বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতে ইসলাম নাকি হেফাজতে যুদ্ধাপরাধী

মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান
ইসলাম আরবী শব্দ। এর অর্থ শান্তি। এজন্য ইসলামকে বলা হয় শান্তির ধর্ম। হেফাজতে ইসলাম অর্থ শান্তির ধর্মের রক্ষাকারী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআন ও মহানবীর কথা ও কর্ম তথা হাদিসভিত্তিক জীবন ব্যবস্থাই ইসলাম। আর ইসলামের অনুসারীরাই হলো মুসলমান। তাই মুসলমান হওয়ার পূর্বশর্ত হলো আল কোরআনের অনুসারী হওয়া। মুসলমানেরা বিশ্বাস করে আল কোরআন আল্লাহ প্রদত্ত গ্রন্থ। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্যান্য কয়েকটি ধর্মালম্বীদের পবিত্র গ্রন্থের ন্যায় কোরআনও একটি আসমানী কিতাব। এই বিশ্বাস মুসলমান হওয়ার অন্যতম শর্ত। আরও গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো-আল্লাহ্র একত্ববাদে বিশ্বাস। অর্থাৎ আল্লাহ্ সার্বভৌম; তাঁর নিজের কোন অংশীদার নেই। তিনি নিজে জন্ম নেন না বা কাউকে জন্ম দেন না। সমগ্র পৃথিবী তার ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। এই চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র বা অমাবস্যা-পূর্ণিমা, জোয়ার-ভাটা, চন্দ্র গ্রহণ-সূর্য গ্রহণ সবই তাঁর ইচ্ছায় পরিচালিত, সংঘটিত বা সম্পাদিত হয়। তাঁর ক্ষমতাকে তিনি অন্য কারও হাতে ন্যস্ত করেননি। সেজন্য লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ মুখে বলা ও অন্তরে ধারণ করার মাধ্যমে মুসলমান হতে হয়। মুসলমান হবার জন্য কারও কাছে দরখাস্ত করতে হয় না।
পবিত্র কোরআন সম্পর্কে আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন যে একে রক্ষার মালিক তিনিই। অর্থাৎ পৃথিবীর কোন মানুষ বা সংগঠনের হাতে কোরআন রক্ষার দায়িত্ব অর্পিত হয়নি। আর কোরআন রক্ষা মানেই ইসলাম রক্ষা। অতএব ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব কারও ওপর নেই। যারা নিজেদের হেফাজতে ইসলাম বা ইসলামের রক্ষাকারী বলছেন তারা প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্র ক্ষমতার সঙ্গে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করছেন অর্থাৎ নিজেদেরকে অংশীদার করছেন। এই অংশীদারিত্ব কবিরাহ্ গুনাহ্। অতএব যারা আল্লাহর অংশীদার সৃষ্টি করে তারা কখনই মুসলমান হতে পারে না। হেফাজতে ইসলামের ন্যায় জামায়াতে ইসলাম সম্পর্কেও এ কথা বলা যায়। জামায়াত অর্থ দল বা গোষ্ঠী। জামায়াতে ইসলাম অর্থ ইসলামের দল। ইসলামের দল যদি বুঝানো হয়, তাহলে পৃথিবীর সমগ্র মুসলমানকেই বুঝায়।
ইসলাম স্বজাত্যবোধ বা দেশপ্রেমকে গুরুত্ব দেয়। ১৯৭১-এ এই জামায়াতে ইসলামী স্বজাত্যবোধের পরিচয় দেয়নি। তারা বাংলা ভাষার আন্দোলনের মাধ্যমে গড়ে ওঠা আমাদের জাতীয়তাবোধের বিপরীতে অংশ নিয়ে এবং আগ্রাসী ও আক্রমণকারী জালেমের পক্ষ নিয়ে প্রকৃতপক্ষে ইসলামেরই অবমাননা করেছে। শুধু পক্ষই নেয়নি; তারা নিজেরাও আক্রমণকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং বাঙালীদের জীবন-সম্পত্তি ও সম্ভ্রমের ওপর হামলা করেছে। ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে এটিও কবিরা গুনাহ্ । আবার আল্লাহ্র দল নামে অন্য একটি ভূঁইফোড় সংগঠন তৈরি হয়েছিল; যারা এই হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যূথবদ্ধ। জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তারা যখনই চাপের মধ্যে পড়ে, তখনই ভিন্ন ভিন্ন নামে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে তারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। বাংলাদেশের মানুষের ধর্মের প্রতি যে গভীর অনুরাগ তাকে পুঁজি করেই তারা তাদের রাজনীতি করে।
গত এক বছরে তারা বহুবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঝটিকা আক্রমণ চালিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ দেশের সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধন করেছে। সাঈদীর মামলার রায় ঘোষণার পর তারা বিদ্যুতকেন্দ্র ধ্বংস ও রেলওয়েকে ধ্বংসের নেশায় মেতে উঠেছে। তারা মুসলমানসহ অমুসলমানদের উপাসনালয় ও বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশকে পিটিয়ে মেরেছে। তারা নারী ও শিশুদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন ও মিথ্যা গল্প তৈরি করে তাদেরকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মিছিলের অগ্রভাগে। এর কোনটাই ইসলাম সম্মত কাজ নয়। বরং পৃথিবীতে ইসলাম এসেছিল এ ধরনের অরাজকতার বিরুদ্ধে; অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সর্বোপরি অসুন্দরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। সেই লড়াইয়ে মহানবী (সা) তাঁর গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। কিন্তু এই তথাকথিত ইসলাম রক্ষকরা মহানবী (সা)-এর বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন, কারণ ইসলাম মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে ফায়দা লোটার সমর্থন দেয় না। কানসাট বিদ্যুতকেন্দ্র ধ্বংস ও রেলওয়ে বা সড়ক পরিবহনে ধস নামিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা হয়েছে। এটি পুরোপুরি অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড। অন্যায়কারীকে সমর্থন করাও ইসলাম বিরোধী। যুদ্বাপরাধীরা যেহেতু মানবতার শত্রু অতএব তারা ইসলামেরও শত্রু। অতএব তাদেরকে সমর্থন দেয়া কোনভাবেই ইসলাম সম্মত হতে পারে না। যারা এদেরকে সমর্থন করছে তারা নিজেদেরকে মুসলমান বললেও তারা পোশাক-পরিচ্ছদে বা চেহারায় মুসলমান বেশধারী কিন্তু প্রকৃত মুমিন মুসলমান নয়। কারণ কোন মুমিন কোন হত্যাকারী, লুণ্ঠনকারী বা ধর্ষককে সমর্থন করতে পারে না। হেফাজতে ইসলাম জামায়াত-শিবিরের সাম্প্রতিক এই সব কর্মকাণ্ডেরও কোন বিরোধিতা না করে বরং প্রকারান্তরে তাদেরকে সমর্থন করেছে।
যতদূর মনে পড়ে ২০০৯ সালের দিকে হেফাজতে ইসলামের কর্মকাণ্ড শুরু। তবে এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অন্য নামে আলেম নামধারী কিছু জঙ্গী শাহ্জালাল এয়ারপোর্টের সামনে লালন ভাস্কর্য তৈরীতে বাধা দেয় এবং সেখানে সমাবেশ করে। সারাদেশে এ বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়। এরপর হেফাজতে ইসলাম সামনে আসে। সম্প্রতি তারা ১৩ দফা দাবিনামা উত্থাপন করেছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গণজাগরণ মঞ্চের নাস্তিকদের শাস্তি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা ও একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের লেখাপড়া ও একই প্রতিষ্ঠানে নারী-পুরুষের কাজ নিষিদ্ধ করা। গণজাগরণ মঞ্চকে সাঈদীও নাস্তিক বলেছেন; বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভাষাও প্রায় একই রকম। অতঃপর হেফাজত। কিন্তু এই বৃহৎ গোষ্ঠীর কে কে নাস্তিক তা তারা বলেননি। অন্যদিকে এই মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার বারংবার বলেছেন যে তারা আল্লাহ ও রাসুল (সা) এ বিশ্বাসী। যে কোন ধর্মের; বিশেষ করে ইসলামের ভিত্তিই হলো বিশ্বাস। কোন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে যেহেতু কারও মুসলমান হতে হয়না এবং মুসলমান হওয়ার প্রধান শর্ত আল্লাহ্ এক তা মুখে বলা ও অন্তরে বিশ্বাস করা। ইমরান সরকার বারংবার তা মুখে বলেছেন; কিন্তু অন্তরে বিশ্বাস করেন কিনা তা একমাত্র আল্লাহ্ই জানেন। কারণ আল্লাহ্ ছাড়া কেউ অন্তর্যামী নন। ইমরান এইচ সরকাররা শাহ্বাগে বক্তৃতা ও সেøাগানে যা বলছে তা ইসলাম পরিপন্থী নয়। কারণ তারা অন্যায়কারীর শাস্তি চায়। যারা এই শাস্তি চায় না তারাই বরং ইসলামের বিরুদ্ধে রয়েছে। কোন মানুষ যখন বলে আমি মুসলমান, আমি আল্লাহ্তে বিশ্বাসী তখন তাকে নাস্তিক বলা কোরআনসম্মত কি-না তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।
মূর্তি হলো পূজা বা আরাধনার বস্তু। কিন্তু ভাস্কর্য তা নয়। অপরাজেয় বাংলা, সাবাস বাংলাদেশ বা অদম্য বাংলায় কেউ পূজা করে না, কেউ মাথা নোয়ায় না বা কেউ একে আল্লাহ্র প্রতিমূর্তিও মনে করে না। দেশে ভাস্কর্য তৈরি হওয়ায় ইসলামের কোন ক্ষতি হয়নি বরং ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ইমান পোক্ত হয়েছে। কারণ এই ভাস্কর্য দেখলে মুমিনদের মনে হয় যে, এদেশের কিছু ইসলামের লেবাসধারী ব্যক্তি নারীদের ইজ্জত বিনষ্ট করেছিল, মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছিল, সংখ্যালঘুদেরকে জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করেছিল। ইরানের রাস্তায় শেখ সাদীর ভাস্কর্য যেমন শোভা পায়, ইরাকের বহু জায়গায় যেমন এক সময় সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্য ছিল, তুরস্কেও কামাল পাশার প্রতিকৃতি ছিল এবং এখনও আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ছবি যে অর্থে ইরানীরা ধারণ করে সেই অর্থেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে চিরভাস্বর রাখার জন্য এই ভাস্কর্যগুলো তৈরি হয়েছে। মার্কিন আগ্রাসীরা সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কারণ সাদ্দামের ভাস্কর্যও তাদের বিপক্ষে এক বড় শক্তি ছিল। ঠিক তেমনি স্বাধীনতা বিরোধীদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য পরাজয়ের গ্লানি। হেফাজত ভাস্কর্য ভেঙ্গে তাদের পরাজয়ের গ্লানিকে ঢেকে রাখতে চায়।
নারী-পুরুষের পাশাপাশি অবস্থানের বিরুদ্ধেও হেফাজত তৎপর। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী হয়ত বা শুধু দাসী বা ভোগ্য পণ্য। মহানবী যে তাঁর জীবদ্দশায় নারীর প্রতি উদার হয়ে উঠেছিলেন তা তারা আমলে নেন না। তারা মহানবীর নবুয়ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার কাজের ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ না করে কিছু কিছু উদ্ধৃতিকে ব্যবহার করেন। ফলে ইসলামের প্রগতিশীল বিষয়গুলো আড়ালে চলে যায়। নারীর শূন্য অবস্থান থেকে তিনি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত যে জায়গায় নিয়ে আসেন, তাতে অনুমান করা যায় যে, তিনি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে এ বিষয়ে নতুন নতুন বক্তব্য বিশ্ববাসী পেত। মহানবীর বিদায় হজের ভাষণের মর্মার্থ হলো তিনি কোন কিছু শেষ বা বন্ধ করে রেখে যাননি। অনেক বিষয়ে চিন্তা-ভাবনার ও বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সুযোগ রেখে গেছেন। সমাজে নারীর অবস্থানকে ঐ জায়গা থেকে দেখতে হবে। তা না হলে সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ পিছিয়ে যাবে। যেমন করে তালেবানরা পিছিয়ে দিয়েছে আফগানিস্তানকে বা পাকিস্তানকে। বাংলাদেশ সুফী-দরবেশের দেশ, বাউল-ফকিরদের দেশ, সাধু-সন্ন্যাসীদের দেশ। এখানে তালেবানী রাষ্ট্র কায়েম হবে না। কারণ আবহমান বাঙালী কোন সন্ত্রাসে বা নৈরাজ্যে বিশ্বাস করে না। এ দেশে আসা সুফিরা এখানে অহিংস ও শান্তির বাণী প্রচার করেছিলেন। ব্রিটিশের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ফকির সন্ন্যাসীরা বিদ্রোহ করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাঙালীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু কিছুসংখ্যক কুলাঙ্গার তা না করে উল্টো শত্রুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে; অনেক ক্ষেত্রে পাল্লা দিয়ে অপরাধ করেছে। এই সব অপরাধীরা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর একই প্রক্রিয়ায় ইসলামের পোশাক ধারণ করে নিজেদের অপরাধকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে। তাদের এই ভাঁওতাবাজি এ দেশের মানুষ অনুধাবন করবে। অবশ্যই তাদের সামনে এই প্রশ্ন উত্থাপিত হবে যে, ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করা ইসলামে সিদ্ধ কি সিদ্ধ নয়। ইতোমধ্যে যুব সমাজের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে ধর্ষণ ও লুণ্ঠন কতটুকু সিদ্ধ। ইসলামকে হেফাজতের নামে যারা যুদ্ধাপরাধীদেরকে বাঁচাতে চায় অর্থাৎ খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি-লুণ্ঠনকে সমর্থন করে এবং বাংলাদেশকে আইয়ামে জাহেলিয়া বা অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিতে চায় তাদেরকে এই নতুন প্রজন্ম খুব সহজেই মূল্যায়ন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক : ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ও উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন