সাঈদীর রায় ঘোষণার দিন গভীর রাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, আকাশে চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে। অনেক জায়গায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে জড়ো হয়ে সাঈদীকে চাঁদে দেখার আহবান জানানো হয়। সাঈদীকে চাঁদে দেখতে গিয়েও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে জামায়াত-শিবির।
গত মার্চে সরকারীভাবে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচীর দিন পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, ভারত থেকে আনা ক্যাপসুলগুলো খেয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাঁশখালী, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়ার বিভিন্ন এলাকায় গুজব ছড়ানো হয়, ক্যাপসুলগুলো খেয়ে মুসলমানদের বয়স কমে যাচ্ছে। পটিয়ায় মসজিদ থেকে এ ধরনের ঘোষণা দেয়ার পর উত্তেজিত লোকজন জড়ো হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলার চেষ্টা করে।
সর্বশেষ গত ১১ ফেব্র“য়ারি ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার কাজিরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল চলাকালে ভয়াবহ গুজব ছড়িয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়। এতে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন কর্মী নিহত হন এবং অর্ধশতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আহত হন। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা এবং গুজবে বিভ্রান্ত স্থানীয় জনতা মিলে এসময় শতাধিক মোটর সাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন পুড়িয়ে দেয়।
আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল কাজিরহাট বাজারে পৌঁছার পর স্থানীয় জামে মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মসজিদে হামলা চালাতে এসেছে, সবাই দা, কিরিচসহ যার যা কিছু আছে তা নিয়ে বাজারে আসুন।
সম্প্রতি ভুজপুরে সরেজমিনে পরিদর্শনকালে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে জানান, কাজিরহাট মসজিদ থেকে মসজিদে হামলার ঘোষণার পর ইউনিয়নের অধিকাংশ মসজিদ থেকে একযোগে হামলার পাশাপাশি মাদ্রাসার বড় হুজুরকে (স্থানীয় মাদ্রাসার সাবেক মুহতামিম) তুলে নেয়া হচ্ছে বলে গুজব রটিয়ে দেয়া হয়।
কাজিরহাট এলাকার স্থানীয় এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসার অধ্য ও পরিচালক জোনায়েদ বিন জামাল বাংলানিউজকে জানান, ভুজপুরের পার্শ্ববর্তী বড়বিল এলাকায় গুজব ছড়ানো হয়, বড় হুজুরকে ধরে নিয়ে গেছে। আর পশ্চিম ভুজপুরে গুজব ছড়ানো হয়, জোনায়েদকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এসব গুজব শুনে হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে কাজিরহাট এলাকায় জড়ো হন।
ফটিকছড়ি উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা অঞ্জনা খান মজলিশ বাংলানিউজকে বলেন, ’ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বড় হুজুরকে তুলে নিয়ে গেছে, মেয়েদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে, এ ধরনের অনেক গুজব সেদিন ছড়ানো হয়েছিল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন এলাকায় পবিত্র মসজিদকেও ব্যবহার করা হয়েছিল। মসজিদের মাইক থেকে ছড়ানো গুজব সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করেছে।’
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপর একেএম হাফিজ আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘উপজেলায় গিয়ে মসজিদের ইমামদের সঙ্গে আমরা বৈঠক করব। ইমাম ছাড়া কেউ যেন মসজিদের মাইকে হাত দিতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। আর ইমামকেও দায়িত্বশীল হতে হবে। ডাকাত পড়েছে শুনলেই মসজিদের মাইকে ঘোষণা না দিয়ে প্রথমে ওসি কিংবা ইউএনও’র সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হবে। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধিদের আমরা কাজে লাগাব।’
উল্লেখ্য সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় এবং বাঁশখালীতে তান্ডবের মামলার আসামীদের গ্রেপ্তার অভিযানে গিয়েও পুলিশকে একাধিকবার হামলার মুখে পড়তে হয়েছে। গভীর রাতে মসজিদ থেকে গ্রামে ডাকাত আক্রমণ করেছে বলে গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে ঘুম থেকে তুলে পুলিশের উপর হামলা চালানো হয়। সর্বশেষ গত শনিবারও সাতকানিয়ায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
পুলিশ সুপার একেএম হাফিজ আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘গুজবে বিভ্রান্ত হয়ে প্রকৃত ঘটনা না জেনেই অনেকে পুলিশের উপর হামলা করছে, ভাংচুর চালাচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষও মামলার আসামী হচ্ছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন। বিষয়টি আমরা সাধারণ মানুষকে বোঝাব যেন তারা গুজবে বিভ্রান্ত না হয়।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত নগর পুলিশ কমিশনার বনজ কুমার মজুমদার বাংলানিউজকে বলেন, ‘গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে নগরীর চেয়ে গ্রামগঞ্জে সুযোগ বেশি। এরপরও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সম্ভাবনা নেই এমন নয়। আমরা এ বিষয়ে সতর্ক আছি।’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন