মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতের ১৩ দফা ও বর্তমান প্রেক্ষিত

মাহমুদুল বাসার
মানবিক চেতনার আলো যখন নিভে যায়, শুভবুদ্ধির আলোকশিখা নিভে যখন ভয়ার্ত অন্ধকার নেমে আসে জনপদে, তখন তো আলো ভিক্ষা চাওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে গান গেয়েছিলেন, ‘মানবতাভিক্ষা চাই ওগো পুরবাসী।’ যুগে যুগে মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে, ২০০১ সালে মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে, ২০০১ সালে নির্বাচনের পর মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের কক্সবাজার, উখিয়া ও রামুতে মানবতার বিপর্যয় ঘটেছে। গত ০৬ এপিল শাপলা চত্বরের সমাবেশ থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতারা যে ১৩ দফা পেশ করেছে, যে উগ্রতা প্রদর্শন করেছে তাতে আমার মতো যে কোনো সুস্থ মানুষের চেতনার প্রদীপ নিভে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।


চিন্তার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা, চিন্তার দাসত্বই দাসত্ব। ইসলামের ইতিহাসে একটা সময় পর্যন্ত মুক্তচিন্তার বাতাবরণ ছিল, গণতন্ত্র, মানবতন্ত্র ছিল। হযরত মাবিয়া শাসন ক্ষমতা হাতে নেবার পর থেকে তার অবসান ঘটেছে। কারবালার প্রান্তরে যে অশুভ শক্তি মহানবী (সাঃ) এর দৌহিত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, পর্যায় ক্রমে তারাই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। ইসলামকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে স্ববিরোধী, গোঁজামিল সম্পন্ন করে তুলেছে। একথা অবিসংবাদিতভাবে সত্য যে, রাজনৈতিক স্বার্থে, ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ করার জন্য ধর্মান্ধ জঙ্গিদের ব্যবহার করা হলে তারা চিন্তার স্বাধীনতা রুদ্ধ করে দেবে, ভিন্নধর্মীকে, ভিন্নমতাবলম্বীকে উৎখাত করবে। তাদের মতের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে, তাদেরই তারা প্রকাশ্যে হত্যা করবে তারপর ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’ আখ্যা দেবে। সংবেদনশীল সংস্কৃতিবানদের মতামতের ওপর লৌহদ-ের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। মানবতাবাদী মনীষীদের চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করা হবে। ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর নির্মম, পাশবিক অত্যাচারের দৃশ্য মনে পড়লে বুকের স্পন্দন থেমে যেতে চায়। তার মতো বরেণ্য প-িতকে উপর্যুপরি কিরিচ দিয়ে কোপানোর দৃশ্য মনে পড়লে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সৌন্দর্য চেতনা ও মানবতার প্রতীক ভাস্কর্যগুলো বিচূর্ণ করার দৃশ্য মনে পড়লে চোখের দীপ্তি নিভে যেতে চায়। কী জঘন্য সাম্প্রদায়িক তা-ব দেখেছি ১৯৭১ সালে, তার জ্বলন্ত চিত্র উঠে এসেছে ‘গেরিলা’ চলচ্চিত্রে। হেফাজতের ১৩ দফা যদি বাস্তবায়ন হয় তাহলে ১৯৭১ এর চেতনা মুহূর্তে নিভে যাবে। একাত্তরের চেতনা নিভে যাওয়ার অর্থই হলো ধর্মান্ধতার তা-ব জেগে ওঠা। অন্ধত্ব নিষ্ঠুরতার প্রতিরূপ। ধর্মান্ধরা হুমকি দিয়েছিল জনপ্রিয় লেখক ড. জাফর ইকবাল ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কথাশিল্পী হাসান আজিজুল হককে কেটে টুকরো টুকরো করে পানিতে ভাসিয়ে দেবে। ১৯৭১ সালে একটি সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ ক্রোধ থেকে ১৪ ডিসেম্বর কয়েক হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছে। যখনই ১৯৭১-এর চেতনা নিভে যাবে তখনই একাত্তর সালের পাশবিক অত্যাচারের হিংস্র পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

গত ৪ এপ্রিল বর্তমান দুঃসময়ে দৈনিক জনকণ্ঠে ‘আমাদের শপথ’ নামে যে বিবেকের বাণী উচ্চরণ করেছেন ড. আনিসুজ্জামান তার প্রারম্ভে বলেছেন, ‘মুক্তযুদ্ধের নয় মাসে ধর্মের নাম নিয়ে এতো রকম বর্বরতা চালানো হয়েছিল যে, মানুষ যাকে ধর্ম বলে জানে ও মানে তার সঙ্গে ওসবের কাজের কোনো মিল খুঁজে পায়নি। বাঙালি নারী ধর্ষণেরও একটা ধর্মসম্মত অজুহাত খাড়া করা হয়েছিল : পরবর্তী প্রজন্মের ধমণীতে প্রবাহিত হবে খাঁটি মুসলমানের রক্ত।’ এই যে, ধর্মের নামে অধর্ম এখনো তা চলছে। গায়ের জোরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষকে, লাখ লাখ তরুণকে নাস্তিক অপবাদ দিয়ে ১৯৭১ এর গণহত্যাকারীদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে। তরুণ প্রজন্মের যোদ্ধা রাজিব হায়দারকে নির্মমভাবে হত্যা করে তার নামে বদনাম চাপানো হয়েছে। রাজিবকে হত্যা করার মূল কারণ হলো রাজিবরা সাম্প্রদায়িক দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সাম্প্রদায়িক দানবরা মিথ্যা কথা বলতে ন্যূনতম লজ্জাবোধ করে না। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতের চর’ বলেছে, হিন্দু নারীদের ‘গনিমতের মাল’ বলেছে, বেলুচিস্তানের কসাই টিক্কা খানের মতো নরখাদককে ইসলামের খাদেম বানিয়েছে। আর এখন তরুণ প্রজন্ম যোদ্ধাদের বলা হচ্ছে ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’, ‘নষ্ট ছেলে’।

ড. আনিসুজ্জামান ঐ কলামে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের কালেও যে সব দেশোদ্রোহী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়েছিল, তারা সকলকে বলেছিল, পাকিস্তান না থাকলে ইসলাম থাকবে নাÑ যেন পাকিস্তানের আগে পৃথিবীতে ইসলামের অস্তিত্ব ছিল না।’ এটা তো অনৈতিহাসিকই শুধু নয়, সরাসরি মিথ্যা কথা। যেমন ‘বাংলা ভাই বলে কেউ নেই’, ঘোষণাও ছিল জঘন্য মিথ্যা। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, টিক্কা খান, সবুর খান, নিয়াজী, জেনারেল জানজুয়াকে ইসলামে রক্ষাকর্তা বলে প্রচার করাও ছিল সেফ মিথ্যা। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহ সাহেব সম্পর্কে গবেষক ড. মোহাম্মদ হান্নান তার ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ বইয়ের ৪৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘জীবনের শেষ তিনটি বছর তিনি বেঁচে ছিলেন ইচ্ছাশক্তি, হুইস্কি এবং সিগারেটের ওপর ভর করে। শূকরের মাংস ও তিনি ভক্ষণ করতেন।’

সেই পাকিস্তানে শিয়ারা সুন্নিদের মসজিদে আর সুন্নিরা শিয়াদের মসজিদে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একে অপরকে হত্যা করছে। জামাতি নেতাদের দেখি কথায় কথায় ঘোষণা দিতে, ‘এটা মুসলমানদের দেশ’। এমন ঘোষণা দেয়ার অর্থ হলো, ভারতের উগ্র হিন্দুদের এ ঘোষণা দিতে প্ররোচনা দেয়া যে, ‘এটা হিন্দুদের দেশ’। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় এক প্রবন্ধে বলেছেন, ‘দ্বি-জাতি তত্ত্ব যদি সত্য হতো তাহলে স্বাধীন ভারতে একজনও মুসলমান থাকতো না। পশ্চিম পাকিস্তানে না হোক, পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ বাংলাদেশে এখনো দুই কোটি কি আড়াই কোটি হিন্দু থাকতো না।’ (আমার ভালবাসার দেশ-সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা-২০০১, পৃষ্ঠা-৯)।

জিন্নাহ সাহেব বিচক্ষণ রাজনীতিক বলে শেষ পর্যন্ত অনুধাবন করেছিলেন দ্বি-জাতি তত্ত্ব কোনো রাষ্ট্রের ভিত্তি হতে পারে না। মওলানা আবু আলা মওদুদীকে তিনি কোনোদিনও পাত্তা দেননি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান দিবসের আগে ১১ আগস্ট জিন্নাহ সাহেব প্রথম গণপরিষদে যে ভাষণ দেন, তা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। তিনি ইসলামের ইতিহাস টেনে কোনো কথা বলেননি। বলেছিলেন ইংল্যান্ডের ইতিহাস টেনে। বলেছেন, ‘এখন আমার মতে এ উদাহরণ আমাদের সম্মুখে রাখতে হবে। আমাদের আদর্শ হিসেবে এবং আপনারা দেখতে পাবেন যে, এমন এক সময় আসবে যেদিন হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না, ধর্মীয় অর্থে অবশ্য নয়, কারু তা হলে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিশ্বাস, তা হবে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে, রাজনৈতিক অর্থে।’ (কামরুদ্দীন আহমেদ-পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, পৃষ্ঠা-পরিশিষ্ট -৫)।

ইংরেজি শিক্ষিত জিন্নাহ সাহেবই বলেছিলেন, ধর্ম আর রাজনীতি এক হবে না। রাজনীতি এমন জিনিস : যার হুইস্কি না খেলে রাতে ঘুম হয় না, তাকে বানানো হয় মুসলমান আর যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তাকে বানানো হয় হিন্দু। যারা আজ তরুণ প্রজন্মের যোদ্ধাদের নাস্তিক বলছেন, তারাই শ্রদ্ধেয় কমরেড প্রয়াত মনিসিংহের নামে একটি সড়কের নামকরণ করেছেন। কোন দৃষ্টিতে একজন কম্যুনিস্টের এতো বড় সম্মান? হেফাজত ইসলামের ১৩ দফার সঙ্গে এ শ্রদ্ধাঞ্জলির কী সম্পর্ক তা জানতে চাই।

মূলত জিন্নাহ চেয়েছিলেন ভারতের একটি ক্ষুদ্র অংশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে, ভুট্টো চেয়েছিলেন পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের প্রধানমন্ত্রী হতে আর বেগম জিয়া চাচ্ছেন জামাত-শিবির-হেফাজতকে ব্যবহার করে, দেশে প্রলয় কা- ঘটিয়ে ক্ষমতায় যেতে। ধর্মের রাজনীতি আর রাজনীতির ধর্ম কোনোদিনও এক রকম হবে না। মহাকবি ইকবাল বলেছেন, ‘এক আল্লাহ ও এক কুরআন/ তবু এক নও তোমরা মুসলমান।’

মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন