শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

রুখে দিতে হবে রাষ্ট্রশক্তিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা

ফকির ইলিয়াস
অনেক তো দেখা হলো। আর কতো দেখবে এ সরকার? একাত্তরের পরাজিত শক্তির একটি অংশই আজ মাঠে তৎপর। ঢাকায় যে লোক সমাগম হয়েছে, এর সংখ্যা কতো? এক লাখ, দেড় লাখ? বাংলাদেশের লোকসংখ্যা প্রায় ষোলো কোটি। তাই এই সমাগম নিয়ে যারা তালিয়া বাজাচ্ছে, তাদের আহ্লাদে আটখানা হবার কোনো কারণ নেই। বিএনপি মনে করেছিল, হেফাজতে ইসলামের সমর্থকরা ঢাকায় দীর্ঘ অবস্থান নেবে। না, তারা নেয়নি। আর সে জন্যই মনঃক্ষুণœ হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। বিএনপি অফিসে নাকি শুকনো খাবার আর জল-পানির ও ব্যবস্থা ছিল অঢেল।
ওগুলো আর কোনো কাজে লাগবে না ভেবে অখুশি বিএনপির নেতারা। একটা কথা বলি, লাখ লাখ মানুষ ঢাকায় এনে সমাগম বিএনপিও করতে পারবে। আওয়ামী লীগও করতে পারবে। এতে দেশের মৌলিক সমস্যার সমাধান হবে না। জামাত খুশি অন্য কারণে। একটা গোলযোগ হলেই তারা মধ্যস্বত্ব ভোগ করবে। জামাত এভাবেই এগিয়েছে এই দেশে। হয় আওয়ামী লীগের কাঁধে সওয়ার হয়ে, না হয় বিএনপির কাঁধে ভর করে।

আজ এভাবেই তারা হেফাজতের ওপর ভর করতে চাইছে। কোনোভাবে যদি হেফাজতকে দিয়ে ওদের পারপাস সার্ভ করা যায়। আজ হেফাজত যা বলছে, তা তো জামাতেরই এজেন্ডা। নারী নেতৃত্ব হারাম ওরাই তো বলেছিল। তার পরও তারা এদেশের দুই প্রধান দলনেত্রীর সঙ্গে সভা-সমাবেশ করেছে। পাশাপাশি বসে ফটো সেশন করেছে। এটাই মওদুদীবাদী তরিকার রাজনীতি। সুবিধাবাদ- জিন্দাবাদ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, দেশে ব্লাসফেমি আইন হবে না। নতুন কোনো আইন হবে না। যে আইন আছে, তা শুদ্ধিকরণ করা হবে। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা ব্লাসফেমি আইনের আদলে নতুন কোনো আইন প্রণয়নের হেফাজতে ইসলামের দাবি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ প্রচলিত অনেক আইনেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেছেন, হেফাজতে ইসলামের দাবিগুলোর মধ্যে কিছু গ্রহণযোগ্য হলে, তা গ্রহণ করবো। আর যেগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না, সেগুলো গ্রহণ করবো না।’

ঐ সাক্ষাৎকারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ব্লগ এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে কে কী লিখছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার বিষয়ে কিছু আছে কিনা, সেসব খতিয়ে দেখতে সরকার আগেই একটি তদন্ত কমিটি করেছিল। সেই প্রক্রিয়াতেই গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বলছিলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার মতো কোনো কথা যদি লেখায় থাকে, অবশ্যই আমাদের তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা খুব স্বাভাবিক। আমি একজন মুসলমান। এখন নবী করিম সাঃ সম্পর্কে কেউ যদি আজেবাজে কথা লেখে, আমরা তো চুপ করে বসে থাকতে পারি না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেউ হয়তো ধর্ম না মানতে পারে, তার মানে এই না যে তারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথা বলবে। নোংরা কথা লিখবে। প্রধানমন্ত্রীর এই কথাগুলো খুবই যৌক্তিক। কিন্তু কিছু ঘোলা জলে মাছ শিকারি যদি আজেবাজে নিক নামে ব্লগ, ফেসবুক লিখে দোষ অন্যের ওপর চাপাতে চায়, তা কিভাবে মোকাবেলা করবে সরকার? দেশে সাইবার ক্রাইম ইউনিট কতোটা সুসংহত? আমরাও সকল অপপ্রচারকারীর শাস্তি চাই। কিন্তু তা হতে হবে ন্যায়ভিত্তিক।

দোষ যত্রতত্র চাপিয়ে পুরো দেশের অনলাইন মিডিয়াকেই সাধারণ মানুষের কাছে বিরূপ ধারণা দেয়া হচ্ছে। ব্লগার শব্দের অর্থই যারা জানে না, তারাই মাঠে নেমেছে ব্লগারদের হরেদরে ‘নাস্তিক’ ফতোয়া দিয়ে। এটার কোনো অর্থ হতে পারে?

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন হেফাজত নেতারা। তারা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, বিদ্যমান আইনে নয়, ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে ইসলামে যে ধরনের সাজার বিধান রয়েছে সে অনুযায়ী সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

হেফাজতের ১৩ দফা দাবিকে ‘মধ্যযুগীয়’ বলে আখ্যায়িত করে সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যেরও প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজত। তারা বলেছেনÑ শরিয়ত মানলে সমাজে শান্তি আসবে, নিরাপত্তা আসবে। এখানে ‘মধ্যযুগী’য় কথাটার কী অর্থ তা আমরা বুঝতে পারছি না। কথা হচ্ছে, দেশ কী সংবিধান অনুযায়ী চলছে- নাকি শরিয়া আইনে চলছে? কই, এসব নেতারা তো একাত্তরের ঘাতক-দালাল-রাজাকারদের বিচার শরিয়া আইনে করার কথা কখনো বলেননি? কেন বলেননি? বিষয় সেটা নয়। মূল বিষয় হচ্ছে, হেফাজত বাংলাদেশে একটা গোলযোগ বাধাতে চাইছে। হেফাজত যে দাবিগুলো করেছে তার মাঝে কিছু বিষয় আছে দেশের শিল্প-সাহিত্য-সমাজ-ঐতিহ্য-কৃষ্টি বিরোধী। একটি দাবি হচ্ছে- ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা। নারীনীতি বাদ দেয়ার কথা জঙ্গিবাদীরাও বলেছিল, পার্থক্য কোথায়? হরকাতুল জিহাদ কিংবা হিযবুত তাহরীররা তো এরকম দাবিই করে আসছে অনেকদিন থেকে।

আরেকটি দাবি হচ্ছে- সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা। আমরা জানি পাকিস্তানে তথাকথিত গণতন্ত্রী নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা করেছিলেন। জঙ্গিরা ম“ পায় সেই সময় থেকেই। বাংলাদেশে সেটা করা হলে দেশের ভবিষ্যৎ কী হবে তা মহাজোট সরকারকে ভাবতে হবে। আরেকটি দাবি হচ্ছে- মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।

এর অর্থ হলো এই দেশে কোনো ভাস্কর্য থাকবে না। তার মানে মহান মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতি যেন প্রজন্ম প্রতিদিন দেখতে না পারে। তাহলে মতলবটা কী? হেফাজত আর জঙ্গি মৌলবাদের সমীকরণ তো মিলে যাচ্ছে। সরকার কি তা টের পাচ্ছে? আরেকটি দাবি হচ্ছে- রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিচয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা। এই দাবির মাধ্যমে তারা কার্টুন আঁকা, সিনেমা, টিভি নাটক, পথনাটক-সহ সকল প্রকার সৃজনশীল সংস্কৃতি চর্চা ও সাহিত্যের ওপরই বাধানিষেধ আরোপের কথা বলেছে। তা হলে তো সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর ‘লালসালু’ কিংবা এই সময়ের ইমদাদুল হক মিলনের ‘নুরজাহান’ উপন্যাস বাজারেই থাকতে পারে না। আমরা দেখছি, মিলনের ‘নুরজাহান’ উপন্যাসের নাট্যরূপ প্রচারিত হচ্ছে চ্যানেল আই-এ। তাহলে কি শিল্পীর স্বাধীনতা, শিল্পের স্বাধীনতা রহিত হয়ে যায়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্তমাখা আর দুলাখ নারীর সম্ভ্রমে আঁকা বাংলাদেশে? নারীরা কাজ করতে পারবে না। গার্মেন্টস শ্রম গোল্লায় যাক। এটাই হেফাজতের দাবিনামা। তা মানতে হবে সরকারকে?

আমি বিশ্বাস করি, এসব দাবি বিএনপিও মানবে না। ক্ষমতায় যাবার জন্য ও তারেক-কোকোকে দেশে আনার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার হেফাজতের সমর্থন দরকার। তবে তাদের দাবি ঝুলিয়ে রাখবে বিএনপিও। কারণ দাবি মানলে বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্ব থাকবে না। অবশ্য বেগম জিয়া আগামীতে বাংলাদেশে পুরুষ প্রধানমন্ত্রী (তারেক রহমানকে) দেখতে চাইছেন। তাই তার হিসাব ভিন্ন থাকতেই পারে। হেফাজতের চরিত্র কেমন তা ৬ এপ্রিল দেশবাসী দেখেছেন। তারা টিভি সাংবাদিক নাদিয়া শারমিনকে নির্মমভাবে নির্যাতিত করেছে। আরো কয়েকজন সাংবাদিক তাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন। এরপরে হেফাজত নেতারা ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে প্রকারান্তরে আক্রমণের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। এটাই হলো ওদের জঙ্গিবাদী আচরণের নমুনা মাত্র। আজ সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই প্রজন্ম এসব মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে মেনে নেবে কিনা।

আসল কথা হচ্ছে, ইসলামের নামে দেশে যারা আন্দোলন করতে চাইছে তারা দেশের সংবিধান মানছে না। তারা এটাকে ‘তাগুদি আইন’ আগেও বলেছে। এখনো সেটাই বলতে চাইছে প্রকারান্তরে। তারা রাষ্ট্রশক্তিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে চাইছে। তারা স্টোনটেস্ট করছে। ক্রমশ পার পেয়ে গেলেই সরকারের টুঁটি চেপে ধরবে। জানিয়ে রাখা দরকার, আওয়ামী লীগ যদি ভোটের রাজনীতির জন্য এই ধর্মীয় উন্মাদনাবাদীদের পাল্লায় পড়েÑ তবে তারা ভুল করবে। কারণ এরা মূলত ভোট কাদের দেয় তা শেখ হাসিনার অজানা নয়। তারপরও ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ খেলতে গিয়ে যেমন জয়ী হওয়া যাবে না তেমনি বিরোধী দলের সব শীর্ষ নেতাকে মামলায় জড়িয়েও নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়া যাবে না। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী একটি সমাবেশে বলেছেন, আপনারা আপনাদের কর্মসূচি থেকে আমাদের গালিগালাজ করলেন। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আপনাদের কিছুই বলিনি। কিন্তু আপনারা তো একবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইলেন না। একবারও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে কিছু বললেন না। কেসটা কি?

হ্যাঁ, এটাই মূল বিষয়। ওরা ‘শাহবাগী শাহবাগী’ বলে মুখে ফেনা তুলছে। কিন্তু রাজাকারদের বিচারের ব্যাপারে কিছুই বলছে না। কারণটা কি? কেন তারা ১৩ দফা দাবির একটি করলো না – যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি? লেখাটির শেষ দিকে এসে একটি বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার মনে করি। বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র ওমরাহ পালন করেছেন। সেখানে এক ভোজসভায় বক্তব্যও দিয়েছেন তারেক রহমান। তিনি বলেছেন, পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমার এবং জিয়া পরিবারের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে দেশ ও মানুষের স্বার্থে তা বুকের গভীরে চেপে রেখেছি। আমি বিশ্বাস করি, নেতাকর্মীদেরও দেশের স্বার্থে সেই যন্ত্রণা বুকে চেপে রাখার শক্তি আছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তারেক রহমান বলেন, বিগত ৪০-৪২ বছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এমন অবনতি দেখা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি গুলি করে মানুষ মারছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা তাদের রিপোর্টে এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে দেশের মানুষের মতো বিদেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আতঙ্কিত।

তারেক রহমান কি ভুলে গেছেন শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকা-ের কথা? তিনি কি খোঁজ রেখেছেন আসমা কিবরিয়ার? তিনি কি জানেন আহসান উল্লাহ মাস্টারের পরিবার কী শোক বুকে নিয়ে জীবন কাটাচ্ছে? তারেক কি ভুলে গেছেন- ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার কথা? তিনি কি ভুলে গেছেন, কিভাবে আইভি রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল? এভাবে অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। দেশ এখন একটি কালোশক্তির খপ্পরে। এই শক্তি রাষ্ট্রশক্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। যা কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না। এজন্য দেশের সকল মুক্তমনা-দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে, এই দেশটিকেও তালেবানের তাঁবেদারিত্ব বরণ করতে হতে পারে।

ফকির ইলিয়াস : কবি ও সাংবাদিক।
ভোরের কাগজ : শনিবার, ১৩ এপ্রিল ২০১৩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন