মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

হেফাজতের ১৩ দফা ও একটি ইসলামী শাসনতন্ত্রের বাংলাদেশ

পলাশ চৌধুরী
হেফাজতের দাবিগুলো পড়লে মনে হয়, সরকার যদি এ দাবিগুলো মেনে নেয়, তাহলে একটি স্বাধীন সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের কোনো আিস্তত্ব থাকে না। হেফাজত প্রথমে আন্দোলন শুরু করেছিল তথাকথিত শাহবাগের ব্লগার বা নাস্তিকদের ফাঁসির দাবিতে। কিন্তু গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় তারা লং মার্চ সমাবেশ শেষ করেছে সরকারদলীয় প্রধানমন্ত্রীসহ কয়েকজন নেতার বিচার ও ঘাতক-দালাল নিমূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের ফাঁসির মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ বিষয়টি খুব সহজেই অনুমেয় হয় যে, হেফাজত প্রকৃত অর্থে ধর্ম রক্ষায় মাঠে নামেনি, সরকার পতনের উদ্দেশ্যই তারা মাঠে নেমেছে।
হেফাজতের ঢাকা অভিমুখী ৬ এপ্রিলের লং মার্চকে রুখতে ২৪ ঘণ্টার হরতালের ডাক দিয়েছিল ঘাতক-দালাল নিমূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটসহ সমমনা ২৭টি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। এদিন হেফাজতের কর্মীরা ঢাকার পল্টনে সমাবেশ করে আর হরতালকারীরা শাহবাগসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে সমাবেশবিরোধী মিছিল করে। প্রকৃত বিষয় হচ্ছে- জামায়াতের ইন্ধনে হেফাজতের নেতা কর্মীরা সেদিন একটি বড় ধরণের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সরকারের ঘাড়ে দোষ চাপাতে তৎপর ছিল। যদিও একদমই শান্তিপূর্ণভাবে হেফাজতের সমাবেশ শেষ হয়নি। বিভিন্নভাবে পুলিশকে উসকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। পল্টনে হেফাজতের সমাবেশ স্থলে কয়েকজন উচ্ছৃঙ্খল হেফাজত কর্মী বঙ্গবন্ধুর ব্যানার ভাংচুর করে। নির্লজ্জভাবে মারধর করা হলো কয়েকজন নারী সাংবাদিককে। মুহূর্মুহূ সেøাগান দেয়া হয় সরকারের একজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে। সবিনয়ে হেফাজত কর্মীদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, ইসলাম কি এ উচ্ছৃঙ্খলতা সমর্থন করে? পরদিন অবশ্য হেফাজতের নেতারা নারী সাংবাদিককে মারধরের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন। সাথে এও বলেছেন, সেদিন সরকারদলীয় লোকজন তাদের সমাবেশে মিশে গিয়ে নারী সাংবাদিককে মারধর করেছে। এখন প্রশ্ন হলো- সরকারদলীয় লোকজন ওই নারী সাংবাদিককে মারধর করলো আর হেফাজতের কর্মীরা তা চেয়ে চেয়ে দেখলো? একবার বাধাও দিতে পারলো না? দেশের মানুষকে এভাবেই তারা বোকা বানাতে চান!

মজার ব্যাপার হলোÑ হেফাজতের যে নেতা কর্মীরা তথাকথিত ইসলাম রক্ষায় মাঠে নেমেছেন, তাদের ব্লগ ও ব্লগার সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। ব্লগ ও ব্লগার কি তাই তারা জানেন না! অনেকে শুধু শুনেই সমাবেশে এসেছেন শাহবাগের কথিত ব্লগাররা নাস্তিক। কেউ ব্লগ পড়েও দেখেননি। সেখানে কি লেখা আছে সেটা ভিন্ন কথা! দেশের কতোটি মাদ্রাসায় ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ! তবে সংখ্যায় যে খুব নগণ্য হবে তা সহজেয় অনুমেয়। তাই ব্লগে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করা হচ্ছে- এসব তথ্য তারা কোথা থেকে পেলেন? বলে রাখা প্রয়োজন, জামায়াত-শিবিরের বহুসংখ্যক নেতাকর্মী ব্লগ ও ইন্টারনেট ব্যবহার করেন এবং তাদের বিভিন্ন অপপ্রচারকে মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। অর্থাৎ সরকারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার বিপুল সংখ্যক হেফাজত কর্মীদের সংগঠিত করার পেছনে জামায়াতের অবদান কতোটুকু রয়েছে। হেফাজতের নেতারা অর্থের বিনিময়ে এমন একটি লংমার্চ করলেন- এমন অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়টিও তদন্ত করে দেখা দরকার।

একে একে মানবতােিবরাধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের অভিযোগ প্রমাণিত হচ্ছে তখন সুকৌশলে সেটাকে বাধাগ্রস্ত করতেই জামায়াতের এই কূটকৌশল। বিগত কয়েক মাসের ধ্বংসাত্মক কর্মকা- নিয়ে জামায়াত-শিবির খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। দেশের মানুষের কাছে জামায়াত-শিবির মানেই ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পরিচয় বহন করে। সেই অর্থে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হলে কাউকে না কাউকে মাঠে থাকতে হবে, সেই জন্যই জামায়াতের ইন্ধনে নব উদ্ভাবিত হেফাজতে ইসলামীর তথাকথিত ধর্ম রক্ষার আন্দোলন!

হেফাজতের ৪ নং দাবিতে দেখা যায়, ‘ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্জ্বলনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে।’ মানলাম হেফাজতের দাবিগুলো সভ্য সমাজ গঠনের পক্ষে উপকারী কিন্তু এতে যথোপযুক্ত যুক্তি আছে কিনা তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যদি হেফাজতের দাবিগুলো মেনে নিয়ে নারীদের ঘরে বন্দি করে রাখি তবে দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে যে বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিক কাজ করেন, তাদের অন্নের সংস্থান হবে কোথা থেকে? নিশ্চয় হেফাজতের নেতারা তাদের অন্নের সংস্থান করে দেবেন না? আর মোমবাতি প্রজ্জ্বলন যদি বিজাতীয় সংস্কৃতি হয় তাহলে হফাজতের নেতারা যে লং মার্চ করলেন সেটা কি বিজাতীয় নয়? লং মার্চ চীনা কমিউনিষ্ট মাও সে তুং প্রবর্তিত একটি কর্মসূচি। আর যে নাস্তিদের ফাঁসির দাবি হেফাজত নেতারা করছেনÑ সেই ‘নাস্তিক’ শব্দটি ‘বিশুদ্ধ সংস্কৃত’ ও কঠোর বৈদিক শব্দ। এগুলো কোন জাতীয় সংস্কৃতির উদাহরণ? তাদের দাবির ৭ নং এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।’ কি আশ্চর্য কথা! হেফাজতের কথা মেনে নিলে মহান স্বাধীনতার ভাস্কর্যগুলো ভেঙে দিতে হবে। শুধু স্বাধীনতার ঐশ্বর্য নয়, হাজারও লোকজ ঐতিহ্য ভরা বাংলার পূণ্যভূমি হেফাজত শ্মশান বানাতে চায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীম উদ্দীন, জীবনানন্দ দাস, শামসুর রাহমানসহ লালন ফকির, হাসান রাজা, শাহ্ আবদুল করিমের বাংলাকে, বাংলার সম্প্রীকে ধ্বংস করে দিতে চায়। পুথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চায় স্বাধীন, সার্বভৌম, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অস্তিত্ব!

হেফাজতের দাবিগুলো পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায়- একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের সুস্পষ্ট বার্তা এতে রয়েছে। হেফাজতের অন্যান্য দাবিগুলো ন্যায়সঙ্গত নয়, বরং দাবিগুলো মধ্যযুগীয়। আধুনিক যুগে বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করছে। সে হিসেবে হেফাজতের দাবিগুরো মেনে নিয়ে আমাদের মধ্যযুগে ফিরে যাবার কোনো সুযোগ নেই। হেফাততের দেয়া প্রায় প্রত্যেকটি দাবি অযৌক্তিক এবং সংবিধান পরিপন্থী। আমরা একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির বিরুদ্ধে। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশেকে স্বাধীন করেছিলাম। ধর্মকে ব্যবহার করে ১৯৪৭- এ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী জামায়াত ’৭১ এ ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করেছিল। ধর্মকে হাতিয়ার করে তারা কখনোই সফল হয়নি। জামায়াতের ইন্ধনে হেফাজতে ইসলাম আজ ধর্মকে ব্যবহার করেই ৪২ বছর আগের খায়েশ চিরতার্থ করতে মাঠে নেমেছে। সরকারের উচিত এদের কঠোর হস্তে দমন করা।

পলাশ চৌধুরী : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন