শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

ধর্মের অবমাননাঃ পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের অভিজ্ঞতা

মশিউল আলম
হেফাজতে ইসলাম নামের একটি ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন সম্প্রতি ঢাকায় বিপুল জনসমাবেশ ঘটিয়ে ১৩ দফা দাবি পেশ করে সেগুলো মেনে নেওয়ার জন্য সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছে। সেসব দাবির অন্যতম প্রধানটি হচ্ছে ধর্মের অবমাননার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে সংসদে একটি আইন পাস করতে হবে। তাঁরা যদিও ব্লাসফেমি শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত রয়েছেন, তবু এটা বোঝা মোটেও কঠিন নয় যে তাঁরা যা চাচ্ছেন, তা আসলে ব্লাসফেমি আইন, যেমনটি রয়েছে পাকিস্তানে।

পাকিস্তানের সচেতন সমাজ যখন ব্লাসফেমি আইন থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে, তখন আমাদের দেশে ওই রকম একটি আইন প্রণয়নের দাবি উঠেছে। এখন আমরা দেখে নিতে পারি, পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের অভিজ্ঞতা কী। ব্লাসফেমি আইন নামে পৃথক কোনো আইন পাকিস্তানে নেই। দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারাকে একত্রে বলা হয় ব্লাসফেমি লজ বা ধর্ম অবমাননা-সম্পর্কিত আইনসমূহ। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতবর্ষের দণ্ডবিধিতে ১৮৬০ সালে যুক্ত করা হয়েছিল এ-সম্পর্কিত একটি ধারা (২৯৫)। স্বাধীন পাকিস্তানের দণ্ডবিধিটি সেই সূত্রেই পাওয়া এবং তাতেও ওই ধারা ছিল। ধর্মের অবমাননা, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা ইত্যাদি ধর্মসংক্রান্ত অপরাধের দায়ে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান ছিল ওই ধারায়। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে এ রকম অভিযোগে মামলা হয়েছিল মাত্র ১৪টি। সামরিক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক উগ্র ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীগুলোর আনুকূল্য লাভের প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে দণ্ডবিধির ২৯৫ ধারায় দুটি উপধারা সংযুক্ত করেন। একটিতে কোরআনের অবমাননার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (২৯৫বি), অন্যটিতে মহানবী (সা.)-এর অবমাননার দায়ে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং জরিমানার বিধান করা হয় (২৯৫সি)। এ ছাড়া পাকিস্তানের দণ্ডবিধির ২৯৬, ২৯৭, ২৯৮ (এ, বি ও সি) ধারাতেও ধর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড, জরিমানা এবং একসঙ্গে উভয় রকমের শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এমনকি আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষকে (কাদিয়ানি ও লাহোরি গ্রুপ) নিজেদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মুসলমান বলে দাবি করা, তাঁদের ধর্মবিশ্বাস প্রচার করা, তাঁদের প্রার্থনার স্থানকে ‘মসজিদ’ আখ্যায়িত করার অপরাধেও কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান আছে।
পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডন-এর এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান দণ্ডবিধির উল্লিখিত ধারাগুলোর আওতায় ধর্মসংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে ১৯৮৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মামলা হয়েছে মোট এক হাজার ২৭৪টি। বেশির ভাগ মামলার শিকার হয়েছেন খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। তবে মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেক মানুষও ধর্মের অবমাননার অভিযোগে মামলার শিকার হয়েছেন। অনেক মামলা হয়েছে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধেও। নিম্ন আদালতে কয়েকজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে, তবে উচ্চ আদালতে আপিল করার ফলে কোনো মৃত্যুদণ্ড এখন পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। কিন্তু বিচার-প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই খুন হয়েছেন ব্লাসফেমি মামলার ৪৬ জন আসামি। তাঁদের মধ্যে আছেন পাঁচজন মৌলভি ও পেশ ইমাম, তিনজন শ্রমিক, একজন শিক্ষক ও একজন ব্যবসায়ী। ব্লাসফেমি মামলার অনেক আসামি খুন হয়েছেন খোদ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে। কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন চারজন আসামি, আত্মহত্যা করেছেন একজন। একজন আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত না হওয়ায় তাঁকে খালাস দেওয়ার পর হত্যা করা হয়েছে সেই আদালতের বিচারককে। আর ব্লাসফেমি আইনের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং ব্লাসফেমি মামলার আসামিকে সহযোগিতা করার জন্য হত্যার শিকার হয়েছেন পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসির ও সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টি। গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যা করেছেন তাঁরই দেহরক্ষী দলের একজন সদস্য। পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেত্রী, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য শেরি রেহমান সংসদে ব্লাসফেমি আইন সংশোধন করার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্লাসফেমি আইনে মামলা করা হয়েছে। তাঁকে হত্যা করারও হুমকি দিয়েছে ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলো। পাকিস্তান সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের ব্যাপক অপব্যবহারের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, গোষ্ঠীগত, পেশাগত ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ ও শত্রুতা। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতভিটা ও দোকানপাট থেকে উৎখাত করার একটা হাতিয়ার হিসেবে ধর্মের অবমাননার অভিযোগ তোলা সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সংক্ষেপে কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলে দেশটিতে এ আইনের অপব্যবহারের ব্যাপকতা সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যাবে।
পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রকৌশলী ছিলেন তাহির ইকবাল, যিনি ইসলাম থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছিলেন। পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে তিনি লাহোরে একটি মসজিদের পাশে বাস করতেন এবং শিশুদের প্রাইভেট পড়াতেন। একদিন সেই মসজিদের ইমাম অভিযোগ তোলেন যে তিনি আজানের সময় মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে তিনি শিশুদের ইসলামবিরোধী শিক্ষা দিচ্ছেন। এসব অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে ওই ইমাম একটি মামলা দায়ের করেন। তাঁকে গ্রেপ্তার করে দায়রা জজ আদালতে নেওয়া হলে বিচারক তাঁর জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন এই বলে, ‘যেহেতু ইসলাম থেকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়াই একটি গুরুতর পরিণতিসম্পন্ন আমলযোগ্য অপরাধ, তাই আমার বিবেচনায় আসামি এ পর্যায়ে জামিন পেতে পারেন না।’ কিন্তু পাকিস্তানের দণ্ডবিধি অনুযায়ী ধর্মান্তরিত হওয়া কোনো অপরাধ নয়। একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা তাহির ইকবালের স্বাস্থ্যগত সমস্যা আছে বলে সাক্ষ্যপত্র দেওয়ার পরও ওই বিচারকের আদেশের কোনো নড়চড় হয়নি। ১৯৯০ সালে তাহির ইকবালকে গ্রেপ্তার করা হয়, কারাবন্দী অবস্থায় ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে তিনি মারা যান। অভিযোগ ওঠে, তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৯১ সালে করাচিতে চান্দ বরকত নামের ২৮ বছর বয়সী এক চুড়িবিক্রেতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবমাননার অভিযোগে মামলা করেন আরিফ হুসেইন নামের আরেক চুড়িবিক্রেতা। বরকতকে গ্রেপ্তার করা হয়। ছয়জন মুসলমান আদালতে সাক্ষ্য দেন যে বরকত ইসলামের অবমাননা করেছেন এমন কিছু তাঁরা দেখেননি। কিন্তু বিচারক বরকতের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাঁকে জেলে পাঠিয়ে দেন। ১৫ মাস জেল খাটার পর বরকত ১৯৯৩ সালে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে জেল থেকে খালাস পান। কিন্তু মুসলমান প্রতিবেশীরা তাঁকে হত্যা করার হুমকি দিলে তিনি করাচি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
১৯৯১ সালে ফয়সালাবাদে গুল মসিহ নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে রাস্তার পানির ট্যাপ মেরামত করা নিয়ে ঝগড়া হয় প্রতিবেশী সাজ্জাদ হুসেইনের। তারপর সাজ্জাদ গুল মসিহর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন, গুল মসিহ মহানবী (সা.) ও তাঁর পত্নীদের সম্পর্কে অবমাননাসূচক কথা বলেছেন। পুলিশ এসে গুল মসিহ ও তাঁর ভাই বশির মসিহকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। বশিরের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায় থানা থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গুলকে আদালতে নেওয়া হয়, সেখানে তিনজন সাক্ষীর মধ্যে শুধু অভিযোগকারী সাজ্জাদই গুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। অন্য দুজন সাক্ষী বলেন, গুল মহানবী (সা.) ও তাঁর পত্নীদের অবমাননা করেছেন এমন কিছু তাঁরা দেখেননি বা শোনেননি। কিন্তু বিচারক তালিব হুসেইন বালুচ ১৯৯২ সালে গুলকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বিচারক বালুচ তাঁর রায়ে বলেন, ‘যেহেতু সাজ্জাদ হুসেইন (অভিযোগকারী) ২১ বছর বয়সী একজন যুবক, বিএ ক্লাসের একজন ছাত্র এবং দাড়িওয়ালা, সুদর্শন একজন প্রকৃত মুসলমান, তাই আমি তাঁর কথা অবিশ্বাস করার কোনো কারণ দেখি না।’ গুল মসিহর এই মৃত্যুদণ্ডের রায়ই পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনে কোনো মামলার প্রথম মৃত্যুদণ্ডের রায়। অবশ্য উচ্চতর আদালতে গুল শেষ পর্যন্ত নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে খালাস পান, কিন্তু তিনি আর পাকিস্তানে থাকতে পারেননি। তিনি জার্মানি চলে যান। আর তাঁর ভাই বশির মসিহ ওই ঘটনার পর থেকে কোনো কর্মসংস্থান জোগাড় করতে পারেননি।
ফয়সালাবাদের ৪৩ বছর বয়সী নিয়ামত আহমার একজন শিক্ষক, যিনি খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। তাঁর পেশাগত সাফল্যে তাঁর কয়েকজন মুসলমান সহকর্মী এতটাই ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠেন যে তাঁরা ফারুক আহমেদ নামের এক ছাত্রকে বোঝান, নিয়ামত মহানবী (সা.)-এর অবমাননা করেছেন, তাঁকে হত্যা করতে হবে। স্বধর্মের শিক্ষকদের কথায় বিশ্বাস করে তরুণ ফারুক তাঁর বিধর্মী শিক্ষক নিয়ামতকে উপর্যুপরি ছুরি মেরে হত্যা করেন। ফারুকের ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়, কারাগারের ভেতরে সবাই তাঁর বেশ তারিফ করে বলে খবর পাওয়া যায়।
এটি ১৯৯২ সালের ঘটনা। একই বছর বান্টু মসিহ (৮০) ও মুখতার মসিহ (৫০) নামের দুই ব্যক্তিকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে লাহোরের পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। থানায় পুলিশের সামনেই বান্টু মসিহকে আটবার ছুরি মারেন এক ব্যক্তি। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যায় পুলিশ। সেখানে তারা বান্টুকে বলে, তাঁকে যে ব্যক্তি ছুরি মেরেছে, তিনি যদি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা না করেন, তাহলে ব্লাসফেমির মামলা থেকে তাঁকে বাঁচিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু বান্টু মসিহ হাসপাতালেই মারা যান। আর মুখতার মসিহকে থানায় পুলিশ নির্যাতন করে হত্যা করে।
পাকিস্তানের ডন, ডেইলি টাইমস, দ্য হেরাল্ড, দ্য নিউজ ইন্টারন্যাশনাল প্রভৃতি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্র, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ক্রিশ্চিয়ান সলিডারিটি ওয়ার্ল্ডওয়াইডের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণা সমীক্ষার সূত্রে পাওয়া যায় এ রকম আরও অনেক রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ। আগামীকালের লেখায় সে রকম কিছু ঘটনা তুলে ধরা হবে।
 মশিউল আলম: সাংবাদিক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন