মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

দিকনির্দেশনা চাই ॥ কালক্ষেপণের সময় নেই

ড. মারুফী খান
গত ৬ এপ্রিল যে ‘শোডাউন’ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম, সেটি নিয়ে নানামুণির নানা মত। সেটাই স্বাভাবিক। নিজের মতো করে একটা ধারণা করে নেবার অধিকার সবারই রয়েছে। টান টান উত্তেজনা; যাঁরা পারতপক্ষে টেলিভিশনের যে চ্যানেল দেখেন না তাঁরাও প্রায় সারাদিন ঐ চ্যানেল খুলে রাখলেন। জনতার সমাবেশ দেখার জন্য, কথা শোনার জন্য।
আমরা দেখলাম, শুনলাম এবং বুঝলাম। কিন্তু এটা বুঝলাম না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষক প্রথমসারির পত্রিকায় তাঁর আইনের চোখ দিয়ে সমাবেশ দেখে কেন লিখলেন ‘জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে যে লোকসমাগম হয়েছিল তারপর এত বৃহৎ সমাগম আর হয়নি।’ বুঝতে ব্যর্থ হলাম, জিয়া সাহেবের মৃত্যুর জনসমাগমের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের জনতার মাপামাপির কারণটি কি?
পূর্বে কখনও এ বিষয়টি যে আলোচনা হয়নি, তা কিন্তু নয়। একটি লেখাতেও লিখেছিলাম বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে নিহত (দু-কন্যা ব্যতীত) হবার সেই দিনটিতে রাজনৈতিক যে অবস্থা বিরাজ করছিল- সেনাদের দাপট, রেডিওতে মেজরদের আত্মদম্ভ ঘোষণা ইত্যাদি কোনক্রমেই লোকসমাগম হতে দেবার অনুকূলে ছিল না। সান্ধ্য আইন, বুটের খটখটানি এসব বিবেচনায় এনে ভাবতে হবে বঙ্গবন্ধুর জানাজা এবং জনতার একস্থানে সমাবেশের বিষয়টি। রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষ থাকতেই হবে- ’৭৫-এর ১৫ তারিখ কিংবা তার ১/২ দিনের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে ভালবাসার মানুষও ছিল। কিন্তু তারা তো এক হতে পারেনি, প্রকাশ্যে। কারণ এক হতে দেবার মতো পরিস্থিতি সেদিন রাখা হয়নি। কাজেই বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে লোকসমাগম হয়নি, অথচ জিয়ার জন্য এদেশে লোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল- এসব ভাবাটা মোটেও কাজের কিছু নয়। যেমন অদ্ভুত শোনায় জিয়ার হত্যাশোকে জনতার ভিড়ের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের জনতার উপস্থিতির উল্লেখ করা।
ঐ লংমার্চে সবাই কি হেফাজতের সদস্য? বিশ্বাস হয় না। কওমী মাদ্রাসা থেকে আগত ঐ অংশের সঙ্গে অন্য দলেরও লোকজন ছিল। এমনকি পরিচিত অনেকে যারা পুরান ঢাকার বাসিন্দা, হেফাজতের সঙ্গে তাদের সংযোগই নেই তারাও শাপলা চত্বরে ছিলেন। এখন একটি জনসমাবেশ দিয়েই যদি দেশের সরকার হটিয়ে দেয়া যাবে যারা ভাবছেন তাদের গণনায় সবটুকু শুদ্ধ হচ্ছে- এমনটা ভাবা ঠিক নয় বলে মনে হয়।
আরেকটি বিষয়ে খটকা লাগছে। হেফাজতে ইসলাম কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নয়। তাহলে ঐ লংমার্চে আসা মানুষজনকে এতটাই বা কেন আমলে আনা হচ্ছে? তারা ১৩ কেন এক শ’ ১৩টা দফা দিলেও কি সরকার এতটাই বাধ্য যে, ওদের দাবি নিয়ে হৈ-চৈ করে আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যা পর্যন্ত কাগজে ছাপতে হলো? সরকারের সহৃদয়তা এই মুহূর্তে আমার ধারণামতে বিপক্ষ শক্তিরা দুর্বলতা ভাবতে প্রয়াস পাচ্ছেন। বসতে দিলাম বলে শুতেও দিতে হবে এমন আব্দার তো রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
‘দেখি না কি হয়’ অথবা ‘আরে! ওরা আর কি করবে’ এমনটা এই মুহূর্তে সরকারের জন্য চিন্তায় আনাও ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এ দেশের জনগণ বড্ড ভাল। আর ভাল মানুষকে ভুল বোঝানো খুব কঠিন নয় অনেক ক্ষেত্রে। বিশেষ করে ধর্মীয় ব্যাপারে আমরা এবং জনগণ যে খুবই স্পর্শকাতর, এটিও ভুলে গেলে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
নারীনীতি, শিক্ষানীতি- এগুলো আমরা দীর্ঘদিন কর্ষণ করে করে রূপদান করেছি। একটি স্বীকৃত নীতি কিভাবে বদলে দেয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ দেয়ার স্পর্ধা হতে পারে? এই নীতিগুলো কি বিএনপি, জাতীয় পার্টি সমর্থন করেনি? তাহলে হঠাৎ করে একটি দল, যার কোন নিবন্ধন রাজনৈতিকভাবে নেই; তাদের দাবি উঠলেই আমাদের ভয় পাবার কি আছে? রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করছে, তাকে মোকাবেলা করুক আরেকটি রাজনৈতিক দল। অথচ সেটা না হয়ে লংমার্চ মঞ্চে গিয়ে উল্লিখিত দলগুলো সংহতি প্রকাশ করল এবং জনাব এরশাদ পানি পান করনোর মহৎকাজে অংশীদার হলেন এবং নারী সাংবাদিককে আহত করার জন্য করুণায় অশ্রুরুদ্ধ হলেন! এত স্ববিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্যই কিন্তু আমাদের দেশে রাজনীতি এত বেসামাল থাকে। আমার সমর্থন যে ন্যায়সমর্থিত হবে এ বিশ্বাস থেকে যদি এগোই, তাহলে মাঝপথে এত পথ বদলানোর প্রয়োজন কেন? কার জন্য?
বর্তমান সরকারের গত ৪ বছর খুব খারাপ কেটেছে, তা নয়। কিন্তু কয়েকটি কেলেঙ্কারি ঘটিয়ে যে দুর্নাম রটেছে তা কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। কিন্তু এই লংমার্চ, অবর্ণনীয় হরতাল ইত্যাদির কারণে সরকার যে সুস্থিরতার মধ্যে আছে বলা বোধকরি ঠিক হবে না। অথচ এ সরকারের অর্জন তো মোটেও কম নয়? মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে আন্তরিক চেষ্টা সে সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠা যথার্থ নয়! এই নারীকে যারা নাস্তিক বা কাফের বলেন তারা তার সম্পর্কে কতটুকু জেনে কথা বলেন? ঐ সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে যে স্লোগানের ভাষা উঠেছে সেটা কি মুসলমানদের সম্মানিত করেছে? একজন নারী হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যে পোশাক-পরিচ্ছদ পরেন এবং প্রাত্যহিক ইবাদত করেন তা অন্তত আমার অজানা নয়। অথচ ঐ কচি কচি কিশোর ছেলেদের নিয়ে বা দিয়ে যা বলানো হলো তা স্বয়ং আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবার নয় বলে আমার বিশ্বাস! রাষ্ট্রক্ষমতায় এলেই, এদেশে কেন, সব দেশেই লোকজন বিশেষ বিশেষ সুযোগ-সুবিধা পান। এখন ঐ সুযোগের ব্যবহার কিংবা অপব্যবহার করে যখন জাতির কল্যাণের জন্য যাঁরা নির্বাচিত হন তাঁরাই সম্পদের পাহাড় গড়েন তখন জনগণ বিভ্রান্ত হন, ক্ষব্ধ হন। আর এই মহাসুযোগটাই কাজে লাগায় বিরোধী পক্ষ। তখন দশটা ভাল কাজের মধ্যে দুটো মন্দ কাজই বড় হয়ে বেরিয়ে আসে। ফলে ‘দেশ শেষ হয়ে গেল’ ধরনের চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে কাজ করতে দিলেই হুল্লোড়। সরকারের সবচাইতে বোধ হয় বড় কষ্টের মন্ত্রীত্ব হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। দোষী খুঁজে বের করতে গেলে নানা চাপ, দোষীকে শাস্তি দিতে গেলে নানা উত্তাপ এবং যদি কোন অবস্থায় বাহিনী চুপচাপ, তো ফলাফল নিম্নচাপ।
এমতাবস্থায় দেশের রাজনীতি যাঁরা বোঝেন না তাঁরাও সোচ্চার, তারাও বুদ্ধি, অবুদ্ধি নিয়ে রাজনীতির ঢোলে বাড়ি দিচ্ছেন। শব্দ উঠছে, হোক বেসুরো, তাতে কি? অসুরদের তো স্বর্গরাজ্যে লোভ ছিল? (উদাহরণটি নিয়ে দয়া করে ধর্মের ধূম্রজাল সৃষ্টি করবেন না, অন্য ধর্ম জানায় জ্ঞান বাড়ে এবং প্রকৃত জ্ঞানই নিজ ধর্মে স্থিত থাকতে সহায় হয়)। অতএব এখনি খুবই বিচক্ষার সঙ্গে সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আবশ্যক নয়, অত্যাবশ্যক। ছোট বলে অবজ্ঞা যেমন ঠিক নয়, তেমনি সবাইকে জনে জনে উত্তর দিতে দিতে নিজের অস্তিত্বকে নস্যাত করার মধ্যেও কোন বাহাদুরী নেই।
এখন সবাই আতঙ্কগ্রস্ত- এই জানি কবে হরতাল, রাস্তার মোড়ে আপনি-আমি দাঁড়িয়েও যদি বলি ‘হরতাল হরতাল’; এটি ছড়িয়ে যেতে মাত্র কয়েক মুহূর্ত, হরতাল না হলেও সেটা হয়ে ছাড়বে। কারণ ঐ যে, আমরা আতঙ্কগ্রস্ত। মাননীয় সরকারপ্রধান, দেখছি, দেখব করে আর সময় অতিবাহিত করার সময় বোধহয় খুব বেশি নেই। আপনি একজন নির্ভীক মহিলা। আপনি খুব কঠোর ভাষায় কথা বলতে পারেন, আপনি প্রচ- কৌতুকপ্রিয় এবং স্নেহপূর্ণ এবং আপনি দেশপ্রেমিক। আপনার আশপাশে যাঁরা আছেন তাঁরা আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও তাঁরাই অনেকে আপনার জন্য বিপজ্জনক। আপনি সেটা জানেন, আমার অন্তত তাই ধারণা। সব বিষয়ে কালক্ষেপণ করা হয়ত ঠিক হবে না। শাহ্বাগ মঞ্চের কথায় আপনাকে কিছু করতে হবে না। কারণ ওদের মূল দাবির সঙ্গে আপনার নিজের জীবনের ব্যথা বড় নিবিড়ভাবে জড়িত। রাজ্যক্ষমতা চিরকালীন নয়। কিন্তু এমন একটা কিছু করে যান যাতে এদেশের মুষ্টিমেয় জনগণ নয়; বিশাল-বিরাট জনগোষ্ঠী যেন বলতে পারে–নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেই এক নারী দুষ্টের সাজা দিতে পেরেছিলেন। এর চাইতে আর বড় সম্মান কিসে পাওয়া যায়? আপনি স্বাধীনতা পক্ষের একজন মানুষ। আপনি সভা-সমাবেশগুলোয় যা বলছেন, সেটাকে কাজে পরিণত করুন! ‘ধীরগতিতে চলা’ নীতি এখন পরিহার করা দরকার। গণতন্ত্র মানে যার যা ইচ্ছা তাই করা- সেটা কিন্তু নয়। গণতন্ত্রে বাধা নেই তা তো নয়; সেই বাঁধনটা যথাযথ হলে জনগণ স্বস্তি পাবে। অন্যায়কারীদের শাস্তি সবাই চায়, কিন্তু সেটি করতে যতই সময় ক্ষেপণ ততই বিপক্ষ জায়গা দখলের অপচেষ্টায় লিপ্ত হবার সুযোগ পাবে। এক্ষেত্রে যেখানে যেমন দরকার তেমনভাবেই কঠোর নির্দেশনা দিন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, গোটা দেশ ও জাতির জন্য আপনাকে একটি সঠিক দিকনির্দেশনা দিতেই হবে। এ দেশে নাস্তিক কারা- আমার জানা নেই। তবে আল্লাহ্কে বিশ্বাস আপনার যেমন শক্তি, আমাদেরও তাই। আপনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞায়, সেটি কাজে লাগলে আমরা লাভবান হবো! সেই অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর কাটাচ্ছি আমরা।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন