মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৩

যুদ্ধাপরাধী বিচার ॥ কামারুজ্জামান ও গো. আযমের পক্ষে যুক্তিতর্ক শেষ ॥ পাল্টা জবাব আজ ও কাল

জনকণ্ঠ, স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। আজ কামারুজ্জামান ও কাল গোলাম আযমের পক্ষে দেয়া যুক্তিতর্কের পাল্টা জবাব ও সমাপনী বক্তব্য প্রদান করবেন প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে তাদের জবাব ও সমাপনী বক্তব্য শেষ হলেই ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করবে। অন্যদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দীর দিন আজ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এই আদেশগুলো প্রদান করেছে।

গো. আযম ॥ অবশেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গোলাম আযমের মামলা শেষ হতে চলেছে। বুধবার প্রসিকিউশন পক্ষের জবাব ও সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের মামলা শেষ হবে। সোমবার গোলাম আযমের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছেন তাঁর আইনজীবীরা। ১৭ এপ্রিল বুধবার এ ব্যাপারে প্রসিকিউশনকে জবাব দেয়ার জন্য তারিখ ধার্য করেছে ট্রাইব্যুনাল। চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সোমবার এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
বৃহস্পতিবার মোট ১৩ কার্যদিবস আসামি পক্ষ তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। এর আগে প্রসিকিউশন ৯ কার্যদিবস তাদের যুক্তি উপস্থাপন করেন। গোলাম আযমের পক্ষে তাঁর আইনজীবী ইমরান সিদ্দিকী বৃহস্পতিবার যুক্তি উপস্থাপন করেন। মাঝে ১১টা ২০ থেকে ১২টা ৩৫ মিনিট পর্যন্ত ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক যুক্তি উপস্থাপন করেন। যুক্তিতর্ক শেষে ব্যারিস্টার রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘গোলাম আযম হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এ মর্মে কোন প্রমাণ প্রসিকিউশন উপস্থাপন করতে পারেনি। এটা প্রসিকিউশনের ব্যর্থতা। সুতরাং প্রসিকিউশনের এ ব্যর্থতার দায় নিয়ে গোলাম আযমকে শাস্তি দেয়া ঠিক হবে না। এর আগে তাঁর পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক, এ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলাম যুক্তি উপস্থাপন করেন।
প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, অধ্যাপাক গোলাম আযম ’৭১ সালের অপরাধের দায় থেকে কোনভাবেই মুক্ত হতে পারেন না। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার ডিফেন্সের আর্গুমেন্ট শেষ করার কথা ছিল, আইন অনুযায়ী তারা তাদের আর্গুমেন্ট শেষ করেছেন। তবে আমরা আরও ১ দিন আর্গুমেন্ট করব আগামী ১৭ এপ্রিল। সুলতান মাহমুদ বলেন, গোলাম আযমের পক্ষে তাঁর আইনজীবী প্রসিকিউশনের ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করলেও তারা প্রসিকিউশন আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেননি। গোলাম আযম ’৭১ সালের অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি বলেন, গোলাম আযমের লেখা ‘জীবনে যা দেখলাম’ বইয়ের দাখিল করা ডিফেন্সের ডকুমেন্টেই উল্লেখ আছে যে তিনি ২৫ মার্চ কালো রাতের হায়েনাদের হামলার পরের দিন ২৬ মার্চ সকালে রাজারবাগসহ বিভিন্ন স্পর্টে ঘুরে বেরিয়েছেন।
আগামী ১৭ এপ্রিল প্রসিকিউশনের আরেক ধাপ যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে মামলাটি রায়ের দিন ধার্যের জন্য সময় নির্ধারণ করা হবে। আসামি পক্ষের সাফাই সাক্ষীদের ১২ জনের মধ্যে মাত্র ১ জন সাক্ষীর জবানবন্দী গ্রহণ করে ট্রাইব্যুনাল। একমাত্র সাফাই সাক্ষী গোলাম আযমের ছেলে সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী তাঁর বাবার পক্ষে সাক্ষ্য দেন।
অন্যদিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মতিউর রহমানসহ গোলাম আযমের বিরুদ্ধে জব্দ তালিকার ৭ সাক্ষীসহ মোট ১৭ জন সাক্ষী প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামি পক্ষ তাদের জেরা করেছে। তাদের মধ্যে ১ জন সাক্ষীর আইওর কাছে দেয়া জবানবন্দীকে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। মানবতাবিরোধী ৫ ধরনের অপরাধের সুনির্দিষ্ট ৬১টি ঘটনায় অভিযুক্ত করে গত বছর ১৩ মে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে ট্রাইব্যুনাল। গত বছরের ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে গত বছরের ৯ জানুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দেয়া আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হয়।
কামারুজ্জামান ॥ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের পক্ষেও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ করেছে আসামি পক্ষের আইনজীবী। আজ আসামি পক্ষের যুক্তিতর্কের জবাব ও সমাপনী বক্তব্য প্রদান করবেন প্রসিকিউশন পক্ষ। প্রসিকিউশনের জবাবের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের মামলাও শেষ হবে। এর পর ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণার জন্য দিন নির্ধারণ করবেন। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ আদেশ প্রদান করেছে। ট্রাইব্যুনালে অন্য দু’সদস্য ছিলেন বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া ও জেলা জজ মোঃ শাহিনুর ইসলাম।
সোমবার কামারুজ্জামানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। এরপর ট্রাইব্যুনাল আইনী পয়েন্টে যুক্তি উপস্থাপনের জন্য প্রসিকিউশনকে আগামীকাল ১ ঘণ্টা সময় দেয়। বিরোধী দলের ডাকে হরতালের অজুহাতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা একাধিক নির্ধারিত তারিখে অনুপস্থিত থাকায় স্বাভাবিক বিচার কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। তাই কামারুজ্জামানের মামলায় সোমবারের মধ্যে আসামিপক্ষকে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করতে বৃহস্পতিবার আদেশ দিয়েছিল ট্রাইব্যুনাল।
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন ১৮ সাক্ষীকে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য প্রদানের জন্য হাজির করলেও সাফাই সাক্ষ্য হিসেবে আসামিপক্ষ হাজির করেছে ৫ জনকে। এসব সাফাই সাক্ষীদের মধ্যে আছেন কামারুজ্জামানের ছেলে ও বড় ভাই।
গত বছরের ৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। আলবদর বাহিনীর অন্যতম নেতা কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী ৭ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের অব্যবহিত পূর্বে ’৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা, বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর ও শেরপুর অঞ্চলে শতাধিক মানুষকে হত্যা ও শতাধিক মহিলাকে ধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
কামরুজ্জামানের মামলায় তদন্ত কর্মকর্তাসহ প্রসিকিউশন পক্ষের ১৮ সাক্ষ্য দেন। প্রসিকিউশনপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাইব্যুনাল আসামি পক্ষের এক হাজার ৩৫৪ সাক্ষীর তালিকা থেকে প্রথমে সাফাই সাক্ষীর সংখ্যা চারজনে সীমাবদ্ধ করে দেন। পরে আসামি পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাফাই সাক্ষী আরেক বাড়ানো হয়। আসামি পক্ষের পাঁচজন সাক্ষ্য দিয়েছেন।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে করা মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছরের ২ অক্টোবর তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১১ সালের ১১ ডিসেম্বর ট্রাইব্যুনাল-১-এ তাঁর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন পক্ষ। ওই বছরের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগে গত বছরের ৪ জুন এ ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়। ২ জুলাই তাঁর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষ্য নেয়া শুরু হয়। আসামি পক্ষের সাক্ষ্য নেয়া শুরু হয় ৬ মার্চ।
নিজামী ॥ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী আজ পুনর্নির্ধারণ করেছে ট্রাইব্যুনাল। সোমবার চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই আদেশ প্রদান করেছে।
সোমাবার দুপুর আড়াইটার দিকে চতুর্থ সাক্ষীর জবানবন্দী দেবার কথা ছিল। কিন্তু সাক্ষী অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে আজ তার জবানবন্দী গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়। এর আগে আরও তিন জন সাক্ষী তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। এরা হলেন ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মিজবাহুর রহমান, জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল ও রুস্তুম আলী মোল্লা।
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৮ মে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ আনা হয়। ১৬ নম্বর অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রেসিডেন্ট ও আলবদরের প্রধান হিসেবে বুদ্ধিজীবী হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্য ১৫টি অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যা, হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ এ ধরনের অপরাধে সহযোগিতা করা, ষড়যন্ত্র করা ও উর্ধতন নেতা হিসেবে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন