বৃহস্পতিবার, ১১ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতের বার্তা

আসিফ নজরুল
হেফাজতে ইসলামের উত্থান ও ঢাকা সমাবেশ ছিল বিস্ময়কর। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ (পরে এটিকে সংশোধন করে শুধু জামায়াত নিষিদ্ধকরণের কথা বলা হয়), সারা দেশে ইসলামি সংগঠনগুলোর ওপর কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ ও ছাত্রলীগের বর্বরতা এবং বিশেষ করে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের ব্লগে ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে কুৎসা রটনার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু এটি কতটা ব্যাপক ও তীব্র হতে পারে, তা হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশের আগে ধারণা করা যায়নি। ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশে কারও কারও মতে ৫ থেকে ১০ লাখ লোকের উপস্থিতি ছিল, ঢাকা আগমনের পথে নানাভাবে বাধা দেওয়া না হলে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারত। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জানাজার পর এটিই ঢাকাতে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ সমাবেশ।

হেফাজতের সমাবেশ এ দেশের কণ্ঠহীন মানুষের একটি বড় অংশকে আমাদের সামনে হাজির করেছে। বাক্স্বাধীনতা দূরের কথা, এদের অস্তিত্ব স্বীকার করতেও আমরা শহরের সুবিধাবাদী মধ্যবিত্তরা দ্বিধান্বিত থাকি। আমাদের পছন্দনীয় কথা কয়েক হাজার মানুষ উচ্চারণ করলে আমরা তাকে ১৬ কোটি মানুষের দাবি বা জনগণের দাবি বলে উপস্থাপন করি। কিন্তু হেফাজতের কয়েক লাখ এমনকি অনুরূপ চিন্তা-চেতনার কোটি লোকও যে এ দেশে থাকতে পারে, তারাও যে কোনো না কোনোভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে, তা আমরা মানতে রাজি না। হেফাজতের সমাবেশ এই সুবিধাবাদী ও অগণতান্ত্রিক মূল্যবোধে আঘাত হেনেছে। যে শৃঙ্খলা, ঐক্য ও প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারা সমাবেশে এসেছে, কথা বলেছে এবং একইভাবে রাজধানী ত্যাগ করেছে, তা অবজ্ঞা করার মতো নয়।
মহাসমাবেশের দিন হেফাজতের কিছু কর্মী আগমন ও প্রস্থানের সময় যে কয়েকটি আক্রমণের ঘটনা ঘটিয়েছে, বিশেষ করে তারা যেভাবে নারী সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হয়েছে, তা চরম নিন্দনীয়। এসব ঘটনার শাস্তিবিধান সরকারকে করতে হবে, এসব ঘটনার সমালোচনা সবাইকে করতে হবে। কিন্তু এ জন্য আমরা যদি তাদের মূল সমাবেশের শক্তিকে লক্ষ না করি এবং এই সমাবেশের বার্তাকে পড়তে না চাই, তাহলে তা অনেক বড় ভুল হবে।

দুই
হেফাজতের বার্তার সবচেয়ে বড় দলিল তাদের ১৩ দফা দাবি। এই দফাগুলোতে নারী-স্বাধীনতা পরিপন্থী, সাম্প্রদায়িক ও প্রগতিবিরোধী যেসব দাবি রয়েছে, তা বহু সাধারণ মানুষকেও মর্মাহত ও ক্ষুব্ধ করেছে বলে আমার বিশ্বাস। দল-মতনির্বিশেষে এসব দাবির সমালোচনা ও বিরোধিতা আমাদের করতে হবে। কিন্তু ঢালাওভাবে অন্য দাবিগুলোও অবজ্ঞা, উপহাস এবং নাকচ করলে তা দেশকে আরও বিভক্ত ও অস্থিতিশীল করবে। স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, সরকারের মন্ত্রীরা, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী, নিজেই কিছু দাবি নিয়ে আলোচনা বা সমঝোতার সুযোগ আছে বলেছেন। আমার মতে, এসব দাবির অন্তত কিছু ক্ষেত্রে সরকার ও বিরোধী দলের একই ধরনের আদর্শিক অবস্থান গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। তা না করে হেফাজতের সমর্থন ও ভোটের চিন্তা মাথায় রেখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে তা দেশের জন্য ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে।
হেফাজতে ইসলামের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য দাবিটি হচ্ছে আল্লাহ, ইসলাম ও মহানবী (সা.) নিয়ে কটূক্তি ও উপহাসকারীদের শাস্তির বিধান। বাংলাদেশের অন্তত তিনটি আইনে এসব কর্মকাণ্ড ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত। এসব আইনে শুধু ব্লগারই নয়, যাঁরা সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর রাজনীতি করেন এবং অন্য ধর্ম ও তাদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর আক্রমণ করেন, সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অবকাশ রয়েছে। তবে ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তিকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের যে দাবি হেফাজতে ইসলাম করেছে, তা উদ্বেগজনক। এ ধরনের আইনের কী ব্যাপক অপপ্রয়োগ হতে পারে এবং তা একটি দেশকে কী ভয়াবহ সংকটে নিপতিত করতে পারে, তার বহু উদাহরণ আমাদের আশপাশের দেশে রয়েছে। হেফাজতে ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে এই দাবিতে অনড় থাকতে পারে, কিন্তু আমার ধারণা, প্রচলিত আইনে ধর্মীয় অপরাধের বিচার করার আন্তরিক উদ্যোগ নিলে এই দাবির পক্ষে উত্তাপ প্রশমিত হয়ে যাবে।
হেফাজতে ইসলামের আরেকটি প্রধান দাবি হচ্ছে সংবিধানে রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতির ভেতর ‘মহান আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন করা। পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে স্থাপিত সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের সংবিধানে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ৩৬ বছর টিকে ছিল। দেশের চারটি প্রধান দলের ভেতর শুধু আওয়ামী লীগ বাদে বাকি তিনটি দলই এই মূলনীতিতে বিশ্বাসী বলা যায়। ভবিষ্যতে সংসদে এদের আসন কখনো দুই-তৃতীয়াংশ হলে এই মূলনীতি এমনিতেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, ভোটের রাজনীতি মাথায় রেখে আওয়ামী লীগ নিজেই কি এটি পুনঃস্থাপনের উদ্যোগ নেবে? আওয়ামী লীগ সংবিধানে জিয়াউর রহমানের বিসমিল্লাহ এবং এরশাদের রাষ্ট্রধর্ম বহাল রেখেছে, আবার একই সংবিধান বঙ্গবন্ধু আমলের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বিধান ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃস্থাপন করেছে। তবে ‘মহান আল্লাহ্র প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণেই আওয়ামী লীগের জন্য দুঃসাধ্য হতে পারে।
হেফাজতে ইসলামের বাকি কিছু দাবি গতানুগতিক ও স্বাভাবিক। তাদের আন্দোলনে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি এবং সারা দেশে ইমাম-মাশায়েখ এবং মাদ্রাসাছাত্রদের বিভিন্ন হয়রানি বন্ধের যে দাবি তারা করেছে, সরকার তা সহানুভূতির সঙ্গে ভেবে দেখতে পারে।

তিন
হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে অন্য কিছু দাবি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের সংবিধান (১৯৭২ থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি সংবিধান), সমাজচেতনা, সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রগতির সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ শোনায়। হেফাজতে ইসলাম কি প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধে মেলামেশা বন্ধ করা বলতে নারীকে ঘরে বন্দী করতে বলছে? মোমবাতি প্রজ্বালনসহ বিজাতীয় সংস্কৃতি প্রতিরোধ বলতে আমাদের সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত গতিপ্রবাহ রুদ্ধ করে দিতে চাইছে? ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের কথা বলে তারা কি ভাস্কর্য ও মূর্তির পার্থক্য অস্বীকার করতে চাইছে? কাদিয়ানী (আহমদিয়া) সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘোষণার দাবি তুলে হেফাজতে ইসলাম কি মুসলমান বা অমুসলমান ঘোষণার ভার সরকারের ওপর দিতে চাইছে? হেফাজতে ইসলাম যদি এ রকম কিছু বোঝাতে না চায়, তাহলে তা তাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে।
আর যদি হেফাজতে ইসলাম ঠিক তা-ই চায়, তাহলে আমাদের বলতে হবে যে দেশ ও সমাজকে আমূলে বদলে দেওয়ার দাবি তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য কারও ওপর জোর করে চাপিয়ে দিতে পারে না। সত্যি তারা এসব করতে চাইলে রাজনৈতিক দল গঠন করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসে তাদের তা করতে হবে। হেফাজতকে মনে রাখতে হবে যে অতীতে অনুরূপ দাবি উত্থাপনকারী ইসলামি দলগুলো জনগণের ভোটে বিপুলভাবে পরাজিত হয়েছে, তাদের এসব দাবি যে সমাজের অধিকাংশ মানুষের চিন্তা-চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী, তা এতে প্রমাণিত হয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের নারী ও প্রগতিবিরোধী দাবিগুলো তাদের অন্য দাবিগুলোর প্রতি মানুষের সহানুভূতি নষ্ট করবে, তাদের বিরুদ্ধে সব প্রগতিশীল সামাজিক শক্তিগুলোকে মাঠে নামাতে বাধ্য করবে, বিদেশি দাতাদের কাছে বাংলাদেশে মৌলবাদীদের উত্থান বিষয়ে আশঙ্কা জোরদার করবে। এই পরিস্থিতি আওয়ামী লীগের রাজনীতির জন্য অনুকূল হবে, উগ্রবাদ দমনের রাজনীতির আবরণে আওয়ামী লীগের জন্য বিরোধী মতগুলো দমন করার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং হেফাজতের ভাষায় ‘ইসলামবিরোধী’ সরকারের পুনরায় ক্ষমতার আসার পথ সুগম হবে। হেফাজতের ভেতর থেকে কেউ কি ইচ্ছে করে প্রথম প্রণীত ছয় দফা দাবিকে ১৩ দফায় রূপান্তর করে এই সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দিয়েছেন? হেফাজতের নেতাদের গভীরভাবে এসব ভাবতে হবে। দেশের মানুষের কাছে অগ্রহণযোগ্য দাবিনামা পেশ করে এবং তাদের আতঙ্কিত করে হেফাজতে ইসলাম ইসলাম ধর্মকে কতটা হেফাজত করতে পারল, এটিও তাঁরা ভেবে দেখবেন আশা করি।

চার
হেফাজতে ইসলামকে নিয়ে সরকারের এখন আর তেমন উৎকণ্ঠা থাকার কথা নয়। হেফাজতের কিছু দাবি ইতিমধ্যে গোটা সংগঠনের প্রতি অনেক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক করে তুলেছে, সময় পেলে নানা পন্থায় তাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতেও সরকার সক্ষম হবে। অন্যদিকে গোটা বিষয়টি ভালো করে না বুঝে বিএনপির দুজন নেতার হেফাজতের সমাবেশস্থলে গমন দেশের মানুষ ও প্রভাবশালী দাতা গোষ্ঠীর কাছে দলটি সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করবে। হেফাজতের সমাবেশের পর বিএনপির নেতাদের গণহারে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়ার আত্মবিশ্বাস আওয়ামী লীগ সরকার কেন পেল, তা কি বিএনপি বুঝতে পারছে?
সার্বিক বিচারে আপাতত জয় হয়েছে আওয়ামী লীগের। এই বিজয় যদি আওয়ামী লীগ একই সঙ্গে ধর্মের অবমাননা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদ দমনের কাজে ব্যবহার করে, তাহলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে। উগ্রবাদ যেমন অপরাধ, ধর্মকে অবমাননা করে উগ্রবাদকে উসকে দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করাও অপরাধ। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে উগ্রবাদের আগুন আওয়ামী লীগ সব সময়ই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে বা এই আগুন বিরোধী দলের অগ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টিতে ব্যবহার করতে পারবে, এমন গ্যারান্টি তো কোথাও নেই!
হেফাজতে ইসলামের সমাবেশের প্রগতিবিরোধী দাবিগুলো অবশ্যই আওয়ামী লীগকে অগ্রাহ্য করতে হবে। আওয়ামী লীগকে বেকায়দায় ফেলার চিন্তা থেকে এসব দাবিকে নাকচ করার দায়িত্ব পালন না করলে বিএনপিও ভুল করবে। অন্যদিকে হেফাজতের যে দাবিগুলো ন্যায্য, সেগুলো আওয়ামী লীগকে সহানূভূতির সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। ঢালাওভাবে হেফাজতের বা দেশের বহু মানুষের ধর্মীয় অবমাননাবোধকে অগ্রাহ্য করলে পরিস্থিতি ভবিষ্যতে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এটি অগ্রাহ্য করা উচিতও হবে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন