শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০১৩

শিবিরের সন্ত্রাসী কর্মকা- রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল

শাহজাহান মিয়া
বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার প্রকাশ্য উস্কানিতে জামায়াত-শিবির ও তাঁর নিজ দলের কর্মীরা উৎসাহিত হয়ে সারাদেশে তা-ব চালানোর কারণে পুরো দেশের মানুষ যেমনই অসহায় হয়ে পড়েছে ঠিক তেমনি এ মুহূর্তে একটি নির্মম-নিষ্ঠুর সন্ত্রাসী ঘটনার বিবরণ লিখতে গিয়ে আমি একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছি। বিষয়টি পত্রিকায় পড়ে ও টেলিভিশনের পর্দায় দেখেও নারকীয় ঘটনাটির বীভৎসতা ও নির্মমতার সঠিক বিবরণ তুলে ধরতে আমি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হচ্ছি। আমার সীমিত বাংলা জ্ঞানের ভা-ারে এমন যুৎসই শব্দ নেই যে এই পৈশাচিক ও মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানানোর ঘটনাটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি। আমার অসমর্থতার জন্য পাঠকের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
পাঠকরাও নিশ্চয়ই বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে দেখেছেন যে গত ১ এপ্রিল রাজশাহী শহরের শালবাগান বাজারে দুর্ধর্ষ শিবির ক্যাডাররা পুলিশের একজন এসআইর ওপর হায়েনার হিংস্রতা নিয়ে হেলমেট ও ইট দিয়ে কি নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে লোকটিকে পিটিয়ে তাঁর মাথা ও মুখম-ল থেঁতলে দিয়েছে। প্রায় মৃতাবস্থায় পড়ে থাকা ৫৮ বছর বয়সী পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের কোমরে ঝোলানো পিস্তলটিও দুর্বৃত্তরা নিয়ে যায়। বোনের মমতা নিয়ে ঝর্ণা বেগম নামে এক সাহসী মহিলা ছুটে এসে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাটির মাথা তুলে লোকজন ডাকাডাকি শুরু করে। একজন সাংবাদিক হিসেবে আনন্দে আমার বুকটা ভরে যায় এ কথাটি জেনে যে, রাজশাহীর সাংবাদিক ভাইয়েরা দৌড়ে এসে মারাত্মক আহত ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে একটি অটোরিক্সা ডেকে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে তাঁকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। অবস্থার অবনতি ঘটলে রাতে তাঁকে বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টারে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আনা হয়।
ুরাজশাহীতে শিবিরের তা-বের ধারাবাহিকতায় মাত্র ২৪ ঘণ্টা আগেই বোমা মেরে পুলিশের এসআই মকবুল হোসেনের হাতের কব্জি উড়িয়ে দেয়া হয়। শিবির কর্মীদের নিক্ষিপ্ত বোমায় হাত হারানোর যন্ত্রণা ও দুঃসহ বেদনায় কাতর এই তরুণ পুলিশ কর্মকর্তার করুণ মুখখানি দেখে অনেকেই আঁতকে উঠেন। তাঁদের গা শিউরে উঠেছিল। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যায়, শিবিরকর্মীরা শালবাগান এলাকায় মিছিল বের করে কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটালে সেখানে দায়িত্বরত প্রায় ২০ জনের একটি টহল পুলিশ দল তাদের ধাওয়া করে। শিবির ক্যাডাররা ত্বরিত কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে পুলিশের ওপর মুহুর্মুহু ককটেল ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। বাধ্য হয়ে পুলিশ তখন শিবির ক্যাডারদের দিকে রবার বুলেট ছুড়তে ছুড়তে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে পেছনে পড়ে যান জাহাঙ্গীর আলম। আর এটাই তাঁর বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা জনা ১৫ শিবিরকর্মী তখন জাহাঙ্গীর আলমের ওপর চালায় নৃশংস তা-ব। ঐ দিন শিবিরের সন্ত্রাসীদের ছোড়া ককটেলে আরও চারজন পুলিশ সদস্য আহত হন। তাদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা গুরুতর। এ লেখাটি যখন লিখছি তখনই টিভি চ্যানেলে দেখলাম (০২ এপ্রিল) দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার হাজীর মোড়ে সকাল ১১টার দিকে পুলিশের বিশেষ (ডিএসবি) শাখার এসআই আবদুস সবুরকে জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা নৃশংসভাবে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে তাঁর মাথা থেঁতলে দিয়েছে। আবদুস সবুরের মোটরসাইকেলটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে, জামায়াত-শিবির কর্মীরা এ পর্যন্ত মাত্র ৩/৪টি হামলা চালিয়েছে তা নয়, বিএনপি সমর্থকদের সক্রিয় সহায়তায় তারা অব্যাহতভাবে এ কাজটি করে যাচ্ছে গত এক বছর ধরে। একাত্তরে এ দেশে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ চালানোর বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে জামায়াত-শিবির কর্মীরা বর্তমান সহিংস দুষ্কর্মটি তাদের নেতা ও পাকিস্তানসহ বিদেশী প্রভুদের প্ররোচনায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রণীত নীলনকশার অংশ হিসেবেই করে যাচ্ছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের সাধের বাংলাদেশকে এই লোকগুলো এখনও কোনমতেই মেনে নিতে পারেনি।
এখানে কথাটি সুস্পষ্টভাবেই বলতেই হয় যে জামায়াত-শিবিরের মূল নেতৃত্বের অবর্তমানে তাদের দ্বিতীয় সারির নেতাদের দ্বারা পরিচালিত বর্তমান নেতৃত্ব ছাড়াও তাদের দলের দুঃসময়ে এখন আসল কা-ারী পাকিস্তানীদের বিশ্বস্ত বন্ধু বেগম খালেদা জিয়ার প্রত্যক্ষ মদদেই স্বাধীনতাবিরোধী এ দলটির কর্মী-সমর্থকরা তাদের অপকর্ম চালাতে দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে। তাদের স্বপ্নের পাকিস্তানে বিশ্বের মানচিত্রে বাঙালী জাতির সুমহান অস্তিত্ব ঘোষণাকারী আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে তাদের মনে এখনও ঠাঁই দিতে পারেনি। আর সে কারণেই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তা রক্ষার অপরিহার্য অঙ্গ বা প্রতিষ্ঠান পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ এখন তাদের মূল টার্গেটে পরিণত হয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে এ রকম ন্যক্কারজনক সহিংস আক্রমণ অতীতে আর কখনো ঘটেনি। এটাকে একটা ভয়ঙ্কর রাষ্ট্রবিরোধী কাজ বলেই অনেকে মনে করছেন। পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ ঘোষণা দিয়ে বীরদর্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধে শামিল হয়েছিল। আর পাকিস্তানের এ দেশীয় দোসররা আজ বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে অঘোষিত যুদ্ধে। আর সে যুদ্ধে পেছন থেকে প্রয়োজনীয় ইন্ধন জোগাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রিয় বন্ধু বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া। গত মাসের প্রথম দিকে সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসার পর তাঁর প্রচ- আগ্রাসী বক্তব্য ও ঘৃণ্য কর্মকা-ে তা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে অনেকেই এখন মনে করতে শুরু করছেন।
মারাত্মক হামলার মুখেও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা বেশিরভাগ সময়ই চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন। কখনও কখনও তারা বাড়াবড়ি করেছে বলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। নিজেদের রক্ষা বা সন্ত্রাস সামাল দিতে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশকে অনেকবার বাধ্য হয়েই কাঁদানে গ্যাস এবং রবার বুলেট ছুড়তে হয়েছে এবং তাতে বেশ কিছু প্রাণহানিও ঘটেছে। এ পর্যন্ত আটজন পুলিশ সদস্যও রাষ্ট্রের জন্য দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় জামায়াত-শিবিরের রোষানলে পড়ে জীবন হারিয়েছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াত-শিবির কর্মীদের হামলায় একমাত্র গাইবান্ধায়ই প্রাণ হারিয়েছেন চারজন পুলিশ সদস্য। দেশের দায়িত্বশীল (?) ব্যক্তিদের প্ররোচনায় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা অদূর ভবিষ্যতে পুলিশের ওপর আরও উগ্র ও মারমুখী হয়ে উঠবে বলেই সবারই ধারণা। তবে শত উস্কানির মুখেও পুলিশকে সহনশীলতা দেখাতে হবে এটাই সবার কামনা। বিকল্প কোন ব্যবস্থা ব্যর্থ হলেই একান্ত নিরুপায় হয়েই শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণে যেতে হবে। তবে এ মুহূর্তে উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুলিশের ওপর যে সশস্ত্র আক্রমণ করা হচ্ছে তার প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে তা কিভাবে অবিলম্বে বন্ধ করা যায় সে বিষয়েও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অনেক সময় টিভি চ্যানেলগুলোর বদৌলতে অনেক ঘটনা দর্শকরা দেখতে পান। কোন কোন ঘটনা সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে তারা বিষয়টি সম্পর্কে বিশদভাবেই সব দেখতে পারেন এবং সংশ্লিষ্ট ঘটনাটির বিষয়ে তাদের নিজস্ব মতামত গঠনের সুযোগ পেয়ে যান। তাতে জনগণকে বোকা বানানোর সুযোগ এখন কমে গেছে।
বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম জিয়া এবং তাঁর দলের দোসর জামায়াতে ইসলাম নানা বাহানায় হরতাল ডাকছে। গত মার্চ মাসেই হরতাল, সাপ্তাহিক ও সরকারী ছুটি মিলিয়ে ২২টি দিনই ছিল কার্যত বন্ধ। জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ না দিয়ে তাঁরা দেশে নাশকতার রাজনীতি চালানোকেই ভাল মনে করছেন। গত দুই মাসে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলায়ই এমন একটি দিন পার হয়নি যে কোন না কোন জায়গায় হরতাল পালন হয়েছে। জনগণের কাছে সবচেয়ে অপ্রিয় এ হরতালই হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন দেশের প্রধান সমস্যা। দেশের অর্থনীতিতে ইতোমধ্যেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমাদের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি গার্মেন্টস শিল্প এখন বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য বাংলাদেশের ৫০ কোটি ডলার মূল্যের রফতানি অর্ডার ভারত পেয়ে গেছে বলে জানা গেছে। অন্যান্য শিল্পেও এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক আঘাত হানবে।
বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও মুখ ফিরিয়ে নেবে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ছে। শিক্ষাব্যবস্থাও তছনছ হয়ে যাচ্ছে। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সন্তানদের না হয় পড়াশোনার বালাই নেই। নিশ্চয়ই বিরোধী দলের অনেক নেতানেত্রীর ছেলেমেয়েরা এ মাসে শুরু হওয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী। হরতাল যাঁরা ডাকছেন সে সব নেতা এ মাসে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার বিষয়টি কোনমতেই বিবেচনায় রাখলেন না তবে তারা কেমন নেতা হলেন। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামকে বলতে শোনা যায়, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে একটু অসুবিধা হতেই পারে। একজন শিক্ষিত ব্যক্তির মুখ থেকে এ রকম কথা শুনলে মানুষের বিস্ময়ের আর সীমা থাকে না। তবে রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের কল্যাণ সাধনই প্রধান এবং একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। তবেই সার্বিকভাবে দেশের মঙ্গল হতে পারে। কিন্তু এ সত্যটি আমাদের রাজনীতিকরা খুব একটা আমলে নেন বলে মনে হয় না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন