মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

সৃষ্ট সংঘাতময় পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির করণীয় কী

শেখর দত্ত
বিএনপি-জামাতের ১৮ দলীয় জোট এ সপ্তাহে আবারো দুই দিনের হরতালের মধ্যে দেশকে ঠেলে দিয়েছে। এই কর্মসূচি যে ওই জোটের পক্ষ থেকে আসবে, তা অনুমিত ছিল। হরতাল হলে ককটেল ফুটবে, যানবাহন ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ চলবে, বন্ধ দোকান পর্যন্ত ভাঙা হবে, পুলিশের ওপর আক্রমণ হবে, নিরিহ পথচারী আহত বা নিহত হবে, সংখ্যালঘুদের মন্দির ও ঘরবাড়ি ভাঙা হবে, রেলের ক্ষতি করা হবে ইত্যাদি অর্থাৎ সহিংস নাশকতাপূর্ণ ও নৈরাজ্যসৃষ্টিকারী কাজ চলতেই থাকবে। বলাই বাহুল্য উল্লিখিত কাজগুলো যখন চলতে থাকবে, তখন গ্রেপ্তারও চলবে। কোথাও কোথাও পরিস্থিতি শামাল দিতে হয়ত পুলিশি একশনও হবে, এতে রক্তও ঝড়তে পারে। উল্লিখিত পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে বলা যায়, পহেলা বৈশাখ ও অষ্টমী স্নান কেন্দ্র করে কয়েকদিন একটু বিরতি থাকলেও রাস্তায় মুখোমুখি সংঘাতময় রাজনীতি আবারো শুরু হয়ে গেলো।
একটু খেয়াল করলেই এটা লক্ষণীয় হয়ে উঠবে যে, বিএনপির গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের মধ্যে কয়েকজন ইতোমধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। যদি বিএনপি-জামাতের ১৮ দলীয় জোট মারমুখী হয়ে হরতালের দিকে আবারো না যেতো, তবে হয়তোবা বিএনপির নেতারা একে একে সবাই মুক্তি পেয়ে যেতেও পারতেন। কিন্তু নেতারা মুক্তি লাভ করুক, হরতাল-গ্রেপ্তার বন্ধ হয়ে আলোচনা-সমঝোতার একটা পরিবেশ সৃষ্টি হোক; এটা ১৮ দলীয় জোট চায় না। আর চায় না বলেই তড়িঘড়ি করে আবারো তারা সংঘাতপূর্ণ হরতালের ডাক দিয়েছে। সাধারণত ছুটির আগে দেয়া হয় হরতাল। কিন্তু এবারে বৃহস্পতিবার হাতে রেখে হরতাল দিয়েছে। যাতে কোনো অজুহাত তুলে ওই দিনও হরতাল দেয়া যায়।

বস্তুতপক্ষে সংঘাতের দিকে না গিয়ে বিএনপির আর অন্য কোনো উপায় নেই। থাকবে কি করে? জামাত দলটি তো এখন ১৮ দলীয় জোটের চালিকাশক্তি। জামাত স্টাইকিং ফোর্স অর্থাৎ জামাত যদি পুলিশ ও যানবাহনের ওপর চড়াও হয়ে ফেব্রুয়ারির পর থেকে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারতো, তবে কোথায় থাকতো এখন বিএনপির অবস্থান! তাই জামাত যেভাবে কর্মসূচি দিতে বলছে, ১৮ দল সেভাবেই চলছে। সামনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা গোলাম আজম ও কামরুজ্জামানের রায় ঘোষণা করবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর তাই এর আগে-পরে হরতাল হতেই হবে। এ দিকটি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, নির্বাচনী রায় এবং গণজাগরণ মঞ্চ-ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিÑ সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামসহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের সংগঠন-গোষ্ঠী-ব্যক্তি-জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে যেমন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে সরকারের পিছু হটার কোনো উপায় নেই। উল্টোদিকে তেমনি কার্যত জামাতের নেতৃত্বে পরিচালিত ১৮ দলীয় জোটের হরতাল তথা সংঘাতপূর্ণ দিকে ঠেলে দেয়া ছাড়াও বিকল্প নেই।

বিএনপি নেতারা তো বটেই এমনকি নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজের কেউ কেউ এমনটা বলতে চান যে, মূল ইস্যু হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু। বিএনপির এই দাবি যদি মেনে নেয়া হয় তবে ওই দল আর রাজনীতি মুখোমুখি সংঘর্ষের দিকে যাবে না। কথাটা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ভ্রান্ত হতে বাধ্য। ইতোমধ্যে এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বিএনপি অন্তত এই পর্যায়ে কেবল জাতীয় কারণে নয় আন্তর্জাতিক চাপেও ‘আত্মার আত্মীয়’ জোটসঙ্গী জামাতকে ছাড়তে পারবে না। আর জামাতকে যদি বিএনপি সঙ্গে রাখে তবে নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির সব দাবি মেনে নিলেও ১৮ দলীয় জোট এই পর্যায়ে সাংঘর্ষিক রাজনীতির দিকে দেশকে নিয়ে যাবেই। প্রসঙ্গত, মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী, যাদের বিচার হচ্ছে, তাদের মধ্যে কেবল জামাতের নেতারা নয়, বিএনপির দুই নেতা সাকা চৌধুরী ও আব্দুল আলিমও রয়েছে। আর এটা কার না জানা বিএনপি দলটি যেভাবে সৃষ্টি হয়ে বর্তমান পর্যায়ে এসেছে, তাতে জামাতপন্থী এক বিরাট নেতা-কর্মী-সমর্থক রয়েছে বিএনপি দলের মধ্যে। তাই কেবল দল হিসেবে জামাত নয়, বিএনপির মধ্যেও একটা বড় অংশ যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে সংঘাতের দিকে দেশকে ঠেলে দিতে যারপরনাই তৎপর রয়েছে। তাই সার্বিক বিচারে সংঘাতের রাজনীতি সৃষ্টি হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু নিয়ে নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যু থেকেই। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে আরো বলা যায় যে, বিরাজমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি যদি স্থির নিশ্চিত হতো নির্বাচন করলেই তারা জয়লাভ করবে, তবে তাদের তত্ত্বাবধায়ক সকারের দাবি হতো প্রধান এবং সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় বিবেচনায় নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরতো। আলোচনা-সমঝোতার প্রচেষ্টা নিতো। প্রথমত, সংঘাতের রাজনীতিকে অগ্রসর করে আর্মিকে ‘দায়িত্ব পালনের’ আহ্বান জানাতো না। দ্বিতীয়ত, বিএনপির পক্ষে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবি মেনে নেয়া যে সম্ভব নয়, এটা মহিলা নেত্রী খালেদা জিয়াসহ কার না জানা। তবুও তারা ওই সংগঠনকে উস্কানি ও আর্থিক-নৈতিক সমর্থন দিয়ে রাস্তায় নামাতো না। এখানে উল্লেখ্য, ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানে ধর্ম নিয়ে নির্বাচন করাকে বেআইনি করা হয়েছে। আর বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে হেফাজতে ইসলামকে নামানো হয়েছে। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে কার না জানা ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করলে তা হয় আগুন নিয়ে খেলারই নামান্তর। তবুও আগুন নিয়েই খেলছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। কারণ বিজয়লাভ সুনিশ্চিত নয় বিধায় বিএনপি চায় না নির্বাচন আর তাই এ দিক থেকেও যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর ইস্যুই হয়েছে দলটির কাছে প্রধান। বস্তুতপক্ষে বিএনপি যদি এই ধরনের নীতি কৌশল নেয়, তবে ক্ষমতাসীন জোটের কি সংলাপ-সমঝোতার উল্টো নীতি-কৌশল গ্রহণ করা সম্ভব?

এটা নিরপেক্ষ দাবিদার সুশীল সমাজ যারা বলে চলেছেন, মূল ইস্যু হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং তা বিবেচনায় নিয়ে সংলাপ-সমঝোতার নানা ফরলমুলা দিয়ে চলছেন, বিএনপির উল্লিখিত অবস্থান তারা অনুধাবন করছেন না, এমনটা কিন্তু নয়। কারণ এতোটা অবুঝ তাদের হওয়ার কথা নয়। কেবল বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করতে বলে সোজা-বাঁকা বোঝার ক্ষমতা তাদের অনেক বেশি। কিন্তু অতীত থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হবে যে, নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম বাদে এই নিরপেক্ষ দাবিদার মহল আদতে দেশের রাজনীতিতে তৃতীয় পক্ষ হতে চায়। ‘মাইনাস টু’ ফরমুলা রয়েছে তাদের মাথায়, পরিকল্পনায়। তারা বলেন যে, দুই নেত্রীই হচ্ছেন মুখোমুখি সাংঘর্ষিক রাজনীতির মূলে। প্রশ্ন হলো মধ্যপ্রাচ্যের, উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশে তো দুই নেত্রী নেই। সেখানকার অনেক দেশে আমাদের চাইতেও রাজনীতি সংঘর্ষপূর্ণ কেন? বাস্তবে উল্লিখিত পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করতেই তারা এমনটা বলেন। অভিজ্ঞতা থেকে এটা কার না জানা, দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে হলে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, দেশে সংবাদ মাধ্যমের কারণে ‘সমদূরত্ববাদী’ বুদ্ধিজীবীরা কিন্তু অতি রাজনীতি করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে, রাজনৈতিক নেতাদের চাইতে এই সব সুশীল সমাজের নেতারা রাজনীতি করছেন বেশি। দুই বড় দলের হাতেগোনা নেতারা সংবাদ মাধ্যমে প্রচার পান। কিন্তু সংখ্যায় অনেক বেশি এবং অনেক সময় বেশি পান সুশীল সমাজের এই সব সুশীল সমাজের নেতারা। তারা রাজনৈতিক দল করেন না ঠিকই কিন্তু দলীয় নেতাদের চাইতে বেশি করেন রাজনীতি। নির্বাচন যেহেতু করতে হয় না, তাই তাদের কোনো দায়ও নেই। নানা সময়ে নানা ধরনের কথা তুলতে তারা পারদর্শী।

বিগত সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আর্মি বেকিং-এ ‘কিংস পার্টি’ করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তাদের অনেকেই। বর্তমান আমলেও এনজিও কিংবা বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে সভায় রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তাদের কেউ কেউ। তাদের অনেকেই সামরিক সরকারসহ বিভিন্ন আমলে আয়েশে সরকারি চাকরি করেছেন, সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। কেউ কেউ বড় রাজনৈতিক দলের নেতাও হতে চেয়েছিলেন। এখন তারাই সাজতে চাইছেন গণতন্ত্রের রক্ষাকর্তা। প্রশ্ন হলো ধরি মাছ না ছুঁই পানি কিংবা স্নান করতে এসে চুল না ভেজালে তো চলবে না। সুযোগ তো আছে, নানা মহলের চেষ্টাও আছে; তাই দল করার জন্য রাজনীতিতে নেমে পড়লেই তো হয়। কথায় বলে চিন্তা বা পরিকল্পনা করলেই নাকি অর্ধেক কাজ হয়ে যায়। সমাধানের মডেল যেহেতু তাদের আছে, তাই অর্ধেক কাজ তো হয়েই আছে। এখন বাকি অর্ধেক কাজ করতে রাজনৈতিক দল করে মাঠে নামলেই তো হয়। দল করতে না নেমে এতো কথা শুনতে শুনতে এখন মনে হয় বাংলাদেশে সুশীল সমাজের অতি রাজনীতি এখন একটা রোগ বিশেষ।

অভিজ্ঞতা পর্যালোচনায় এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, সেই পাকিস্তানি আমলের শুরু থেকে দুই ধারার অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ বলার সাম্প্রদায়িক উগ্র ধর্মীয় দুই রাজনৈতিক দলই জনসমর্থন নিয়ে রাজনীতিতে টিকে থেকেছে। কেবল পাকিস্তানি আমলের শেষ দিক থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং বঙ্গবন্ধু আমলের সাড়ে তিন বছর দ্বিতীয় ধারার রাজনৈতিক সমর্থন একেবারেই সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল। যাই হোক সুদীর্ঘ ওই সময়ে এই দুই দলের বিপরীতে ডান-বাম-মধ্য থেকে বিভিন্নমুখী চেষ্টা সত্ত্বেও কোনো দল মানুষের কোনো আস্থা বা সমর্থন নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি। ন্যাপ ভাসানীর মতো নেতা নিয়ে, কমিউনিস্ট পার্টি প্রবীণ-নবীন ত্যাগী একনিষ্ঠ নেতাকর্মীদের নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে মূলত ছাত্রলীগের দৃঢ়চিত্ত-সংঘবদ্ধ নেতাদের নিয়ে জাসদ গঠিত হয়েছিল। কেউ গণআস্থাসম্পন্ন দলে পরিণত হতে পারেনি। এখন ভেঙে ছিন্নবিচ্ছিন্ন নানা অংশ ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। গণফোরাম করে ড. কামাল হোসেন সাড়া জাগিয়েছিলেন। দল ধরে রাখতে পারেননি। বড় একটা অংশ গেছে আওয়ামী লীগে। সবশেষে পংকজ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে দল দুই টুকরো হয়েছে। তিনি বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে নিয়ে সবেক আওয়ামী লীগ-বিএনপি মিলে মঞ্চ করেছিলেন। এখন যথারীতি তা ভেঙে গেছে। কাদের সিদ্দীকী গামছা নিয়ে একাই আছেন বলে বোধ হচ্ছে। পত্রিকার পাতায় তিনি এখন রাজনীতি করছেন। অন্য বাম দলগুলোর মধ্যে ডিগবাজি দিয়ে আওয়ামী লীগের সুদীর্ঘকালের মিত্র সিপিবি এখন আওয়ামী লীগ বিরোধী বাম ধরাকে ক্ষমতায় নিতে বাসদের সঙ্গে মিলেছে। এদিকে বাসদ আবার গেছে ভেঙে। আর আওয়ামী লীগের তীব্র বিরোধী সাম্যবাদী দল, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ এখন আছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মাহজোটে।

উল্টো দিকে কমবেশি একই ধরনের অবস্থা সাম্প্রদায়িক উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির ধারার। প্রসঙ্গত, এটা বলে নিতে হয় যে, অতীতে পাকিস্তানি আমলের চাইতে স্বাধীন বাংলাদেশের আমলে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর এই ধারার শক্তি-সমর্থন ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মূলে রয়েছে বিশ্ব রাজনীতি-অর্থনীতির রঙ্গমঞ্চে মূলত সত্তরের দশকে প্রেট্রো ডলালের শক্ত অবস্থান নিয়ে আর্বিভাব। ৯/১১ টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ভেতর দিয়ে বিশ্বব্যাপী উগ্র ধর্মান্ধতা ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে শক্তিশালী হতে থাকলে বাংলাদেশেও এর শক্তি-সমর্থন অতীতের যে কোনো সময়ের চাইতে বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিএনপির অভ্যন্তরে জামাতের নেতাকর্মীদের অবস্থান, বিএনপি-জামাতের ভাবাদর্শ-রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ঐক্য, মাদ্রাসা প্রসার এই ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধিতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অবস্থা দৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে এই ধারা ক্রমে আরো উগ্র সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠবে। দেখা যাবে এই ধারারও একাধিক দল ক্রমেই না থাকার অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। বিএনপিই জামাত আর জামাতই বিএনপি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন হেফাজতে ইসলাম এই জোটকে কতোটুকু গ্রাস করতে পারে সেই প্রচেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ধর্মীয় ইস্যু রাজনীতিতে যতো আসবে, ততোই কিছু এতে বিভক্তি বাড়বে। ইতোমধ্যে আহালে সুন্নাত সুন্নী সমাবেশ করছে। এই সংগঠনও ঢাকায় সমাবেশ করবে। চরমোনাই পীর হেফাজতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছে। অর্থাৎ এ পক্ষে এক দলের মতো ঐক্য যেমন হচ্ছে, তেমনি বিরোধী পক্ষও দাঁড়াচ্ছে।

বাম-মধ্য-ডানের এই সব প্রচেষ্টা পর্যবেক্ষণ করলে এটা সুস্পষ্ট হতে থাকবে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যু নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুই দেশকে রাজনীতির এক ক্রান্তিলগ্নে এসে দাঁড় করিয়েছে। এ দিক বা ও দিক যাওয়ার কারো কোনো উপায় নেই। এই বিবেচনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কথা যারা বলেন, তারা সুশীল সামজের নিরপেক্ষ দাবিদারই হোক বা ১৪ দলের রাজনৈতিক অবস্থান বিরোধী হোক, তাদের দুই নৌকায় পা দেয়ার অবকাশ নেই। সাধে প্রখ্যাত শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী মুনতাসীর মামুন বলেননি, মৌলবাদী হলে এই রাষ্ট্রের প্রয়োজন নেই। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, গোষ্ঠী-ব্যক্তির এক মঞ্চে দাঁড়ানোর বাস্তবতা রয়েছে। এটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িত এবং বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সংশ্লিষ্ট সকলের কাছেই দেশপ্রেমিক কর্তব্য হিসেবে সমুপস্থিত করে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তির ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক-উগ্র ধর্মীয় ধারার রাজনীতি দেশকে প্রকৃত বিচারে গৃহযুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তির কর্মসূচির ভিত্তিতে নিñিদ্র ঐক্য গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

আন্তর্জাতিক ও উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষে থাকবে বলে অনুমান করা চলে। বোস্টনে ম্যারাথনে বোমা হামলা সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। উপমহাদেশের রাজনীতিতে জঙ্গি দমনে বাংলাদেশ বর্তমান আমলে যে ভূমিকা নিয়েছে, তাতে সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোতে শান্তি-স্থিতিশীলতার রক্ষার প্রয়োজনেই শক্তির ভারসাম্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে থাকবে বলে অনুমিত হয়। উল্টো দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর প্রশ্নেই হোক আর ১৩ দফা দাবি নিয়েই হোক সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় দল-সংগঠন-গোষ্ঠীগুলোর একত্র থাকার কোনো বাস্তবতা ক্রমেই সঙ্কুচিত হবে। পাকিস্তানি আমলের মতো ধর্মভিত্তিক দলগুলো দল-মত নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যাবে এমন বাস্তবতা নেই। ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর কেউ কেউ কার্যত এখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অভিজ্ঞতা তাদের বলে দিচ্ছে, উগ্র জঙ্গি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, ‘ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার’ এই নীতির পক্ষে দাঁড়ালেই ধর্ম হবে রক্ষিত-মহিমান্বিত। অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিই ধর্মকে প্রকৃত পবিত্র উঁচু স্থানে বসাতে সক্ষম। সাম্প্রদায়িক-ধর্মভিত্তিক রাজনীতি সহিংসতার জনক আর তাই তা পরিত্যাজ্য। যদি তা না হয় তবে পাকিস্তান পবিত্র ধর্মকে নির্বাচনী প্রচারে নিষিদ্ধ করছে কেন?

সবশেষে বলি, হরতাল দিলে গ্রেপ্তার চললেও এখন বোধকরি সময় এসেছে ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষ থেকে সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা সংসদে উপস্থাপিত করার। সংবিধান রক্ষা করে এর একটি রূপরেখা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশের মাটিতে উত্থাপন করেছিলেন। এটা স্পষ্ট করে তুলে এখন সংসদে উপস্থাপন করা প্রয়োজন বলে অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা চলে। এটা উপস্থাপন করে সরকারি জোট প্রধান বিরোধী দলকে আহ্বান জানাতে পারে তাদের রূপরেখার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় জন্য সংসদে যেতে। এখানে নতুন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ, যিনি স্পিকার হিসেবে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন এবং যার বিরুদ্ধে স্পিকার থাকার সময়ে দলীয়ভাবে ভূমিকা রাখার অভিযোগ নেই, তিনি পারেন ভূমিকা রাখতে। সংসদের নতুন স্পিকার যিনি হবেন, তিনিও ক্ষমতাসীন জোট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব দিলে বিরোধী দলকে সংসদে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবেন। ওই আহ্বানে বিএনপি যদি সংসদে গিয়ে সংলাপ-সমঝোতায় যায়, তাহলে হবে দেশের মঙ্গল। আর বিএনপি যদি ওই সময়ে নিজ দাবি উত্থাপন না করে সংসদ বয়কট করে, তবে বিএনপি নির্বাচন বিরোধী মনোভাব এবং যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মুখোশই উন্মোচিত হবে। বিএনপি হবে চরমতমভাবে গণবিচ্ছিন্ন। আর এটা হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি সময়োপযোগী নীতি-কর্মসূচি নিয়ে নিñিদ্রভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। দেশের ক্রান্তিলগ্নে সমাধানের পথ বের হয়ে আসবে।

শেখর দত্ত : রাজনীতিক, কলাম লেখক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন