শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

জামায়াতের দাবিই উত্থাপন করল হেফাজত

রাশেদ খান মেনন
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ ৬ এপ্রিল ঢাকার মহাসমাবেশে যে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরেছে, তার দ্বিতীয় দফায় ‘আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস’ করার কথা বলা হয়েছে।

ভিন্ন ভাষায় বলা হলেও এটা কার্যত ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবি এবং এটা নতুন দাবিও নয়। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান আমির পঞ্চম সংসদে ১৯৯৩ সালে এ আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে একটি বেসরকারি সদস্য বিল বা প্রাইভেট মেম্বার বিল এনেছিলেন। জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচনী ইশতেহারেও এ আইন প্রণয়নের কথা বলা আছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নকে পেছনে ঠেলে দিতে হেফাজতে ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর উত্থাপিত এ দাবিকেই সামনে নিয়ে এসেছে। অজুহাত ব্লগারদের কথিত ধর্মবিদ্বেষী লেখার। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ যখন যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান ও জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিতে দেশজুড়ে অভূতপূর্ব জাগরণ সৃষ্টি করে, তখন হঠাৎ করেই শাহবাগ আন্দোলনের সংগঠকদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তোলা হয়। ব্লগার রাজীবকে পল্লবীতে তাঁর বাসার সামনে হত্যা করার পর তাঁর বিরুদ্ধেই প্রথমত ইসলাম, আল্লাহ, রাসুল (সা.)-কে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করে ব্লগে লেখার অভিযোগ আনা হয়। অথচ শাহবাগ আন্দোলনে রাজীবের সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। রাজীব দীর্ঘদিন ধরে ব্লগে লেখালেখি করলেও তাঁর হত্যার ঘটনার আগে তাঁর বিরুদ্ধে এ অভিযোগও আনা হয়নি। আনা হয় পরে, হত্যাকে বৈধতা দিতে।
প্রথমে ইনকিলাব, পরে আমার দেশ ও সংগ্রাম পত্রিকায় রাজীবের কথিত ব্লগের লেখা প্রকাশ করা হয়। এরই সূত্র ধরে হেফাজতে ইসলামের আমির কওমি মাদ্রাসাগুলোর এক অংশের প্রধান মাওলানা আহমদ শফী জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম-এ একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন, যাতে আল্লাহ ও তাঁর নবীকে নিয়ে কুৎসা রটানোর বিরুদ্ধে মুসলমানদের রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়। এরপর চট্টগ্রামে গণজাগরণ মঞ্চের মহাসমাবেশ প্রতিহত করার জন্য হেফাজতে ইসলামের হরতালের কর্মসূচি ঘোষণা, ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশ এবং তা থেকে ১৩ দফা ঘোষণার কথা সবার জানা।
ঘটনাপরম্পরায় এটা সুস্পষ্ট যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেই হেফাজতে ইসলাম বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে দিতে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবি এনেছে। হেফাজতে ইসলাম শুধু জামায়াত কর্তৃক সমর্থিত হয়েই এ ধরনের দাবি উত্থাপন ও আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়নি, এটা করতে তারা জামায়াতের বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্যও পেয়েছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বিএনপিও সরকার পতনের আন্দোলনে একে ব্যবহারের জন্য হেফাজতের এ আন্দোলনের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য হেফাজতের ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবি সম্পর্কে তারা সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। এ প্রশ্নে এখনো বিএনপির অবস্থান নেতিবাচক। তবে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে ধর্মের কার্ড ব্যবহার করার যে ইতিহাস রয়েছে, তাতে এ ধরনের দাবি মেনে নিতে তারা যে বিশেষ দ্বিধা করবে না, এ কথা বলা যায়। ফলে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের বিষয়টি রাজনীতির বর্তমান অবস্থায় কাঁটা হয়ে ঝুলে থাকবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক গণণতান্ত্রিক ভিত্তির প্রশ্নকে আস্তিকতা-নাস্তিকতার প্রশ্ন তুলে কোণঠাসা করে দেওয়ার চেষ্টা চলবে।
আশার কথা যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসির সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নে হেফাজতের দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, কোনো ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম, আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর প্রতি কোনো ধরনের কটূক্তি, কুৎসা রটানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রচলিত আইনেই বিধান রয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনেই এ ব্যাপারে সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এ কথায় দেশবাসী আশ্বস্ত হলেও ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে হেফাজতসহ জামায়াত ও বিভিন্ন জঙ্গিবাদী সাম্প্রদায়িক সংগঠন কর্তৃক দেশে দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী পর্যায়ের কিছু ব্যক্তির কথা ও আচরণে জনমনে অস্বস্তি রয়ে গেছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর তাঁদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তবে এ দেশের মানুষ খন্দকার মোশতাকের ভূমিকার কথাও জানে। সে কারণেই সতর্ক থাকতে চায়।
সে যা-ই হোক, যে প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এই ব্লাসফেমি আইনটি কী, তার চরিত্রই বা কী? ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল প্রাচীন ও মধ্যযুগে। এখন থেকে এক হাজার ৪৫০ বছর আগে রোমের সামন্ত রাজারা প্রতিক্রিয়াশীল মৌলবাদী খ্রিষ্টান ক্যাথলিক চার্চের যাজকদের সহায়তায় জনগণের ওপর ধর্মের নামে অত্যাচারের হাতিয়ার হিসেবে ‘ব্লাসফেমি’র ব্যবহার শুরু করেছিল। আধুনিক যুগে এসে যখন চার্চ ও রাষ্ট্রকে আলাদা করা হয়, তখন থেকে এ আইনের বিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন দেশের আইনে ধর্মের বিরুদ্ধে কটূক্তি ও আচরণের জন্য আইন থাকলেও তার আর প্রয়োগ সেভাবে নেই।
তবে ইসলামের ১৪০০ বছরের ইতিহাসে ‘ব্লাসফেমি’ আইনের দেখা পাওয়া যায় না। কোরআন বা হাদিসে ‘ব্লাসফেমি’ সম্পর্কে কিছু বলা নেই। পাকিস্তানের প্রখ্যাত ইসলামিক পণ্ডিত জাভেদ আহমদ ঘাদামি বলেছেন, ইসলামের কোথাও ব্লাসফেমি আইনের সমর্থনে কিছু বলা নেই। তবে মুসলিম আইনবিদেরা একে ‘শরিয়ার’ অংশ হিসেবে দেখিয়েছেন।
বাংলাদেশে এই ব্লাসফেমি আইনের ধারণা এসেছে পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ধর্মের বাতাবরণে তাঁর স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের দণ্ডবিধিতে ১৯৮২ সালে ২৯৫খ এবং ১৯৮৬ সালে ২৯৫গ ধারা সংযুক্ত করেন। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানি এ ধারণাটিকে বাংলাদেশে আমদানি করে। পঞ্চম জাতীয় সংসদের জামায়াতের সাংসদ মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশে দণ্ডবিধির ২৯৫খ ও গ ধারাকে পাকিস্তানি এ ধারার অনুসরণে সংশোধন করার প্রস্তাব করে বিল আনেন, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে।
পাকিস্তানে এ আইনের পরিণতি হয়েছে সংখ্যালঘু খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের ওপর এ অভিযোগ তুলে নিপীড়ন। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ও এ আইনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। পাকিস্তানের বিভিন্ন ধর্মগোষ্ঠীর বিরোধের ক্ষেত্রেও এ আইনের প্রয়োগ লক্ষণীয়। আর বাংলাদেশে যেখানে বিভিন্ন পীরের অনুসারীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে, একজন আরেকজনের মতবাদকে ‘বাতেল’ বলে আখ্যায়িত করছেন, তখন এ আইনের ভয়াবহ পরিণতি কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এমনকি যে হেফাজতে ইসলাম জামায়াতের সমর্থনে এ আইন উত্থাপন করেছে, তারাও জামায়াতের মওদুদীবাদী মতবাদকে ‘বাতেল’ বলে অভিহিত করেন। এ ধরনের পরস্পরবিরোধী মতের অনুসারীরা নিজেদের স্বার্থে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?
আসলে এ ধরনের আইন রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের অধিকর্তাদের হাতে জনগণের ওপর নিপীড়নের এক হাতিয়ার তুলে দেবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের নিজেদের মধ্যেও হানাহানি ও সংঘর্ষের কারণ হবে এ আইন।
তার চেয়েও বড় কথা, এ আইন বাংলাদেশকে তার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক ভিত্তিভূমি থেকে সমূলে উৎপাটনের ব্যবস্থা করবে। এ আইন মেনে নিলে বাংলাদেশের জন্য লড়াইয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না। বাংলাদেশের লড়াই নিঃসন্দেহে কোনো ‘মিনি পাকিস্তান’ প্রতিষ্ঠার জন্য ছিল না। বাংলাদেশ তার জন্মসূত্র থেকেই একটি ধর্মনিরপেক্ষ, একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে বাংলাদেশকে তার ওই জন্মসূত্র থেকে উৎপাটনের একের পর এক চেষ্টা চলছে। সাংবিধানিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্মসূত্রের ওই ভিত্তি যে কতখানি দৃঢ়, তার প্রমাণ মিলেছে ২০০৮-এর নির্বাচনে তার সপক্ষে ভোটের রায়ের মধ্য দিয়ে এবং সর্বশেষ শাহবাগ চত্বরে নতুন প্রজন্মের নবজাগরণের মধ্য দিয়ে। ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের দাবি তুলে তার বিরুদ্ধেই আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের জনগণের অভিজ্ঞতায় এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। বায়ান্ন, বাষট্টি, উনসত্তর, একাত্তরে এ ধরনের প্রশ্ন ও আক্রমণকে মোকাবিলা করেই বাংলাদেশ এগিয়েছে। এবারও এগোবে। তবে প্রশ্নটা এবার কিছুটা জটিল। ভোটের রাজনীতি এর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়ায় কিছুটা বিভ্রান্তির সুযোগ রয়েছে এ ক্ষেত্রে। যেটা এখানে স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন তা হলো, ভোট ও ক্ষমতার প্রশ্ন তো থাকছেই, কিন্তু যেটা মূল প্রশ্ন তা হলো বাংলাদেশের অস্তিত্বের। বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকারের। প্রত্যেক মানুষের ধর্ম পালনের অধিকারসহ ধর্মীয় আচরণ ও ধর্মীয় সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের। সর্বোপরি জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বাংলাদেশের।
 রাশেদ খান মেনন: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন