শনিবার, ১৩ এপ্রিল, ২০১৩

মেকি জাগরণ বনাম প্রকৃত গণজাগরণ

সাদেক খান
রাষ্ট্রের দমন ক্ষমতার স্টিম রোলার দিয়ে নির্বিচার মামলা-হামলা এবং মিডিয়ার বাধ্যতার নানা ফাঁদ এঁটে প্রচার ডংকায় সমন্বিত বিরোধী শক্তিগুলোর কণ্ঠরোধের কৌশলকেই গদি রক্ষার উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে টলটলায়মান হাসিনা সরকার। সরকারপক্ষীয় নেতানেত্রীদের চড়া সুরের গলাবাজিতে শ্রোতারা অনেকেই বুঝে উঠতে পারেন না, ক্ষমতাসীন জোটের আত্দবিশ্বাসের ইমারত কীভাবে ভিত ধসে কাঁপতে শুরু করেছে। তবে প্রশাসনের অভ্যন্তরে কর্তাব্যক্তিরা আর ওয়াকেবহাল মহল সেই কাঁপুনি জ্বরে ঠিকই ঘামতে শুরু করেছে। একটা লক্ষণ (ঢাকার একটি জনপ্রিয় দৈনিকের প্রতিবেদক নূরুজ্জামানের ৬ এপ্রিল প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে সারাংশ) : উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অনিশ্চিত অবস্থায় বিদেশ সফরের হিড়িক পড়েছে ভিআইপিদের।
বিশেষ করে সরকারের সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতা, সচিব, পুলিশ কর্মকর্তা ও হাই প্রোফাইলের লোকজনই বেশি আছেন দেশের বাইরে। ভিআইপিরা বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে অর্থও পাচার করছেন। অনেকে নিজেরা যাচ্ছেন না, অধীনস্থ কর্মকর্তা বা আপনজনদের মাধ্যমে টাকা পাচার করছেন। দেশ যতই সংকটের দিকে যাচ্ছে, ততই দেশের হাই প্রোফাইলের লোকজনের বাইরে যাওয়ার ভিড় বাড়ছে। এ তালিকায় রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা, সচিব, বিভিন্ন মন্ত্রীর পিএস, এপিএস ও পুলিশ কর্মকর্তা। এ ছাড়া দেশ ছেড়ে বাইরে পাড়ি জমাচ্ছেন রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মী। ইমিগ্রেশন পুলিশ জানায়, গত প্রায় এক মাস ধরে অস্বাভাকি হারে উপরওয়ালা লোকজন দেশ ছাড়ছেন। ভিজিট ও বিজনেস ভিসাসহ বিভিন্ন ধরনের ভিসা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন। যাওয়ার সময় কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন বাদে অনেকেই খালি হাতে ফিরে এসেছেন। ইমিগ্রেশন পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, 'সম্প্রতি কয়েক দফায় ওই রকম সন্দেহভাজনদের আটক করায় শোকজ করা হয়েছে আমাকে। কেন আটক করেছি জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস সাইফুজ্জামান শিখরের খালাতো ভাই শওকত মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে দেশের বাইরে গেছেন। কিছুদিন পরেই তিনি ফিরে আসেন। এর কয়েক দিন পর প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের আমেরিকা প্রবাসী কন্যা দেশে আসেন। কয়েক দিন অবস্থান করে যখন ফিরে যান তখন তার কাছে থাকা দুটি ব্যাগে অঘোষিত মোটা অঙ্কের কারেন্সি নোট ছিল সন্দেহ করে তল্লাশির চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু উল্টো কেন তল্লাশির চেষ্টা করা হয়েছিল তা জানতে চেয়ে একজন কর্মকর্তাকে শোকজ করা হয়।' প্রতিদিন গড়ে প্রায় প্রায় ৫০০ ব্যক্তি ভিজিট ভিসায় বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন। এভাবে গত তিন সপ্তাহে প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশি শুধু মালয়েশিয়ায়ই গেছেন বলে তথ্য রয়েছে। এর বাইরে প্রতিদিনই থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ইউরোপীয় দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকেই। দেশত্যাগীদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে প্রতিদিনই বিভিন্ন মন্ত্রীর ফোন আসে ইমিগ্রেশন শাখায়। তাদের কথা_ যিনি যাচ্ছেন তিনি মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। কোনোভাবেই লাগেজ বা হ্যান্ড ব্যাগ চেক করার নামে তাকে যেন হয়রানি না করা হয়। বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর হামলাকারী এক পুলিশ কর্মকর্তা একাধিকবার বাইরে গেছেন। প্রতিবারই তার প্রবাসী স্ত্রীর কাছে তিনি অর্থ রেখে আসেন বলে ইমিগ্রেশনের সন্দেহ।

এদিকে জনজীবনে চলছে প্রায় টানা তিন মাস ধরে অস্থিরতা, রক্তাক্ত সংঘাত আর সরকারি বা বিরোধি দল উভয়পক্ষে রাজপথ দখল হরতাল অবরোধের পালা। বিগত কর্ম সপ্তাহ পুরোটা কেটেছে দেশব্যাপী হরতালের মধ্য দিয়ে। আর কোনো না কোনো মফস্বল শহরে, জেলা বা বিভাগজুড়ে পুলিশের গণহত্যা বা গণগ্রেফতারের প্রতিবাদে দুই মাসভর হরতালের হিড়িক তো লেগেই ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য লাটে ওঠার উপক্রম। সরকারের ঋণের চাহিদা মেটাতে ব্যাংকিং ব্যবস্থা কানা হয়ে বসে আছে। উপরতলার পুকুরচুরি শেয়ার কেলেঙ্কারি, মোটা কমিশন, আর মাঠপর্যায়ে চাঁদাবাজি, দখলবাণিজ্য, ধর্ষণ-অপহরণ, চপেট-দাপটের কথা না হয় না-ই তুললাম। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে জামায়াত-শিবির পেটানো আর রাজাকারের ফাঁসির আওয়াজ তুলে শাহবাগে সরকারপক্ষের আয়েশী নতুন প্রজন্মের যে হুজুগ সৃষ্টির আয়োজন হয়েছিল, একটা হিসাবের ভুলে উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতার বাড়াবাড়ি আর মহানবীর অবমাননার ব্লগ-কারিগরির পরিণতিতে সেটা বুমেরাং হয়ে সরকারকেই আঘাত হেনেছে। পুলিশের নিরাপত্তাবেষ্টনীর ছত্রছায়ায় সরকারি মহলের অর্থসহায়তাপুষ্ট শাহবাগের মেকি গণজাগরণের প্রতিক্রিয়ায় দেশব্যাপী ধিক্কার আর লোকজ মূল্যবোধের যে উন্মেষ ঘটেছে, হেফাজতে ইসলামের ডাকে সরলপ্রাণ দেশবাসীর ধর্মবুদ্ধির আবেদন ও সামাজিক একতা গড়ে ওঠে সেটা একটা প্রকৃত গণজাগরণ ঘটিয়েছে। ৬ এপ্রিল সবরকম সরকারি বাধা ও আধা সরকারি হরতাল উপেক্ষা করে ঢাকায় হেফাজতের লংমার্চ ও ১০ লক্ষাধিক পদাতিকের মহাসমাবেশ রাজধানীর অভিজন সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, সত্যিকার গণজাগরণ কাকে বলে।

এ সম্পর্কে পূর্বোক্ত জনপ্রিয় দৈনিকেরই ৯ এপ্রিল সংখ্যায় একটি সংবাদভাষ্যে অমিত রহমান লিখেছেন :

'হেফাজতের লংমার্চ নতুন এক বার্তা নিয়ে এসেছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বিদেশি সংবাদ মাধ্যমও হেফাজতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের কৌতূহল, এটা কি নয়া কোনো ইসলামী বিপ্লবের ইঙ্গিত দিচ্ছে? এ নিয়ে চটজলদি কোনো উত্তর হয়তো এখনই পাওয়া যাবে না। তবে ভণ্ড আর লুটের রাজনীতির খেলা বন্ধ না হলে মানুষ সেদিকে ঝুঁকতে পারে এমনটা বলা যায় অনায়াসে। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে ধর্ম আফিমের কাজ করে। দেশে দেশে আমরা তা-ই দেখে এসেছি। প্রায় দুই মাস আগে একটি লেখায় ইঙ্গিত করেছিলাম তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব ইসলামী ব্রাদারহুডকে ক্ষমতায় এনেছে। বাংলাদেশে শাহবাগ গণজাগরণ কাকে ক্ষমতায় আনবে? এখন তো কিছুটা খোলাসা হয়ে গেছে কোন দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ।'

'ব্লগার ইস্যু হেফাজতকে সামনে এনেছে। মাত্র তিন বছর আগে এই সংগঠনটি জনসমক্ষে এসেছে। এর সঙ্গে জড়িত অনেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে ৯৩ বছর বয়সী আল্লামা আহমদ শাহ শফী কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। মাদ্রাসার ছাত্র আর আলেমদের মধ্যে তার কী যে প্রভাব রয়েছে তা লংমার্চ দেখলেই বোঝা যায়। শত ইন্ধন আর প্রলোভনের মধ্যেও তিনি হঠকারিতাকে বেছে নেননি। তার ওপর চাপ ছিল ১৩ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বরে বিপ্লবের সূচনা করতে। সতীর্থদের তিনি বলেছেন, সরকারকে সময় দিতে হবে।'

সবুর বা ধৈর্য সহকারে সরকারকে এক মাসের সময় দিয়ে ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের সর্বোচ্চ শাস্তি, সংবিধানে 'আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস' এই শিরোনামের পুনঃস্থাপন ইত্যাদি দাবি পূরণ না হলে ৫ মে আর লংমার্চ নয়, সরাসরি অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। একইসঙ্গে এই সরকারকে ৬ এপ্রিলের মহাসমাবেশ থেকেই ইসলাম অবমাননার দায়ে ক্ষমতায় থাকার অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে, আর মাসব্যাপী মফস্বলের বিভিন্ন শহরে কার্যত 'সরকার-হটাও'-এর নিয়ত নিয়েই একের পর এক সমাবেশের ধৈর্যশীল কর্মসূচি হাতে নিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

কিন্তু ক্ষমতাসীনরা ধৈর্য ধরতে পারেনি। হেফাজত ঠাণ্ডা হয়েছে ভেবে এই ফাঁকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির গোটা নেতৃত্বকেই হরতালে সহিংসতার জন্য হুকুমের আসামি বলে বিনা জামিনে জেলে পুরলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আর ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিকেও আকস্মিক গ্রেফতার করে নির্যাতনমূলক রিমান্ডে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। অবশ্যম্ভাবী ফল : সরকারকে সময়ের ছাড় দিয়ে হলেও লংমার্চে বাধা দেওয়ার কারণে হেফাজতের ডাকা এক দিনের হরতালের লাগোয়া পুরো কর্মসপ্তাহই কাটল ৩৬ ঘণ্টা ১৮-দলীয় জোটের, আরও এক দিন শিবিরের হরতালের অচলাবস্থায়।

পূর্বোক্ত সংবাদভাষ্যে অমিত রহমান উপসংহারে লিখেছিলেন : একটি প্রশ্ন শেখ হাসিনাকে এই লেখার মাধ্যমে করতে চাই, তিনি কি কখনো সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চনের 'কৌন বনেগা ক্রোড়পতি' দেখেছেন? আমন্ত্রিত অতিথি প্রশ্নের জবাব না দিতে পারলে তিনি দর্শক কিংবা অন্য কোনো বিশেষজ্ঞের সহযোগিতা নিতে পারেন। এখানে দর্শক হচ্ছেন জনগণ। জনগণ কী চায় তা তো প্রধানমন্ত্রী জানেন। চার দেয়ালে বন্দী হয়ে গেলে অবশ্য অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। বাস্তবতা উপেক্ষিত হয় বার বার। ওয়ান-ইলেভেনের নায়করা মাইনাস টু করতে চেয়েছিলেন। পারেননি নানা কারণে। এখন তো দেখা যাচ্ছে দুজনই মাইনাস হয়ে যাচ্ছেন রাজনীতির কূটকৌশলে।

দেশে দেশে আমরা দেখতে পাই সুশাসন যখন বিদায় নেয়, তখন কুশাসন ভর করে। বিনয়ের মুখ তখন বদলে যায় ঔদ্ধত্যের রক্তচক্ষুতে। তখন শাসকগোষ্ঠী মানুষের আস্থা হারায়।

প্রায় একই ধরনের মন্তব্য করেছিলেন মিসরের 'আরব বসন্তের জাগরণ' উপলক্ষে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বলেছিলেন_ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেই সরকার বৈধ বিবেচিত হয় না। বৈধতার জন্য সরকারকে জনগণের আস্থা বজায় রেখে চলতে হয়। জনগণের আস্থা হারালে নির্বাচিত সরকারও অবৈধ বলে গণ্য হয়। ক্ষমতাসীনরা এ কথা ভুলে গেলে খেসারত দিয়ে কূল পাবেন না।

লেখক : বিশিষ্ট্য সাংবাদিক

উৎসঃ   বাংলাদেশ প্রতিদিন

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন