মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৩

ফটিকছড়ি হত্যার ভিডিও ফুটেজ, রোহিঙ্গারাও অংশ নেয়

ঘটনার আগের রাতেই নীলনক্সা তৈরি হয়
জনকণ্ঠ, চট্টগ্রাম অফিস/ফটিকছড়ি সংবাদ-দাতা ॥ চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রায় নৃশংস হামলাকারীরা ছিল প্রশিক্ষিত ক্যাডার। হামলার ভিডিও ফুটেজই বলে দেয়, তারা কেমন নিষ্ঠুর ও অমানবিক। ইন্টারনেটে আপলোড করা ভিডিও চিত্র দেখে বিশ্বাস হতে কষ্ট হয় যেÑ মানুষ এতটা নির্মম হতে পারে! এতে অংশ নিয়েছে জামায়াত-শিবির, হেফাজতে ইসলামের কর্মী এবং রোহিঙ্গারাও। দক্ষিণ চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বহিরাগত সন্ত্রাসী ও জঙ্গীরা ফটিকছড়ির পাহাড়কে নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়ে কিছুদিন ধরেই অবস্থান করছিল। দফায় দফায় বৈঠক ও ঠা-া মাথায় প্রস্তুতি নিয়ে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে চালানো হয়েছে এই বীভৎস হামলা। হামলার ভিডিও ফুটেজ নিয়ে এখন তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ইন্টারনেটে এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে এ ফুটেজটি এখন দেখানো হচ্ছে।
ফটিকছড়িতে গত ১১ এপ্রিল সংঘটিত নির্মম চিত্রের ভিডিও ফুটেজ অত্যন্ত ঝুঁকির মুখে ধারণ করেছেন কয়েক আওয়ামী লীগ কর্মী। ধারণকৃত ওই ভিডিও চিত্র ছাড়া হয়েছে ইন্টারনেটে। বর্তমানে এ ভিডিও ফুটেজ মোবাইল ফোনে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ এ ফুটেজ দেখে রীতিমতো হতবিহ্বল হয়ে পড়েছেন। চলছে সর্বত্র আলোচনার ঝড়। সবার এখন একটিই প্রশ্নÑকেন এই নির্মম আচরণ? এ ঘটনায় শিহরিত অনেকেরই মন্তব্যÑএমন মানবতাবিরোধী কর্মকা- মেনে নেয়া যায় না। অনেকেই এ ভিডিও ফুটেজ দেখে কার্যত নির্বাক।
সহিংস এই হামলায় পাইন্দং ফকির চান বিলের চৌধুরীপাড়ার আমীর হোসেনের ছেলে লিয়াকত, মির্জাহাট বণিক সমিতির সহসভাপতি বজলুল করিম, কাজীরহাট মাদ্রাসার মোহতামেম জুনায়েত বিন জালালের ছেলে শিবির ক্যাডার এরশাদ, ওই এলাকার আবুল মুনসুর, আমানউল্লাহ, মাস্টার আবদুর রহিম, ছালে আহম্মদ, ইউসুফ, গুন্নীমনা, শহীদ উল্লাহ, এয়াকুবসহ শতাধিক জামায়াত-শিবির ক্যাডার এবং হেফাজতে ইসলামের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীরা, ভুজপুরের সাবেক চেয়ারম্যানের ছেলে মামুনসহ বহিরাগত ক্যাডাররা এ হামলায় অংশ নেয়।
ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আশ্রিত আওয়ামী লীগের তিন কর্মীকে বহিরাগত জামায়াতী ক্যাডাররা অমানবিক লাঠিপেটা ও কিরিচ দিয়ে কোপায়। তাদের এ হামলায় দু’জন ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান। তবে এ ক্যাডারের পরিচয় জানা যায়নি। অন্যদিকে বাঁশখালী ও সাতকানিয়া থেকে পালিয়ে আসা অনেক ক্যাডার এ সহিংসতায় অনেকটা মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সরকারী এক কর্মকর্তা জানান, ওই দিন ক্যাডারদের যেভাবে ক্রোলিং করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাতে দেখা গেছে, তাতে নিশ্চিতভাবে বোঝা যায়Ñএরা প্রশিক্ষিত ক্যাডার।
ভৌগোলিক দিক দিয়ে সুন্দরপুর, দাঁতমারা এবং হারুয়ালছড়ির মধ্যখানে এই ভুজপুর ইউনিয়নের অবস্থান। উত্তর-দক্ষিণে জনপদ থাকলেও পূর্ব-পশ্চিম এলাকাজুড়ে রয়েছে বিশাল অরণ্য এবং চা বাগান। যার কারণে দু-তিন মাস যাবত উল্লিখিত ইউনিয়নের পাহাড়ী এলাকাকে জামায়াত-শিবির সমর্থিত বিভিন্ন মামলায় আসামি ও খুনের মামলায় পলাতক ক্যাডারেরা নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছে। এমনকি কক্সবাজারের রুমা, চট্টগ্রামের বাঁশখালী এবং সাতকানিয়া উপজেলার অনেক চিহ্নিত সন্ত্রাসী এ উল্লিখিত ৩ ইউনিয়নে বর্তমানে আশ্রিত আছে। গত ১১ এপ্রিল সংঘটিত হামলার পরিকল্পনাকারী চেয়ারম্যান সফিউল আলম নূরীসহ কয়েক জনপ্রতিনিধি ওইখানে আশ্রয়ে থাকা ক্যাডারদের ১০ এপ্রিল (ঘটনার আগের দিন) হামলা সংক্রান্ত বিষয়ে সবুজ সঙ্কেত দেন। ফলে পাহাড়ের নিরাপদ আশ্রিত ক্যাডাররা এই বর্বর হামলায় অংশ নিয়ে সহিংসতাকে আরও বাড়িয়ে দেয় বলে সূত্রে প্রকাশ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, যাতায়াতের দিক দিয়ে ভুজপুর থেকে ফটিকছড়ি সদর, ভুজপুর থেকে হেঁয়াকো এবং ভুজপুর থেকে নাজিরহাট এই সড়ক তিনটির সংযোগস্থল কাজীরহাট মোড়কে হামলার ক্ষেত্র হিসেবে জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা বেছে নেয়। তারা স্থানীয় হেফাজতে ইসলামী নেতা এবং সাকার ক্যাডারসহ স্থানীয় নারী-পুরুষকে মাইকিং করে উদ্বুদ্ধ করে। এমনকি এ হামলায় মহিলারাও মারাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করে। সূত্রে আরো জানা গেছে, ভূজপুরের ঐ এলাকায় বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী উদ্বাস্তু। নিশ্চিতভাবে জানা গেছে যে, ওই এলাকার শত শত উদ্বাস্তু পরিবারের মধ্যে রোহিঙ্গা পরিবার অনেক। যার ফলে সব মিলে ভুজপুরে মৌলবাদীরা হিংস্র রূপ ধারণ করে। ওই উদ্বাস্তুদের এলাকার মধ্যে রয়েছে কৈয়া, আনন্দপুর, মানসপাড়া, সন্দ্বীপপাড়া, জঙ্গল কৈয়া এবং বৈদ্যপাড়া। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বৈদ্যপাড়া নিবাসী জনৈক জসিম মেম্বারের বাড়ি থেকে ওইদিন জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণ করে হামলায় অংশগ্রহণ করার জন্য জড়ো করা হয়। উক্ত জসিম মেম্বার ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রায় হামলার জন্য সফিউল আলম নূরীর সঙ্গে মাইকিং করে। ক্রমান্বয়ে আরও ১০টি মসজিদ থেকে মাইকিং করার জন্য আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেয় বলে ওই প্রত্যক্ষদর্শী জানান।
এদিকে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি এলাকায় আওয়ামী লীগের শোভাযাত্রায় জামায়াত-শিবির, বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামের বর্বরোচিত হামলার ঘটনার ৪ দিন পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। নির্মম এ ঘটনায় তিন দফায় এ পর্যন্ত জামায়াত-শিবিরের ৪৮ ক্যাডারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এলাকায় এখন থমথমে অবস্থা। আতঙ্ক কাটেনি জনমনে। গত রবিবার ছিল স্থানীয় কাজিরহাট বাজারবার। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় বাজার বসেনি। এখনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো জমে ওঠেনি। সড়কে ও গ্রামে-গঞ্জে লোকসমাগম উল্লেখযোগ্য নয়। স্থানীয় প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলোও কার্যত অঘোষিত বন্ধ। এর আগে গত শনিবার রাতে ভুজপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামশুদ্দিন ভূঁইয়াকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বর্তমান ওই থানায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওসি অং থোয়াই মার্মা।
ফটিকছড়িতে সংঘটিত নির্মম এই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা সকলেই জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার। এর মধ্যে গত রবিবার রাতে অভিযান চালিয়ে জাহাঙ্গীর (২৮), তছলিম মেম্বার (৩০) এবং নিজামউদ্দিন নামের ৩ জামায়াত-শিবির ক্যাডারকে গ্রেফতার করা হয়। স্থানীয় জামায়াত নেতাদের ইন্ধনে এ নির্মম ঘটনায় দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী, সাতকানিয়া, কক্সবাজারের রুমার জামায়াত-শিবিরের কিছু ক্যাডার অংশ নিয়েছে বলে থানা সূত্রে তথ্য মিলেছে। অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন খুনের মামলায় পলাতক এবং আদালত থেকে জামিনে আসা আসামি। তারা পাহাড়ী এলাকায় নিরাপদ অবস্থানে থেকে এই হামলায় অংশ নেয়। এ ছাড়া পাহাড়ী এলাকায় উদ্বাস্তু প্রশিক্ষিত রোহিঙ্গারা এ হামলায় অংশ নিলে পরিস্থিতি সহিংসতায় রূপ দেয়।
আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম পেয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে এ শোভাযাত্রা বের হবেÑএই খবর শুনে ১০ এপ্রিল বুধবার রাতে জামায়াত-শিবিরের চিহ্নিত নেতারা পশ্চিম ভুজপুর গ্রামের একটি বাড়িতে হামলার নীল নকশা তৈরি করে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জামায়াতের আমির সফিউল আলম নূরীর নেতৃত্বে (গ্রেফতারকৃত) এক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। বৈঠকে উপজেলা পরিষদের একজন জনপ্রতিনিধি, পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের জামায়াতপন্থী চেয়ারম্যান, ভুজপুরের সাবেক চেয়ারম্যান, উপজেলা জামায়াতের সাবেক আমির ও দাঁতমারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সুন্দরপুর ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি ওই নীল নকশা প্রণয়নের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ ইতোমধ্যে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে সব তথ্য পাওয়ার পরও মামলাজনিত কারণে মুখ খুলছে না।
দেশের অন্যান্য স্থানে সংঘটিত ঘটনার ন্যায় ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি বর্তমান সরকারকে ব্যর্থ সরকার হিসেবে প্রমাণ করতে এবং দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার মানসে ফটিকছড়িতে তালেবানী কায়দায় এ নির্মম হামলা হয়েছে এ বিষয়ে নিশ্চিত পুলিশ। এহেন বর্বরোচিত, নৃশংস হামলা দেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম। এ হামলায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে ফটিকছড়িতে। এ সহিংসতার পর থেকে এখানে কেউ একে অপরকে বিশ্বাসই করতে পারছেন না। উপজেলাজুড়ে দেখা দিয়েছে চরম আতঙ্ক।
সহিংস এ ঘটনার পর থেকে ভুজপুরে জীবনযাত্রা এখনও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। রবিবার ছিল স্থানীয় কাজিরহাট বাজার-বার। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় কোন বাজার বসেনি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগই এখন বন্ধ।। রাজপথে এবং এখানকার গ্রামে-গঞ্জে জনসমাগম তেমন চোখে পড়ছে না।
এদিকে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সোমবার অনুষ্ঠিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় ভুজপুর এলাকাধীন ১০ জন পরীক্ষার্থী নানুপুর কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। এই কলেজের অধ্যক্ষ ও কেন্দ্র সচিব আ ন ম সরোয়ার আলম তাদের অনুপস্থিতির কথা স্বীকার করেন। অপরদিকে ১১ এপ্রিলের সংঘটিত নির্মম, নৃশংস ও বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে সোমবার দুপুরে উপজেলা ছাত্রলীগের উদ্যোগে উপজেলা সদর বিবিরহাটে এক প্রতিবাদ মিছিল বের করে। মিছিলটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে এক সমাবেশের আয়োজন করে। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সাহেদুল আলম সাহেদের সভাপতিত্বে এই সমাবেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বক্তব্য রাখেন এবং দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
ভুজপুর থানা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, গত শুক্রবার দায়ের করা মামলা ছাড়া আওয়ামী লীগ এখনও মামলা দায়ের করেনি। আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে যে, তাড়াহুড়ো না করে ধীরস্থিরে মামলা করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন